রাজনৈতিক ছুঁৎমার্গ ও ডাক্তারসমাজ- ধাঁধার চেয়েও জটিল তুমি, খুনির চেয়েও নিষ্ঠুর।
ভারতীয় রাজনীতি তার ঘোলা জলের আবর্তে পাক খেয়ে খেয়ে বয়ে চলেছে এক অদ্ভুত জটিল সাম্প্রদায়িক মহাসমুদ্রে। না, এটা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার সমুদ্র নয়। তার থেকেও কঠিন, নিষ্ঠুর এক সমুদ্র। এটাতে ধর্ম আছে, জাতপাত আছে, ক্ষমতালিপ্সা আছে, অদ্ভুত এক অন্ধ আনুগত্যময় ফ্যাসিস্ট মনোবৃত্তি আছে, পরমত অসহিষ্ণুতা আছে, খুন, সম্পদ লুন্ঠন সব আছে।
উদাহরণ হিসেবে আমরা ডাক্তার রাজনীতিকে সামনে রাখবো। এটাকে ভিত্তি ধরে’ বৃহত্তর পটভূমিকায় ভারতের রাজনীতির কথা বিচার করবো।
এর ফলে আগের থেকেও তীব্র প্রতিঘৃণায় আমি দগ্ধ হবো। কেননা কেউ আমাকে বলবে প্রতিবিপ্লবী, কেউ বলবে অতিবিপ্লবী, কেউ শুধুই বিধর্মী বানাবে বা কেউ বানাবে বুল’স আই।
ডাক্তারদের আইএমএ ছাড়া প্রথমে ঠিক কোনও রাজনৈতিক মঞ্চ ছিলো না। কংগ্রেস আমলে কংগ্রেস প্রভাবিত কিন্তু জরুরী অবস্থায় সরকার বিরোধী বন্ধ ডাকতে কোনও নেতা বাধা দেয়নি।
ভারতেও ইংরেজ আসার আগে ভারতবর্ষে কোনও রাজনৈতিক মঞ্চ ছিলো না। ইংরেজ আসার পর তৈরি হলো, প্রথমে জাতীয় কংগ্রেস তারপর নানা বিপ্লবী দল। জালিয়ান ওয়ালা বাগের গণহত্যার পরে কোনও কংগ্রেস নেতা গণহত্যার প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পঞ্জাব যেতে রাজি হ’ন নি। ফলতঃ রবীন্দ্রনাথ নাইটহুড ত্যাগ করলেন। রবীন্দ্রনাথ কোনও বিপ্লবী নেতা ছিলেন না, একজন রোমান্টিক, সচেতন মানুষ ছিলেন, কবি ছিলেন। উনি সবাইকার স্বদেশী কাপড় পরার বাস্তব দিকটা ভাবেন নি।আদৌ এতো স্বদেশী, তাঁতে বোনা কাপড় তৈরি হয় কিনা ভাবেন নি, পরোক্ষে সারাভাই আর বিড়লাদের কাপড়ের ব্যবসা বাড়াতে সাহায্য করেন। সব কবির মতোই আবেগতাড়িত দেশপ্রেমিক মানুষ ছিলেন।
জরুরী অবস্থায় ডাক্তারদের রাজনৈতিক মঞ্চ তৈরি হতে থাকে।বামপন্থীদের একটু হলেও পা রাখার,জায়গা তৈরি হয় (জরুরী অবস্থা ১৯৭৫, বামফ্রন্ট ১৯৭৭)। চিরকালই ডাক্তাররা মূলতঃ স্বার্থান্বেষী। অন্য সব ইউনিয়নের মতো নিজের স্বার্থের জন্যই আন্দোলন করেছে। তাতে যে কালিদাসীয় ভাবে নিজেদের ঐতিহাসিক স্বার্থ ও ভাবমূর্তি ছিন্নভিন্ন হচ্ছে, সেটা মাথায় রাখে নি। না, আমরা মানবসেবা ইত্যাদি নিয়ে কথা বলবো না। কেবল গোষ্ঠিস্বার্থ ক্ষুন্ন হওয়ার আলোচনা করবো। তবে সেটা সব ইউনিয়নের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। যে এই লক্ষ্যবিহীন স্রোতের ধারায় ভাসবে, সে’ই অবশেষে নোংরামির কাদামাখা নর্দমায় পৌঁছবে।
এরপর পশ্চিমবঙ্গে এলো বামক্ষমতার রমরমা (১৯৭৭)। কিন্তু অতি অল্প মাইনেতে ডাক্তার পেষাই রইলো অব্যাহত। আরম্ভ হলো সব জুনিয়র ডাক্তারের এক মিলিত প্রতিরোধ। দলমত নির্বিশেষে। তাতে তৎকালীন ক্ষমতাসীন বাম সরকার ভয়ানক অসুবিধেয় পড়লো। সরকারের পদলেহী তথাকথিত বামডাক্তাররা “সহজে চাকরি পাও” পদ্ধতিতে চাকরির লোভে, আন্দোলন ভেঙে চাকরিতে যোগ দিলো। ডাক্তার আন্দোলন থেমে গেলো। বা সরকার বিরোধী আন্দোলনের মুখে আগুন দেওয়া হলো।বামপন্থী(?) ডাক্তাররা হয়ে উঠলো ডাক্তারদের দন্ডমুন্ডুর (শ্লীল বা অশ্লীল যে অর্থেই ধরুন) কর্তা বা মালিক, খোদাবন্দ। সবাই স্বার্থ বাঁচাতে অগত্যা বামপন্থী হলো।
জরুরী অবস্থায় গোটা ভারতের রাজনৈতিক সমীকরণ বদলে গেছিলো। ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষার জন্য জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে শুরু হয়েছিলো জনতা পার্টির লড়াই। বামপন্থীরা এই তীব্র কংগ্রেস বিরোধী আন্দোলনে জনতা পার্টিকে সমর্থন করলো। কিন্তু ঠিকমতো আসন রফা না হওয়ায় পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীরা একা লড়ে’ একটা স্বতন্ত্র শক্তি হিসেবে উৎপাদিত হলো।প্রত্যেকেই চেয়েছিলো বেশী আসন=বেশী ক্ষমতা। এই জনতা পার্টি, যার সঙ্গে বামেদের আসন রফা হলো না, পরবর্তীতে পরিবর্তিত হলো তীব্র হিন্দুত্ববাদী ভার্তীয় জন্তা পার্টিতে (হিন্দু শব্দটা এসেছে হরপ্পান ভাষায় ‘সিন্ধু’ থেকে।ওদের ভাষায় ‘স’ বর্ণটি ছিলো না)। এখন বামপন্থীরা, মুছে যাওয়া দিনগুলি আমায় যে পিছু ডাকে গানটির মতো, তৎকালীন স্বৈরাচারী কংগ্রেসের সঙ্গে ফের আসন রফা করছে। বাম, কংগ্রেস, বিজেপি-সব শাসনেই ব্যক্তি স্বাধীনতা, তৃণসম দীন হয়ে লুটিয়ে আছে। উদা দিয়ে লেখাটাকে ভারাক্রান্ত করবো না (সিদ্ধার্থ রায়ের জরুরী অবস্থায় হাজার চুরাশির মা, ময়দানে সরোজবাবুকে মুক্তি দিয়ে তারপর পেছন থেকে গুলি, হাজতে বিলিতি কায়দায় নারকীয় অত্যাচার, বাম আমলে ডাক্তার সেনের ‘সোজা আঙুলে ঘী না উঠলে, আঙুল ব্যাঁকাতে হবে’, অথবা ভটচাজমশাইয়ের ‘বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে’ স্মর্তব্য। দুর্নীতিহীন সর্বহারা নেতার মেডিকা হাসপাতাল এবং দর্মার বেড়ার বাড়ি থেকে দশতলা আইরিশ হাসপাতাল আর আটতলা বৃদ্ধাশ্রম সবই হলো। অনিলবাবু আর বিমানবাবুর কুৎসিত, কদর্য শারীরি ঈঙ্গিত না হয় অনুল্লিখিত রইলো)। কিছু কথা ‘না বলা বাণীর ঘন যামিনী’ হয়েই থাকুক।
আসুন আমরা ডাক্তারি নিয়ে বলি। হ্যাঁ, যা বলছিলাম বাম আমলে সবাই বামপন্থী হয়ে গেলো। সাধারণ মানুষ, ডাক্তার, সব্বাই। আগমার্কা আগুনখেকো বামপন্থী। এদের দেখলে চে গেভারা লজ্জা পেতেন।
এরপর এলো তৃণমূল। এবার সবাই তৃণমূলপন্থী। এবারে তৃণমূলপন্থী ডাক্তার ইউনিয়নের রম্রমা। তাহলে মোট কটা ডাক্তার ইউনিয়ন হলো? সিপিএমপন্থী, কংগ্রেসপন্থী, বিজেপিপন্থী এবং তৃণমূলপন্থী, মোটামুটি এই চারটি। এদের যদি সমর্থন না করেন? তাহলে আপনি কেউ নন, তাহলে আপনি এক্কেবারে হুশপটেটো। অবন্তিকারা আত্মহত্যা করে, কাঞ্চনরা ভিআরএস) পায় মৃত্যুর পরে, পদত্যাগপত্র গৃহীত হয় না, আপনি ক্রীতদাসগিরি করে যেতে বাধ্য থাকবেন আজীবন; ভালো না লাগলেও। দলে নাম না লেখালে নেতা পারিষদ্রা চাকরিক্ষেত্রে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাবে, অপমানের চূড়ান্ত করবে। চাকরি ছাড়তে পারবেন না। পদত্যাগপত্র গৃহীত হবে না, সুতরাং চাকরি ছেড়ে কোনও টাকাপয়সা পাবেন না।
না, কোনও ডাক্তার ইউনিয়ন এটা নিয়ে বলবে না। আপনি কলকেতাবাসী অথবা বিখ্যাত ডাক্তার না হলে, রোগী দেখতে গিয়ে বেজায় মার খেলেও কিছু বলবে না, কেননা আপনি একটি হুশপটেটোমাত্র। চিকিৎসার সুবিধে কেন নেই, কেন মানুষ ক্ষুব্ধ, সেটা নিয়ে আন্দোলন নেই। সরকারি হাসপাতাল তুলে দিয়ে বীমা চালু হয়ে গেলো, ডাক্তারদের কোনও নড়চড় নেই। অথচ এর্পরে সরকারি হাসপাতাল উঠে যাবে, চাকরিগুলো নির্মোক নৃত্যের মতো ল্যাৎপেতিয়ে খসে যাবে, সে হুঁশ নেই। সব হুশপটেটোর চেম্বার খুলে রোগী দেখার হিকমৎ নেই। অথচ দেখুন……?
এবার দেশের প্রেক্ষিতে নিজেকে ভাবুন। নেতা নন, সিপিএম নন, বিজেপি নন, কংগ্রেস নন, ফিল্মজোনাকি নন, তৈলাক্ত লেখক নন, কেষ্ট নন, বিষ্টু নন, আপনি কেউ নন, কিচ্ছু নন, কেবলমাত্র একটি হুশপটেটো-মূল্যহীন, ফাল্টু ফ্যাতাড়ু।
আপনার মৃত্যুতে কারও কিস্যু আসে যায় না। মাস্টারমশাই আপনি কিছু দেখেননি হয়ে বেঁচে থাকুন।