দেশে এবং রাজ্যে কোভিড পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর। দেশে দৈনিক আক্রান্ত তিন লক্ষেরও বেশী। রাজ্যে প্রায় বারো হাজার। সরকারি হিসেবেই রাজ্যে রোজ মারা যাচ্ছেন পঞ্চাশের বেশী। মৃত্যুর সংখ্যায় কোমর্বিডিটি তত্ত্বের প্রলেপ লাগানো এখনও সেভাবে শুরু হয়নি – আপাতত ভোট নিয়ে সবাই ব্যস্ত। সরকারি কোমর্বিডিটির তত্ত্ব যেরকম, ক্যানসার-আক্রান্ত রোগী কেমোথেরাপি নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে রাস্তায় গাড়ি চাপা পড়ে মারা গেলে দুর্ঘটনাকে মৃত্যুর কারণ না বলে ক্যানসারকেও ধরা যায় – কে বলতে পারে, মৃত ব্যক্তি হয়ত কেমো নেওয়ার পর দুর্বলতার কারণেই গাড়ির হর্ন ঠিকসময় শুনতে পাননি। প্রসঙ্গটা তুলতেই হল, কেননা খবরের কাগজে এরাজ্যে মোট কোভিড-মৃত্যুর যে সরকারি খতিয়ান প্রকাশিত হয়, তার আশি শতাংশের বেশীই নাকি কোমর্বিডিটি-জনিত।
কোভিড-পরিস্থিতি যেভাবে উত্তরোত্তর জটিলতর হয়ে উঠছে, দুদিন আগেও যাঁরা কোভিড ব্যাপারটাকেই রাষ্ট্রীয় চক্রান্ত বা গুজব বলে উড়িয়ে দিচ্ছিলেন, আপাতত তাঁরাও কিছুটা থমকে গিয়েছেন। আক্রান্ত বা মৃতের সংখ্যার চাইতেও হাসপাতালে বেডের জন্যে হাহাকার-টা আতঙ্কের। পরিচিতজনের মধ্যে কেউ না কেউ কোভিডে মারা গিয়ে প্লাস্টিক ব্যাগে শেষযাত্রা করেছেন, এ দুঃসহ অভিজ্ঞতা সকলের না থাকলেও এই দফায় হাসপাতালে ভর্তির সঙ্কটের অভিজ্ঞতা প্রত্যক্ষে-পরোক্ষে অনেকেরই – এবং এ তো সবে সঙ্কটের শুরু।
দায় কার, সে আলোচনা বা দোষারোপের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, এখন কী করণীয়? তিক্ত বাস্তব হল, গত একবছরের অভিজ্ঞতা আমাদের যথেষ্ট শিক্ষা দিতে পারেনি। যদি পারত, তাহলে বুঝতাম, কাজ মূলত তিনটে–
১. জরুরি ভিত্তিতে পরিকাঠামোর উন্নতি। কাজটি রাতারাতি হওয়ার নয়। গত মাসছয়েক ধরে কোভিড ব্যাপারটাকে ভুলে না থাকলে অনেকটা কাজ এগিয়ে রাখা যেত। সেসব কিছুই হয়নি। লোহার খাট বিছানা, পাশে স্যালাইনের বোতল ঝোলানোর স্ট্যান্ড দিলেই কোভিড-চিকিৎসার উপযুক্ত শয্যা হয় না। অন্তত অক্সিজেনের ব্যবস্থাটুকু জরুরি। দেশের অপরিণামদর্শী সরকার গতবছর প্রায় দশহাজার টন অক্সিজেন বিদেশে রফতানি করেছেন, গত এক বছরে এই রফতানি বেড়েছে আগের তুলনায় কয়েকগুণ – এখন সর্বত্র অক্সিজেনের জন্য হাহাকার – এরাজ্যেও এখুনি সমস্যা তৈরি না হলেও, পরিস্থিতি এরকম চলতে থাকলে সঙ্কট অনিবার্য। এমতাবস্থায় নতুন করে হাজারটা কোভিড-বেডের গল্প নিষ্ঠুর রসিকতার মতো শোনায়।
পরিকাঠামোর অন্যতম অঙ্গ মানবসম্পদ। এদেশে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মী যে প্রয়োজনের অনুপাতে অপ্রতুল, একথা সকলেই জানেন। সঙ্কটকালে সীমিত সম্পদের সঠিক ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ। গতবছর কোভিডের শুরুতেই বড়মাপের সঙ্কট তৈরি হয়েছিল স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক হারে সংক্রমণ ছড়ানোর কারণে – সীমিত সংখ্যক চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের সবাইকে যদি একইসাথে ডিউটি করানো হয়, এমনটি অবশ্যম্ভাবী। শুরুর সঙ্কট থেকে শিক্ষা নিয়ে পরবর্তীতে ভাগ করে ডিউটি করানো হয়েছিল – বড় অংশের স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়ে হাসপাতাল বন্ধ হওয়ার উপক্রম আর হয়নি। এদফায় সরকারি অফিসে পঞ্চাশ শতাংশ কর্মীর উপস্থিতির নির্দেশিকা জারি হলেও সরকারি স্বাস্থ্যক্ষেত্রে আবারও সবাইকে একইসাথে ডিউটি করানো চলছে – বড় সঙ্কট অনিবার্য (দিল্লিতে সেই সঙ্কট শুরুও হয়েছে)। স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রায় সবাই টিকা নিয়েছেন, ঠিকই। এর ফলে টিকাপ্রাপ্ত কর্মীর গুরুতর অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা কমবে অবশ্যই – কিন্তু তিনি সংক্রামিত হতেই পারেন, অপরের মধ্যেও সংক্রমণ ছড়াতে পারেন – সংক্রামিত হলে দুসপ্তাহের আইসোলেশন তাঁর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। একইসাথে একই বিভাগের একাধিক চিকিৎসক সংক্রামিত হলে পরিষেবায় ঘাটতি অবশ্যম্ভাবী।
এর সাথে আরেক সমস্যা, এই দফার সংক্রমণে, বেশ কিছু ক্ষেত্রে, টেস্টের রিপোর্ট পজিটিভ আসতে চাইছে না। উপসর্গ রয়েছে – ফুসফুসের সিটি স্ক্যানে অসুখের ছাপ স্পষ্ট – কিন্তু আরটি-পিসিআর নেগেটিভ। এর কারণ বিভিন্ন হতে পারে। একটি সম্ভাব্য কারণ, আগের মতো করে এই দফায় ভাইরাস প্রাথমিকভাবে আর গলায় বাসা বাঁধছে না – কাজেই, সেখান থেকে নমুনা সংগ্রহ করে সুবিধে হচ্ছে না। কারণ যা-ই হোক, এই সমস্যা আরো বড় সমস্যা তৈরি করছে। টেস্টের রিপোর্ট পজিটিভ আসা অব্দি সেই রোগিকে কোভিড প্রোটোকল মেনে আলাদা করা হচ্ছে না – চিকিৎসাও সেই অনুসারে করা সম্ভব হচ্ছে না – তাঁর থেকে সংক্রামিত হতে পারছেন আরো বেশ কিছু মানুষ। আক্রান্তের চিকিৎসার ক্ষেত্রেও ওষুধ পাওয়া নিয়ে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে – কোনো সরকারই সেভাবে কিছু কাজের কাজ করে উঠতে পারছেন না।
২. জনসচেতনতা – কুম্ভমেলার কথা নাহয় ছেড়েই দিলাম। এরাজ্যে বাজারে-দোকানে, জনসভায় যেভাবে মাস্কহীন জনগণ ভিড় জমিয়েছেন, মাস্ক পরার কথা বললে যেভাবে তির্যক উত্তর দিয়েছেন, তারপর সচেতনতার আশা না করাই ভালো। শুধু সরকারকে দায়ী করে, অন্তত এক্ষেত্রে লাভ নেই। নেতামন্ত্রীরাও নিজেরা সুরক্ষাবিধি পালন করে জনসমাজে সদর্থক কিছু বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেননি – অবশ্য তাঁদের কাছ থেকে অতখানি দায়িত্ববোধ বা কাণ্ডজ্ঞান আশা করা মুশকিল। তদুপরি একশ্রেণির বিজ্ঞ কোভিডের বিপদকে লঘু করে দেখিয়ে, সুরক্ষাবিধিকে বারবার গুরুত্বহীন বলে বিপদ গভীরতর করেছেন। সব দেখেশুনে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরাও তিতিবিরক্ত। আমজনতা সাধারণ সুরক্ষাবিধিটুকু মানবেন না, কিন্তু সংক্রামক অতিমারির মুহূর্তে বাড়তি ঝুঁকির ঝামেলা সামলাতে হবে স্বাস্থ্যকর্মীদেরই। নিজেরা টিকা পেলেও অনেকেরই সন্তানরা টিকা পাওয়ার বয়সে পৌঁছায়নি এবং এদফার সংক্রমণ বাচ্চাদেরও ছাড়ছে না, কাজেই হাসপাতাল থেকে বাড়িতে বিপদ বয়ে আনার আশঙ্কা স্বাভাবিক। অপরদিকে সরকারবাহাদুর চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের বা তাঁদের পরিজনের সুরক্ষার ব্যাপারে বাড়তি যত্নবান, এমন প্রমাণ নেই।
এরমধ্যেও সুরক্ষাবিধি যথাসাধ্য মেনে যাঁরা চলেছেন, তাঁরা নতুন করে সংশয়ে – কোভিড নাকি বায়ুবাহিত – তাহলে বর্তমান সুরক্ষাবিধি কি সেক্ষেত্রে অকার্যকরী? আশ্বস্ত করা যাক, বায়ুবাহিত হোক বা না হোক, ড্রপলেটের মাধ্যমে ভাইরাস ছড়ানো বন্ধ হয়নি। বায়ুবাহিত হওয়ার অর্থ ড্রপলেটের মাপটি পূর্বানুমানের তুলনায় ছোট, বাতাসে সেই ড্রপলেট মিশবেও সহজে, সংক্রামিতের হাঁচি-কাশি না হলেও ভাইরাস পার্টিকল বাতাসে মিশতে পারে, সাধারণ শ্বাসপ্রশ্বাসের মুহূর্তেও ভাইরাস পারিপার্শ্বিকে মিশে যেতে পারে, পার্টিকল বাতাসে থাকবেও দীর্ঘক্ষণ – কাজেই মাস্ক পরুন, পুরোপুরি না হলেও অনেকখানি সুরক্ষা মিলবে। বায়ুবাহিত হওয়ার অর্থ এই নয় যে জানলা খোলা রাখলে দখিনা বাতাস এসে আপনাকে কোভিড দিয়ে যাবে – কিম্বা সন্ধেবেলার মশার মতো করে জানলা দিয়ে করোনাভাইরাস উড়ে আসবে। বদ্ধ জায়গায়, এসি ঘরে বেশী লোক জড়ো হলে বিপদ। খোলামেলা জায়গায় বিপদ তুলনামূলক কম, গাদাগাদি ভিড় হলে বিপদ বেশী। বায়ুবাহিত হলে, সেন্ট্রালি এসি বিল্ডিং-এ একটি ঘরে কোভিড-পজিটিভ কেউ থাকলে তাঁর থেকে অন্য ঘরের মানুষও আক্রান্ত হতে পারেন। পার্টিকল-এর সাইজ আরো ছোট, মাস্ক পরার ব্যাপারে আরো সচেতন ও নিখুঁত হতে হবে। বাতাসে পার্টিকলের ঘনত্ব দূরত্বের সাথে ব্যস্তানুপাতিক হারে কমবে, অতএব দূরত্ব বজায় রাখা, আঁটোসাটো মাস্ক পরা, বন্ধ বাতানুকূল ঘরে একত্রে হইহই এড়ানো, অরক্ষিত হাত বারবার নাকে-মুখে না দেওয়া, এসব সাধারণ সুরক্ষাবিধি মেনে চলা জরুরি।
৩. গণ টিকাকরণ – বর্তমান পরিস্থিতিতে টিকার গুরুত্ব অনস্বীকার্য, অথচ টিকা নিয়ে প্রবল সংশয়। চিকিৎসা গবেষণার সিংহভাগ কর্পোরেটের নিয়ন্ত্রণে, বহুজাতিক কর্পোরেট মানবকল্যাণের চাইতে মুনাফা নিয়ে বেশী ভাবিত, যেকোনো সঙ্কট মুনাফার নতুনতর সুযোগ – এসবই সত্যি। তারপরও টিকার গুরুত্ব কমে না। টিকার কার্যকারিতা বিষয়ে এখনও অব্দি যেটুকু খবর পাওয়া গিয়েছে, তাতে এটুকু স্পষ্ট – টিকার দুটি ডোজ যাঁরা নিয়মমাফিক পেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে গুরুতর কোভিড বা কোভিডে মৃত্যুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কম – যাঁদের প্রথম ডোজের পর অন্তত দু’সপ্তাহ পার হয়েছে, অনেকখানি সুরক্ষা পেয়েছেন তাঁরাও। এবং যেহেতু প্রথমদফায় টিকা কেবলমাত্র বয়স্ক এবং কোমর্বিডিটি-যুক্ত মানুষেরাই পেয়েছেন, সেক্ষেত্রে এই গুরুতর অসুস্থতা ও মৃত্যুহারের হ্রাসের তথ্য বাড়তি স্বস্তি দেয়। কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ে ভাইরাসের সংক্রমণক্ষমতা বেশী। ভাইরাসের মারণশক্তি হ্রাস পাক বা না পাক, বিপুলসংখ্যক মানুষ সংক্রামিত হলে নড়বড়ে পরিকাঠামোয় মৃত্যুহারের বৃদ্ধি অনিবার্য। এমতাবস্থায়, এমনকি আংশিক কার্যকরী টিকাও সংকট থেকে উদ্ধার করতে পারে – এবং টিকা সবাইকে বিনেপয়সায় না দেওয়া হলে সার্বিক টিকাকরণের লক্ষ্যপূরণ হওয়া মুশকিল। বিপদের দিনে, বিপদ ভুলে টিকার ট্রায়ালের পদ্ধতিগত ত্রুটি নিয়ে যাঁরা গভীর আলোচনায় যাঁরা বসেছেন, তাঁদের উদ্দেশ্যের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলি, আপাতত সঙ্কট থেকে উদ্ধার পাওয়াটাই অগ্রাধিকার হোক।
কোভিড কোনো গুজব নয় – এক মস্তবড় বিপদ। তত্ত্বকথায় মুখ গুঁজে পরিত্রাণ মিলবে না। কোভিড-পরিস্থিতি নিয়ে, রাষ্ট্রীয় স্তরে তার মোকাবিলার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে, টিকার রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ে প্রচুর প্রশ্নের অবকাশ রয়েছে। কিন্তু, সঙ্কটমুহূর্তে সে আলোচনার চাইতে জরুরি আশু সুরাহার পথ খোঁজা। আপাতত সঙ্কট থেকে উদ্ধারের রাস্তা উপরের তিনটিই। বিপদ কাটিয়ে ওঠার পরে, আরেকটু সুস্থির সময়ে, নাহয় অন্যান্য বিষয়ও আলোচনার পরিসরে আনা যাবে।