দিন কয়েক আগের ঘটনা। আমাদের নিউরোসার্জারি আউটডোরে এমনিতেই ভীড় থাকে।ইমার্জেন্সি অপারেশনের জন্য অনেক সময় কোন দিন রোগী দেখা স্থগিত রাখতে হলে, পরের দিনের আউটডোরে চাপ বেড়ে যায়। আর রোগীদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক রাখতে গিয়ে সেই দিন আমাদের আউটডোরের সেক্রেটারি অরূপের গলদঘর্ম অবস্থা হয়।
গত শনিবার ছিল সেই রকমই একটা দিন।
সকালে হাসপাতালের নিয়মমাফিক ওয়ার্ড রাউন্ড শেষে আমরা আউটডোরে ঢুকছি তখন।
“স্যার, আজকে একটু চালিয়ে খেলবেন, প্রচুর ভিড় হয়ে গেছে অলরেডি….!” অরূপের সনির্বন্ধ অনুরোধ।
মাস্কের আড়ালে হালকা হাসির আভাস রেখে দরজা ঠেলে ঢুকে পড়লাম আউটডোরে। আগের দিনের ক্যানসেল হওয়া আউটডোরের লিস্টে থাকা রোগীরা চাপে ফেলেছে বেচারিকে, একটুকু বেশ বোঝা গেল।
“আমার নাম সানাউল হক……., প্রফেসর সানাউল লিখবেন!” টাক মাথা এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক।
আমাদের আজকের প্রথম রোগী। একটু যেন স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি রকম অস্থির।
“বলুন কি হয়েছে আপনার? মানে অসুবিধাটা কি?”
“ডাক্তারবাবু আজ প্রায় সতের দিন হতে চলল আমার মাথায় ব্যথা আর তার সাথে ঘনঘন ঘাম হচ্ছে। হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম কয়েক দিন। সেখানে সঠিক চিকিৎসা না পেয়ে আপনাদের কাছে এসেছি। বেশ কয়েক বছর আগে আপনাদের কাছে এসেছিলাম অন্য চিকিৎসার কারণে। সম্পূর্ণ সুস্থ করে দিয়েছিলেন আপনারা।” ভদ্রলোক কথা বলতে বলতে উঠে দাঁড়াচ্ছেন বারবার। প্রায়শই হাত দিয়ে মাস্ক নামিয়ে আনছেন থুতনির নিচে।
আমি কিছু বলবার আগেই সাথে আসা তুলনায় কম বয়সী একজন ভদ্রলোক, সম্ভবত ভ্রাতৃ স্থানীয়, যোগ করলেন, “ডাক্তারবাবু দাদার কিছুদিন আগে জ্বর হয় আর তার সাথে শ্বাসকষ্ট। আমরা উনাকে হাসপাতালে ভর্তি করে দিই। রক্ত পরীক্ষা, বুকের সিটি স্ক্যান, কোভিড পরীক্ষা সবই হয়।
চিকিৎসাও চলে। এখন জ্বরটা কমেছে, কিন্তু শ্বাসকষ্ট আর মাথা ব্যথাটা রয়ে গিয়েছে। উনার কোভিড রিপোর্ট নেগেটিভ হওয়াতে হাসপাতাল ওষুধ-পত্র দিয়ে ছুটি করে দিয়েছে। মাথা ব্যথা কমছে না বলে আপনাদের কাছে নিয়ে এসেছি।”
আমরা বুকের সিটিস্ক্যানটা দেখতে চাইলাম।
ফুসফুসের প্রায় সর্বত্র সাদা ছোপ ছোপ দাগ (ground glass opacities)। একদম সুস্পষ্ট কোভিডের পদচিহ্ন।
“সানাউল সাহেব, আপনার রিপোর্ট যতই নেগেটিভ বলুক, বুকের সিটি স্ক্যান অন্য কথা বলছে।
আপনার কোভিড হয়েছে। এক্ষুনি আমাদের কোভিড ডাক্তারবাবুদের সাথে যোগাযোগ করুন।
আমরা লিখে দিচ্ছি।”
“আর মাস্কটা একদম মুখ থেকে নামাবেন না।
আপনার যদি কোভিড নাও হয়ে থাকে, এই হাসপাতলে কিন্তু অনেক কোভিড রোগী আছেন। সেখান থেকে আপনার শরীরে ঢুকে পড়তে পারে ভাইরাস ।” বাধ্য হলাম একটু ভয় দেখাতে।
সানাউল ভর্তি হলেন হাসপাতলে। সন্ধ্যাবেলা খবর পেলাম উনার কোভিড রিপোর্ট পজেটিভ এসেছে।
তার মানে আগের রিপোর্টটা ফলস নেগেটিভ ছিল।
আর হয়তো সেই কারণেই এই রোগীকে রেমডেসিভির ইনজেকশন দেওয়া যায়নি।
কোভিড রিপোর্ট নেগেটিভ হলে খুব সম্ভবত রেমডেসিভির পাওয়া যাচ্ছে না। একজন ক্রিটিক্যাল কেয়ারের ডাক্তারবাবুর মুখে শুনলাম।
সমস্যা হচ্ছে এর ফলে রোগীর ক্ষতি তো হচ্ছেই, আর তার সাথে সংক্রমিত হচ্ছেন তার চারপাশে থাকা মানুষেরা।
আসলে মহামারী বস্তুটাই এইরকম। সব হিসেব গুলিয়ে দিচ্ছে। প্রত্যেকদিন যেমনভাবে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে তার সাথে পাল্লা দিয়ে কমছে বেড, অক্সিজেন আর জীবনদায়ী ওষুধের পরিমাণ।
প্রত্যেকদিনই পাচ্ছি গুচ্ছের মেসেজ। কোথাও একটা ভর্তি করিয়ে দেওয়ার জন্য। এমনই বেডের হাহাকার।
তার সাথে যোগ হয়েছে ভ্যাকসিনের আকাল। হাসপাতালে ভিড়ে থিক থিক করছে মানুষ।
লাইন পেরিয়ে যাচ্ছে হাসপাতালের গেট।
তাও সবাই ইনজেকশন পাবে কিনা কেউ জানে না।
এই সময় যে আসতে চলেছে, তার জন্য কিন্তু আগাম সাবধানতা জানানো হয়েছিল। চিকিৎসা বিজ্ঞানী তথা চিকিৎসকেরা বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন শতাব্দীপ্রাচীন ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ র দ্বিতীয় ওয়েভের মারাত্মক হয়ে ওঠার কাহিনী। সরকারকে জানানো হয়েছিল কিভাবে প্রস্তুতি নেওয়া যেতে পারে আচমকা এসে পড়া খারাপ সময়ের জন্য।
কিন্তু সাধারন মানুষ বা সরকার কেউই কর্ণপাত করেননি।
রাস্তায় মাস্ক হীন ঘুরে বেড়ানো মানুষজন বুঝে গিয়েছিলেন করোনা আর যাই হোক ভারতবর্ষের কিছু ক্ষতি করতে পারবে না। ভাইরাসের চেয়ে ডাক্তাররা এটা অনেক বেশি ছড়াচ্ছেন। ব্যক্তিগত ফায়দার জন্য।
অনেকে আবার কোভিড রোগটা কে পুরোপুরি ‘জাল’ আখ্যা দিতে চেয়েছিলেন।
সরকার বুঝে গিয়েছিলেন ডাক্তাররা যতই চিৎকার করুক, স্বাস্থ্য পরিকাঠামো উন্নত করার সেইরকম খুব একটা প্রয়োজন নেই, অথবা অন্য কোন খাতে ব্যয় করাটা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই পরিকাঠামোতেই যখন প্রথম ওয়েভ কাটিয়ে দেওয়া গিয়েছে, দ্বিতীয়টাও নিশ্চিত সামলানো যাবে।
কিন্তু যদি দূরদৃষ্টি থাকতো তাহলে ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কমতে থাকা কেসের মধ্যেই
আমরা প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরিকাঠামো, যেমন বেড, অক্সিজেন, ওষুধ পত্রের বন্দোবস্ত করে ফেলতে পারতাম। বাড়িয়ে ফেলতে পারতাম ভ্যাকসিন তৈরীর ক্ষমতা।
সানাউল হককেও আর হাসপাতাল হাসপাতালে ঘুরে বেড়াতে হতো না।
তবুও সরকার কিন্তু ভ্যাকসিনের বন্দোবস্ত করেছিলেন। আমরা প্রথমে দেখেছি মানুষের ভ্যাকসিন নেওয়ার পিছনে অনীহা। বারবার ডাক্তারদের বোঝানোর পরেও প্রচুর মানুষ প্রশ্ন করেছেন, ভ্যাকসিন এর কার্যকারিতা, পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নিয়ে। অনেকেই বলেছেন এই ভ্যাকসিন নাকি এসেছে ডাক্তার এবং ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলির মুনাফা বাড়ানোর জন্য।
যথেষ্ট মানুষ না হওয়ায়, অনেক দিনই ভ্যাকসিন ফেরত পাঠাতে হয়েছে।
অদৃষ্টের এমন পরিহাস, এই মানুষগুলোই এখন ভ্যাকসিনের লাইনে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। আর ভ্যাকসিন সহজলভ্য না হওয়ার জন্য গালাগাল দিচ্ছেন সরকারকে।
দেরিতে হলেও সরকার নড়েচড়ে বসেছেন। ১৮ বছরের উপরে সবার জন্য টিকাকরণ ঘোষিত হয়েছে। প্রচুর মাত্রায় ভ্যাকসিন তৈরি করার বরাত গিয়েছে সংস্থাগুলির কাছে।
মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই খুব সম্ভবত এসে পড়ছে রাশিয়ান ভ্যাকসিন ‘স্পুটনিক’। এরপরেও আরো কিছু টিকা পাইপলাইনে যোগ হবে আশা করা যায়।
অন্য দিকে, এই মুহুর্তে ভারতবর্ষে ঝড়ের মতো বয়ে চলা এই দ্বিতীয় ওয়েভের জন্য দায়ী করা হচ্ছে কোভিডের ডাবল মিউটেশনকে। B.1.617 হচ্ছে সেই মিউটেটেড ভাইরাসের বিজ্ঞানসম্মত নাম।
দেহের দু’জায়গায় জিনগত পরিবর্তন করে, সেই জীবাণু বাড়িয়েছে সংক্রমণ করার ক্ষমতা। করোনা রোগ থেকে সেরে ওঠা রোগীর অথবা ভ্যাকসিনের জন্য শরীরে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডিকে এড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রয়েছে এই ভাইরাসের। তবে এখনো পর্যন্ত এর মারণ ক্ষমতা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়নি।
তবে ICMR এর সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণ বলছে প্রথম ওয়েভের তুলনায় দ্বিতীয়তে এখনো পর্যন্ত মারণহার বাড়েনি। বাড়েনি ভেন্টিলেটরের প্রয়োজনও। তবে কাশি, জ্বরের তুলনায় বেড়েছে শ্বাসকষ্ট। প্রয়োজন বেড়েছে অক্সিজেনের। এখনো পর্যন্ত বয়সভিত্তিক সংক্রমণের হারও একইরকম।
আর প্রথম বারের মতোই বয়স্কদের ক্ষেত্রেই বাড়াবাড়ি করছে ভাইরাস।
তবে শুধু ভারতেই নয় বাইরের আরও দশটি দেশে আবিষ্কৃত হয়েছে এই ভাইরাসের অস্তিত্ব। এবারে দেশের সংক্রমণের সংখ্যার প্রায় অর্ধেক দখল করে নিয়েছে এই মিউট্যান্ট।
চুম্বকে এই হলো নব্য কোভিডের কাহিনী।
তাই যুদ্ধকালীন তৎপরতায় যেমন স্বাস্থ্য পরিষেবাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে বাঁচাতে হবে মানুষের প্রাণ, ঠিক তেমনটাই দৈনিক ভ্যাকসিনেসনের মাত্রা বাড়িয়ে আটকাতে হবে ভাইরাসের অগ্রগতি।
যদি উন্নত পৃথিবীর দিকে তাকান, দেখতে পাবেন মার্কিন আর ইংরেজরা কিভাবে দ্রুত ভ্যাকসিনেসনের মাধ্যমে প্রতিরোধ করে ফেলেছে ভাইরাসের দ্বিতীয় তরঙ্গাভিঘাত। ঝপ করে কমে গেছে ঢেউ এর উচ্ছ্বাস। শান্ত হয়েছে সমুদ্র।
তাই আমাদেরও প্রয়োজন দেশের এই খারাপ সময়ে সরকারের পাশে থাকা। সমালোচনার সময় পরে অনেক পাওয়া যাবে।
আর ভ্যাকসিন নিয়ে দোলাচলে ভোগা মানুষদের উদ্দেশ্যে একটাই কথা বলার, নিজের জন্য না নিলেও পরিবার আর আত্মীয়স্বজনের কথা ভেবে নিয়ে ফেলুন। বেঁচে থাকলে অনেক তর্ক করা যাবে।
ভালো থাকুন সকলে। সামনের একটা মাস দেশ এবং জাতির জন্য খুব কঠিন হতে চলেছে।
সাবধানে থাকুন। মাস্ক ছাড়বেন না বাড়ির বাইরে বেরুলে। খুব প্রয়োজন না পড়লে বাড়ি থেকে না বেরোনোই ভালো।
আবার দেখা হবে অন্য কোন লেখা নিয়ে। অন্য কোন দিন।