অন্ততঃ গত কয়েক বছর ধরে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে, বিভিন্ন মেট্রোপলিটান শহরে, গ্রামে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে – এক কথায় সম্ভাব্য প্রতিটি ভৌগোলিক স্থানে – চিকিৎসকেরা আক্রান্ত হয়েছেন রোগি বা তাদের সঙ্গে আসা লোকজনের হাতে। এমনকি করোনাকালীন পরিস্থিতিতেও যে এ ঘটনা ঘটেনি তা নয়। এরকম আক্রমণে একাধিক চিকিৎসক নিহত হয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ এবং ভারতে। আর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে? ল্যান্সেট-এ সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে (সেপ্টেম্বর ৫, ২০২০) “COVID-19 exacerbates violence against health workers” শিরোনামে। সংবাদটি জানাচ্ছে পৃথিবী জুড়ে ৬০০-র বেশি চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মী করোনাকালে আক্রান্ত হয়েছে। সিরিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ থেকে ভারতের মতো বহুসংখ্যক দেশে এ ঘটনা ঘটছে। খোদ WHO থেকে সতর্কবাণী দেওয়া হচ্ছে – “Violence against health workers” – এই করোনাকালে। আলাদা আলাদা করে যে দেশগুলোর রিপোর্ট রয়েছে সেগুলো হল অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, বুলগেরিয়া, লেবানন, মোজাম্বিক, পর্তুগাল, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং থাইল্যান্ড।
এই বাংলায় সত্তরোর্ধ বৃদ্ধ চিকিৎসক মারমুখী জনতার কাছে মারের হাত থেকে বাঁচার জন্য করজোড়ে মিনতি করেছেন। পুজোর প্রাক্কালে ডেবরাতে বিষ্ঠালেপিতও হয়েছেন চিকিৎসক। অন্য একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন, কলকাতার একটি বেসরকারি নামী ও দামী হাসপাতালে দক্ষিণ ভারতীয় এক চিকিৎসক যিনি এখানে কর্মসূত্রে এসেছেন সে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন যাদবপুর থানার ওসি পুলক দত্তের হাতে বিরাশি সিক্কার চড় খেয়ে আহত হয়েছেন। সেই পুলিস অফিসার নাকি বলেছেন, অ্যাপ্রন না পরে থাকায় ডাক্তার হিসেবে চিনতে পারেননি। ফার্মাসির লোক হিসেবে ভুল করেছিলেন! (ফার্মাসির লোককে পুলিস ইচ্ছেমতো মারধর করতে পারে কিনা সে প্রশ্ন না হয় এখন উহ্যই থাক!)
ভারতে চিকিৎসকদের ওপরে ক্রমবর্ধমান আক্রমণ নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে উদ্বেগের সঞ্চার হয়েছে। Lancet, PLoS, British Medical Journal (BMJ), Journal of Royal Society of Medicine (JRSM)-র মতো সুপরিচিত মেডিক্যাল জার্নালগুলোতে বহুলসংখ্যক প্রবন্ধ, গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। বিভিন্ন প্রবন্ধের শিরোনাম এরকম – “Rising violence against health workers in India (Lancet, April 29, 2017); “Structural Violence and Clinical Medicine (PLoS, 2006); “Violence against Doctors: The Class Wars (Indian Heart Journal, 2015); “Violence against doctors: a review (Journal of Royal Society of Medicine, February 1996)। এবং সামগ্রিকভাবে আজ স্বাস্থ্যের জগতে হিংসার প্রভাব এরকম পর্যায়ে পৌঁছেছে যে ২০০২ সালে WHO-কে World Report on Violence and Health প্রকাশ করতে হয়। ১৬০ জনের বেশি বিশেষজ্ঞ ৩ বছর ধরে আফ্রিকা, দুই আমেরিকা, এশিয়া, ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যের ৭০টির বেশি দেশে সমীক্ষা চালিয়ে এ রিপোর্ট প্রস্তুত করা করেছিলেন। এ রিপোর্টে বলা হল ভায়োলেন্স তাকে বলা যাবে যা শারীরিক ক্ষত তৈরি করে বা মৃত্যু ঘটায় অথবা মানসিক জগতে ক্ষতি (harm) করে কিংবা ব্যতিচারী বিকাশ (maldevelopment) বা বঞ্চনা (deprivation) সৃষ্টি করে।
ল্যান্সেটে প্রকাশিত Rising violence against health workers in India প্রবন্ধে হিসেব দেওয়া হল ২০১৬-র একটি সমীক্ষায় (দিল্লির একটি “tertiary care” হাসপাতালে) দেখা গেছে বিগত ১২ মাসে ৪০%-এর বেশি রেসিডেন্ট ডাক্তার তাদের কর্মক্ষেত্রে হিংসার সম্মুখীন হয়েছে। IMA (Indian Medical Association)-র ২০১৭-র রিপোর্ট অনুযায়ী ৭৫% ডাক্তার তাদের কর্মজীবনে হয় দৈহিক কিংবা মৌখিকভাবে হিংসার আক্রমণের মুখোমুখি হয়েছেন। এর কারণ হিসেবে IMA-র রিপোর্ট জানিয়েছে, আর্ত এবং জরুরী রোগীদের প্রথম মুখোমুখি হতে হয় জুনিয়র এবং রেসিডেন্ট ডাক্তারদের। এজন্য আক্রমণের প্রথম লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠেন এরা। পুণের Pune Citizen-Doctor Forum-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা অরুণ গাডড়ে এর কারণ হিসেবে মনে করেন, “জনস্বাস্থ্য খাতে ক্রমাগত ব্যয়-সংকোচন ঘটছে এবং সরকারের নীতি pro-private হবার ফলে passive privatization অধিকতর গুরুত্ব পাচ্ছে।” ভারতে প্রাইভেট সেক্টর এই মুহূর্তে এমন অবস্থায় আছে যেখানে বহির্বিভাগের রোগীর ৮০% এবং ভর্তি হওয়া রোগীর ৬০%-এর পরিষেবা দেয় প্রাইভেট সেক্টর। এদেশে বর্তমানে স্বাস্থ্যখাতে (সরকারি) ব্যয় জিডিপির ১.১৫%, কিন্তু স্বাস্থ্যের খরচ মেটাতে (যা একটি দরিদ্র পরিবারের আয়ের ২৫%) প্রতিবছর ৬.৫ কোটির বেশি মানুষ দারিদ্র্য সীমার নীচে চলে যাচ্ছে। এর গালভরা নাম “মেডিক্যাল পভার্টি ট্র্যাপ” বা মেডিসিনের দারিদ্র্য-ফাঁদ। এ হিসেব কেন্দ্রীয় সরকারের (National Health Policy, 2017)।
পল ফার্মারের মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গবেষক একে বুঝতে চেয়েছেন কাঠামোগত হিংসা (structural violence) হিসেবে। আরেকজন মান্য গবেষক মাইকেল মার্মট (Michael Marmot) একটু ভিন্ন চোখে বিষয়টিকে দেখেন। যাহোক, কি এই স্ট্রাকচারাল ভায়োলেন্স বা কাঠামোগত হিংসা? বৃহৎ পরিসরে, পরিব্যাপ্ত ক্ষেত্রে জাত, ধর্ম, লিঙ্গ বৈষম্য, বর্ণ বৈষম্য, রাজনৈতিক হিংসা, যুদ্ধ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য, সাংস্কৃতিক বিভাজন ইত্যাদি সমস্ত কিছুই অধিকাংশ ক্ষেত্রে নির্ধারণ করে কে কে অসুস্থ হয়ে পড়বে, তার suffering বা ক্লিষ্টতা কতটা এবং “access to care” বা স্বাস্থ্য পরিষেবা পাবার কতটা অধিকার এবং সুযোগ থাকবে বা স্বাস্থ্য পরিষেবার কাছে কতটা পৌঁছুতে পারবে।
PLoS জার্নালে ২০১০ সালে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল – Nuclear Weapons and Neglected Diseases: The “Ten-Thousand-to-One-Gap”. এ প্রবন্ধে দেখানো হয়েছে কতকগুলো রূঢ় বাস্তবের পরিসংখ্যান – (১) ১১টি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ ১০ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি ব্যয় করেছে অস্ত্র তৈরি এবং রক্ষণাবেক্ষণে, (২) সমগ্র পৃথিবীতে প্রতিবছর ৮০ কোটির বেশি মানুষ গোল কৃমি দ্বারা আক্রান্ত হয় তাদের অধিকাংশই মধ্য- বা নিম্ন-আয়ের পারমাণবিক শক্তিধর দেশের – যেমন, ভারতে আক্রান্তের সংখ্যা ১৪ কোটি, চিন ৮.৬ কোটি ইত্যাদি, (৩) “neglected disease control” এবং R&D-র জন্য মোট খরচ ১ বিলিয়ন ডলারের কম অর্থাৎ ১০ ট্রিলিয়ন ডলারের পারমাণবিক অস্ত্রসম্ভারের ১/১০,০০০ ভাগেরও কম। Lancet-এ ২০১০ সালের ২ জানুয়ারি প্রকাশিত হয়েছিল “Neglected tropical diseases – beyond the tipping point?”। সে প্রবন্ধে দেখানো হল “overseas development assistance”-এর মাত্র ০.৬% বরাদ্দ আছে “tropical neglected disease”-এর জন্য।
এরকম আর্থিক অসাম্য এবং সামাজিক বৈষম্যকে এপিডেমিওলজির অবস্থান থেকে বিশ্লেষণ করে মাইকেল মার্মট জানান – “স্বাস্থ্য হল দীর্ঘ সামাজিক প্রক্রিয়ার পরিণতি ও ফলাফল।” শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং দর্শনের প্রসঙ্গ তুলে মার্মট অসাম্য ও বৈষম্যের জন্য natural justice বা স্বাভাবিক/প্রাকৃতিক ন্যায়ের প্রসঙ্গও বিবেচনায় রাখেন।
Structural violence (কাঠামোগত হিংসা)-এর এক অসহনীয়, মারাত্মক উদাহরণ হল যে সমস্ত অঞ্চলে ক্রমাগত সন্ত্রাস চলছে বা দুটি বিবাদমান গোষ্ঠীর মধ্যে চলছে সশস্ত্র সংঘর্ষ কিংবা রাষ্ট্র এবং জঙ্গীগোষ্ঠীর মধ্যে নিরন্তর বন্দুক, গ্রেনেড, মর্টারের লড়াই চলছে। এই ক্রস-ফায়ারিং-এর মাঝে পড়ছে সাধারণ মানুষ যাদের এতে কোন ভূমিকা নেই, ভাষ্য নেই, অবস্থিতি নেই। মধ্য প্রাচ্য, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা সহ বিভিন্ন দেশে বছরের পর বছর ধরে এ ঘটনা ঘটে চলেছে। আমাদের দেশে এর সর্বোচ্চ উদাহরণ হল কাশ্মীর। দেখা গেছে লাগাতার হিংসাত্মক কার্যকলাপের মধ্যে পড়ে জনজীবনের এক বড়ো অংশের মধ্যে বিভিন্ন চরিত্রের মানসিক রোগ হয়, যেমন উদ্বেগ এবং অবসাদ। আরেকটি নির্দিষ্ট রোগের নাম হল PTSD (Post-Traumatic Stress Disorder)। Medicins Sans Frontieres (Doctors without Borders)-এর তরফে ২০১৫ সালে কাশ্মীর নিয়ে একটি ১০৪ পৃষ্ঠার তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। সে রিপোর্টে বলা হয়েছে – ১৮ লক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক কাশ্মিরী (জনসংখ্যার ৪৫%) মানসিক রোগের শিকার, ১৯% PTSD-র। এ রিপোর্টে আরো বিপজ্জনক তথ্য হল – “By 2012, approximately 70,000 Kashmiris had lost their lives in the conflict and 10,000 people had been reported missing.” আরেকটি multi-centric study ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালে ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয়েছিল “Prevalence of anxiety, depression and post-traumatic stress disorder in the Kashmir Valley” শিরোনামে। সেখানেও একই ধরনের তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। এসব রিপোর্টে নজর করার মতো হল যে অসহনীয় হিংসা বৃদ্ধির সাথে সাথে নিঃসহায়, আর্ত মানুষ বেশি বেশি করে দরগা, পীর বা ঈশ্বর/আল্লা-নির্ভর নিরাময়ের দিকে ঝুঁকছে। আধুনিক মেডিসিনের ওপরে নির্ভরতা কমছে।
এ তো গেল রোগির অবস্থান থেকে দেখা। আবার এই মুহূর্তের পশ্চিমবাংলার ডাক্তারদের অবস্থান থেকে যদি দেখি তাহলে তাদের ওপরে যে হিংসা ক্রমাগত নেমে আসছে সেখানে তাদের, ভিন্ন অর্থে, “access to care” কোথায়? যখন প্রতি সাড়ে তিনদিনে “জাগো বাংলা”-য় ১জন ডাক্তার নিগৃহীত, রক্তাক্ত বা বিষ্ঠাশোভিত হচ্ছেন তখন কোথায় পাবে বিচার? কে নেবে ডাক্তার সমাজের ক্লিষ্টতার দায়ভার? কিভাবে? পল ফার্মার দেখিয়েছেন কত ঘনিষ্ঠভাবে এবং কতদূর structural violence যুক্ত হয়ে আছে সামাজিক অন্যায় এবং নিপীড়নের social machinery-র সাথে। পশ্চিমবাংলার নির্দিষ্টতায় হতাশ্বাস ডাক্তারদের অবস্থান থেকে এর সাথে বিশেষভাবে যুক্ত করতে হবে রাজনৈতিক ক্ষমতার বিভিন্ন প্রকাশকে, যে প্রকাশগুলো ডাক্তার সমাজের ওপরে ভয়ংকর ক্রোধ এবং আক্রমণ হিসেবে উদ্গীর্ণ হচ্ছে।
হিংসা তথা ভায়োলেন্সের একটি ভিন্ন হিসেব দেখা যাক। Medline চিকিৎসাসংক্রান্ত গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ সার্চ ইঞ্জিন। Medline সার্চে ১৯৭০-এ “ভায়োলেন্স” এই keyword দিয়ে পাওয়া ফলের সংখ্যা ছিল ২৭১১। ১৯৯০-এর দশকে এ সংখ্যা ৮০০০-এর মতো। আর ২০১৮ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর মোট সংখ্যা ১,০৪,৬৩২। এবং suffering বা ক্লিষ্টতা নিয়ে সার্চ রেজাল্টের সংখ্যা ২,৬৬,১৫২। এ থেকে অনুমান করা যায় গত ২৫-৩০ বছরে কি তীব্র গতিতে ভায়োলেন্স সংক্রান্ত রিসার্চ পেপার তৈরি হচ্ছে। হিংসার উৎস কোথায়? ল্যান্সেটে প্রকাশিত (নভেম্বর ৩, ২০০১) “Violence and medicine: the necessary politics of public health” প্রবন্ধে বলা হল – “These triggering factors have political as well as social dimensions … Violence is also part of the debate about globalization.” এর সাথে যুদ্ধে ব্যয়বরাদ্দ বাড়ানোর প্রশ্নও জড়িয়ে আছে, একথা উল্লেখ করা হল। এখানে অনুসন্ধানী পাঠকের মনে পড়বে প্রায় ৪৩ বছর আগে আলমা-আটা-র ঐতিহাসিক প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা সংক্রান্ত ঘোষণায় “independence, peace, détente and disarmament” অর্থাৎ, স্বাধীনতা, শান্তি, দ্বিপাক্ষিক আঁতাত এবং নিরস্ত্রীকরণের ওপরে জোর দেওয়া হয়েছিল যাতে যুদ্ধখাতে এবং সমরাস্ত্রের জন্য ব্যয় কমিয়ে স্বাস্থ্যের জন্য আরো বেশি সম্পদ তৈরি করা যায়।
চিকিৎসকের ওপরে আক্রমণ বর্তমান সময়ে পৃথিবী জুড়েই বিভিন্ন জায়গায় হচ্ছে। আমেরিকাতে প্রধানত বন্দুকের ব্যবহার চলে। কিন্তু এ রাজ্যে এবং আমাদের দেশে ভিন্ন ভিন্ন প্রান্তে যেরকম নৃশংসভাবে ডাক্তাররা বারংবার আক্রান্ত হচ্ছে তা যথেষ্ট বিরল এবং এর তুল্য উদাহরণ বেশি নেই। কেন ঘটছে? এর কোন একমাত্রিক, সরলরৈখিক উত্তর নেই। আমরা আমাদের আলোচনার শেষে এ নিয়ে আরেকটু বিস্তৃত আলোচনা করবো। তার আগে মেডিসিনের আভ্যন্তরীন, অন্তর্লীন সংকট নিয়ে কিছু বিষয় দেখা যাক।
মেডিসিনের অন্তর্গত হিংসার বিভিন্ন রূপ
মেডিসিনের ঐতিহাসিক বিকাশ ও বিবর্তনের মাঝে তীব্র অন্তর্লীন দ্বন্দ্ব এবং টানাপোড়েন রয়েছে। একদিকে মেডিসিন “art of healing”, অন্যদিকে রোগের হন্তারক। দুক্ষেত্রেই মেডিসিনের কেন্দ্রে রয়েছে মানুষ। দেরিদা তাঁর “Plato’s Pharmacy” রচনায় দেখিয়েছেন pharmacon শব্দটি একদিকে বিষ, অন্যদিকে অমৃত বা নিরাময়কারী – দুটো অর্থই বহন করতে পারে। মেডিসিনের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য।
আমরা রোগকে বুঝি বায়োলজির দৃষ্টিকোণ থেকে। বুনিয়াদি বিজ্ঞানে গবেষণা যত অগ্রসর হয় চিকিৎসা তত আধুনিক, লক্ষ্যভেদী এবং ফলপ্রদ হয়। কিন্তু বায়োলজির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার মাঝে একটা বিপজ্জনক গলদ আছে, আবার অনেকক্ষেত্রে না দেখেও উপায় নেই। একজন ডাক্তারের কাছে হার্ট অ্যাটাকের রোগী এলে তার হার্টে রক্ত চলাচলের অবস্থা, রক্তে বিভিন্ন বায়োকেমিক্যাল মার্কারের পরিমাণ মাপা ইত্যাদি আমাদের প্রধান বিবেচ্য হয়ে দাঁড়ায় চিকিৎসার স্বার্থে, অনিবার্যভাবেই। কিন্তু রোগী হিসেবে যে আসে সে তো শুধু একটি রোগাক্রান্ত দেহ নয়, একজন মানুষ। অর্থাৎ, আমি একজন biological organism-কে দেখছিনা, দেখছি biosocial একজন person বা ব্যক্তিকে। যখন বায়োসোশ্যাল থেকে শুধু বায়োলজিকে আলাদা করে ফেলা হচ্ছে তখনই একধরনের হ্রস্বীকরণ (reductionism) শুরু হয়ে যাচ্ছে। চিকিৎসাবিদ্যার সমগ্র শিক্ষাক্রম জুড়ে এভাবেই শিক্ষার্থীরা শেখে, চিকিৎসার ধরনও এভাবে তৈরি হয়।
এখানে নজর করার মতো আরেকটি বিষয় আছে। মনে রাখা দরকার, স্বাস্থ্যের দুটি ধরনের – ব্যক্তিগত চিকিৎসা তথা ক্লিনিক্যাল হেলথ এবং জনসমষ্টির স্বাস্থ্য তথা পাবলিক হেলথ – মধ্যে ফারাক আছে। আমরা সাধারণভাবে সরকারি হাসপাতালে, নার্সিং হোমে, ক্লিনিকে বা পাঁচতারা-সাততারা কর্পোরেট হাসপাতালে যে রোগীদের দেখি তাদেরকে ক্লিনিক্যালি বা ব্যক্তি রোগী হিসেবে দেখা হয়, যাকে আমরা বলতে পারি clinical health – যেখানে একক ব্যক্তিরোগী প্রাথমিক গুরুত্বসম্পন্ন। আবার জনস্বাস্থ্যের এলাকাতে স্যানিটেশন, হাইজিন, টীকাকরণ ইত্যাদি বিভিন্ন প্রোগ্রামে যে রোগীদের আমরা দেখি তাদের দেখি public health-এর দৃষ্টিকোণ থেকে – এখানে একক ব্যক্তিরোগীর চাইতে গুরুত্বপূর্ণ তার কমিউনিটি, চারপাশের বান্ধব পরিবেষ্টিত পরিবেশ, যে বিশেষ সামাজিক অবস্থানে সে স্থিত সে প্রসঙ্গগুলো। উভয়ক্ষেত্রেই যদি desocialization বা সমাজহীনতার প্রক্রিয়া সমানভাবে কার্যকরী থাকে তাহলে clinical health-এর ক্ষেত্রে হারিয়ে যায় রোগির সাফারিং তথা ক্লিষ্টতা, আর public health-এর ক্ষেত্রে মেডিসিনের পরিবাহ বেয়ে structural violence-এর বিস্তৃত পটভূমি জন্ম নেয়।
মেডিসিনের মাঝে যে সরাসরি কোন হিংসা আছে তা কিন্তু একেবারেই নয়। কিন্তু যে বিযুক্তিকরণ আছে তা dehumanization বা অমানবীকরণের দিকে নিয়ে যায়। এ বিষয়টি যদি মেডিসিনের বোধে না থাকে তাহলে হিংসার বিভিন্ন রূপে তা প্রকাশ পেতে পারে – যেমন, কথা বলায় বা verbal, আমাদের হাবেভাবে বা attitudinal। এসব ক্ষেত্রে এক বিশেষ অবস্থার সৃষ্টি হয় – যেখানে রোগী একটি অবব্জেক্ট বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার বস্তু, অনিবার্যভাবেই ক্ষমতার ভরকেন্দ্র ঝুঁকে থাকে ডাক্তারের দিকে। এখানে একটি প্রশ্ন আসবে সমাজে যে মানুষটি person, মেডিসিনের দুনিয়ায় প্রবেশ করা মাত্র সে হয়ে ওঠে ব্যক্তি-সত্তারহিত (depersonalized) একজন রোগী। ১৯৮৩ সালে আমেরিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন-এর একটি জার্নালে (আর্কাইভস অফ ইন্টার্নাল মেডিসিন) এরিক ক্যাসেল একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লিখেছিলেন – “The Relief of Suffering”। এ প্রবন্ধে তিনি একজন ব্যক্তির যে চারিত্র্য সে বিষয়ে আলোকপাত করেছিলেন। তাঁর বয়ানে চারিত্র্যের চালচিত্রের “মাঝে রয়েছে ব্যক্তি সত্তা এবং চরিত্র; যাপিত অতীত; পরিবারের অতীত; পরিবার এবং অন্যদের সাথে সংযোগ ও সম্পর্ক; সংস্কৃতি এবং সমাজ; মানুষটির কর্মজীবন এবং সামাজিক ভূমিকা; বডি ইমেজ; অবচেতন মন; রাজনৈতিক সংযোগ, মানুষটির গোপন জীবন (যা প্রত্যেকের আছে হয় হয় বাস্তবে বা স্বপ্নচারিতায়); ভবিষ্যতের ভেবে নেওয়া চিত্র; এবং ব্যক্তির শ্রেষ্ঠতা ও আধ্যাত্মিকতার বিভিন্ন মাত্রা …”। আমরা সমগ্র আলোচনাটিকে অনুধাবন করার জন্য একথাগুলো স্মরণে রাখবো।
রোগাক্রান্ত হওয়া এমন একটা অবস্থা যা মানবসত্তার অনেককিছুকে তছনছ করে দেয়। ব্যক্তির সমগ্রতা বা নিজস্ব অস্তিত্বের কাঠামোকে ভেঙ্গেচুরে suffering বা ক্লিষ্টতার জন্ম দেয়। আবার, এই ক্লিষ্টতাকে বোঝার ও ধারণ করার ক্ষমতা আধুনিক মেডিসিনের কাঠামোর মধ্যে নেই। মেডিসিনে ব্যথা বা pain-কে পরিমাপ করার পদ্ধতি আছে, বোধগম্যতায় নিয়ে আসার পথ আছে, বোঝার ক্ষমতা আছে। কিন্তু suffering বা ক্লিষ্টতাকে ধারণ করার, বোঝার বা পরিমাপ করার ক্ষমতা আধুনিক মেডিসিনে নেই।
মেডিসিনের জগতে সবচেয়ে মান্য পুস্তক সুবিশাল Harrison’s Principles of Internal Medicine-এ (19th edn.) আধুনিক হাসপাতালের পরিবেশ সম্পর্কে লেখা হচ্ছে – “অধিকাংশ ব্যক্তি মানুষের কাছে হাসপাতাল একটি ভীতিপ্রদ পরিবেশ। হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগিরা দেখে তাদেরকে আবেষ্টন করে রয়েছে air jets, বিভিন্ন ধরনের বোতাম এবং উজ্জ্বল ঝকঝকে আলো। তারা বিভিন্ন ধরনের টিউব এবং তার দিয়ে আক্রান্ত, এবং ক্রমাগত মুখোমুখি হতে হচ্ছে একের পরে এক হেলথ কেয়ার টিমের সাথে। এদের মধ্যে চিকিৎসক, নার্স, ডায়েটিসিয়ান, নার্সের সহকারী, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা, সামাজিক কর্মীরা, টেকনোলজির লোকজন, ফিজিওথেরাপিস্ট, মেডিক্যাল ছাত্র-ছাত্রীরা, হাউস স্টাফেরা এবং আরও অনেকে রয়েছে।”(The hospital is an intimidating environment for most individuals. Hospitalized patients find themselves surrounded by air jets, buttons, and glaring lights; invaded by tubes and wires; and beset by the numerous members of the health care team – hospitalists, specialists, nurses, nurses’ aides, physician’s assistants, social workers, technologists, physical therapists, medical students, house officers, attending and consulting physicians, and many others.)
এর পরিণতি? এ পুস্তকে পরের অংশে বলা হচ্ছে – “It is little wonder that a patient’s sense of reality may be compromised.” হ্যারিসনের পুস্তকে যা “সেন্স অফ রিয়্যালিটি” তাই তো প্রকৃত অর্থে রোগীর persona বা ব্যক্তিময়তা। সেটাই হারিয়ে গেলো। সাথে মেডিসিনের তরফে হারিয়ে গেলো রোগির suffering-কে বোঝার ক্ষমতা ও চেতনা। রোগি যে নিজস্ব জগৎ হারিয়ে ফেলে হাসপাতালে এসে সেই হারিয়ে-ফেলা জগৎ এবং হাসপাতালের নৈর্ব্যক্তিক, কেস নম্বর দিয়ে সাজানো জগতের tenuous link হল একজন ডাক্তার এবং তার person বা ব্যক্তি মানুষটি।
বায়রন গুড তাঁর Medicine, rationality, and experience: An anthropological perspective গ্রন্থে দেখিয়েছেন কিভাবে হার্ভার্ড সহ বিভিন্ন মেডিক্যাল স্কুলে মেডিসিনের নতুন ল্যাংগোয়েজ বা ভাষার শিক্ষায় শুধু নতুন শব্দ শেখা হয়না “but the construction of a new world altogether”। একজন শিক্ষার্থীর দেখার “visual metaphor” রূপান্তরিত হয়ে যায়। অ্যানাটমির ক্লাসে ত্বক (যা এতদিন অনুভূতির অঙ্গ ছিল) কেবলমাত্র আরেকটি শিক্ষার সামগ্রী মাত্র। আলাদা করে কেটে, মাইক্রোস্কোপের নীচে ফেলে বোঝার অবজেক্ট হয়ে যায়। এরকম সংখ্যাতীত উদাহরণ দেওয়া যায়। কিন্তু মোদ্দা কথা হল, সবমিলিয়ে মেডিসিন শিক্ষা চিকিৎসককে যে বিপুল জ্ঞানসম্ভার দেয় তাতে রোগির নিজের দেহ ও অস্তিত্ব নিয়ে একধরনের হীনমন্যতাবোধ বা যাকে বলে epistemological hypochondria তার উন্মেষ ঘটে। এ তো প্রকৃত অর্থে ডাক্তার-রোগি সম্পর্কের ক্ষেত্রে অতি নমনীয় এবং সহনীয় হিংসারই আরেক শীলিত রূপ।
তিন দশক আগে আর্থার ক্লিনম্যান তাঁর Illness Narrative বইয়ে জানিয়েছিলেন যে চিকিৎসকদের শিক্ষাক্রমে এই বিশ্বাস জন্মানো হয় যে রোগ (disease) অসুস্থতার (illness) চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এর পরিণতিতে চিকিৎসকদের যে জ্ঞান প্রয়োজন সে জ্ঞান “about biology, not knowledge about the psychosocial and cultural aspects of illness.” আমরা নিশ্চয়ই অনুভব করতে পারবো যে অসুস্থ অবস্থা মানে জীবন একাধিক অর্থ (meaning) নিয়ে হাজির হয় একজন মানুষের কাছে। সমস্ত অর্থকে (meaning) আমরা যদি বায়োমেডিক্যাল মডেলের মধ্যে ধরার চেষ্টা করি তাহলে একটি সুবিশাল গহ্বর বা ফাঁক তৈরি হয়। একদিকে, বায়োমেডিক্যাল আরোগ্যের যে অবয়ব অর্থাৎ “dehumanized disease process” এবং, অন্যদিকে, বিভিন্ন উৎস থেকে একজন রোগি যে ভরসা এবং জীবনরস সংগ্রহ করে রোগাক্রান্ত জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তোলে, সে দুটির মাঝে। আমরা আরেকবার suffering এবং social suffering নিয়ে কথা বলার মতো অবস্থায় এলাম। কারণ মেডিসিনের কেন্দ্রে, প্রান্তে, পরিধিতে – যেদিকেই তাকাইনা কেন রয়েছে মানুষ, তার সমস্ত আকাঙ্খা, অপ্রাপ্তি, চাহিদা এবং স্তরায়িত অসাম্য এবং সামাজিক বিভাজন নিয়ে। ২০০৭ সালে ক্লিনম্যান একটি লেকচারে খুব প্রাঞ্জলভাবে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছিলেন – “সোশ্যাল সাফারিং (সামাজিক ক্লিষ্টতা) হল একটি পরিভাষা যা ব্যবহার করা হয় সামাজিক এবং স্বাস্থ্যনীতির ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের মধ্যেকার বাধা ভেঙ্গে ফেলার জন্য। ব্যবহার করা হয় আমাদের যুগে স্বাস্থ্য এবং মেডিসিনের সাথে যুক্ত আরও অনেক বৃহত্তর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তনগুলোকে চিত্রিত করার জন্য। এই পরিবর্তনগুলো ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে প্রভেদ এবং অসাম্য বাড়িয়ে তুলছে। এর ফলে emerging infectious diseases সংখ্যায় বাড়ছে, সামাজিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা আরও খারাপ করেছে, এবং একই সাথে স্বাস্থ্য পরিষেবাকে ঝাঁকিয়ে দিয়েছে এবং স্বাস্থ্যখাতে ব্যয়ের বিষয়টি নাড়িয়ে দিয়েছে। সোশ্যাল সাফারিং ভিন্ন ভিন্ন জনসমষ্টির মধ্যে বিদ্যমান দারিদ্র্য এবং স্বাস্থ্যের অসাম্যের বিষয়গুলোতে জোর দেয়। এটা এদিকেও নজর আকর্ষণ করে যে কিছু সমস্যা বাস্তবে অধিকতর খারাপ চেহারা নেয় সামাজিক এবং স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নীতির ভ্রান্তির জন্য।”
ক্রমশঃ
অসামান্য ।
কঠিন সত্য। শিক্ষার অভাব, অর্থনৈতিক অসাম্য এবং ক্ষমতাশালীদের প্রতাপের নীট ফল চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীদের ওপর ক্রমাগত আক্রমণ।
এতে ইন্ধন যোগায় সরকারী হাসপাতালে নিয়োগের অভাব এবং বেসরকারী হাসপাতালের বাণিজ্য বুদ্ধি।
দারুণ চিত্র এঁকেছেন ডঃ জয়ন্ত ভট্টাচার্য।
নমস্কার আপনাকে।
ঠিক বিশ্লেষণ। জনসাধারণের জানা দরকার
একদম সঠিক বিশ্লেষণ। সমৃদ্ধ হলাম