স্যাটিরিক সেন। পিতৃদত্ত নাম সত্যরিকাক্ষ সেন। পৈতৃক সম্পত্তি হিসেবে একটি বিখ্যাত গেঞ্জি কারখানার মালিকানা পেয়েছেন। স্ফীতোদর। বজ্রকন্ঠী। শ্বেতশুভ্র শ্মশ্রুশোভিত। সদ্য যখন যৌবন নিকুঞ্জের পাখি কা কা বলে ডেকেছিলো তখন কৈশোরের উপান্তে বিয়ে করে ফ্যালেন। পরে নিরতিশয় মনস্তাপে ও সমাজসেবার অনুপ্রেরণায় বৌকে পিত্রালয়ে ছেড়ে আসেন। ব্যস খেল খৎম পয়সা হজম। এবার নিরন্তর সমাজসেবা নো পিছুটান।
উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত অগাধ সম্পত্তি- একটি প্রাসাদোপম গৃহ এবং অনন্ত অবকাশ– এই এখন সম্বল। স্যাটিরিকবাবু নিঃসন্তান। বাবু প্রত্যহ প্রদোষকালে কতিপয় স্থানীয় প্রাজ্ঞ-বিজ্ঞ বয়োবৃদ্ধ সমভিব্যাহারে বিভিন্ন আলোচনায় অংশগ্রহণ করে থাকেন। উক্ত আলোচনাসভাটি “মুক্তিপ্রসার ধরণী” নামে সবিশেষ পরিচিত।
সময়ের বিশেষ আহ্বানে অদ্যকার বিশ্লেষণের বিষয়বস্তু “ক্যা” বা সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট। এবং যেহেতু এই মহতী সভার ব্যয়ভার স্যাটিরিকবাবুই স্বষ্কন্ধে বহন করেন এবং খাদ্যদ্রব্যাদি স্যাটিরিকবাবুর পাচক ও সর্বক্ষণের সঙ্গী গোলগাল কুঁৎকুঁতে চোখ গোপালই সরবরাহ করে তাই উদ্বোধনী বক্তা সদাসর্বদাই স্যাটিরিকবাবু ।
এই আড্ডার বাকি সকলের নামাবলী নিম্নস্বরূপঃ
প্রথম চপল কান্তি কান্তি। সিড়িঙ্গে তিরিক্ষি ভাঙা গাল কুচকুচে কলপমাখা চুল। পরম ভক্ত। একটু ইয়ের দোষ আছে।
দু নম্বরে কপোত মুহুরি। এক সময়ে ল্যান্ড রিফর্ম বিভাগে ভারী পদে চেয়ার সাম্লাতেন। ইনি মধ্যম বর্ণ, মধ্যম আকৃতি, ঝুপো গোঁফ আছে। সদাসর্বদা গলায় গরুর গলকম্বলের মতো একটা মাফলার জড়িয়ে রাখেন।
তৃতীয় ব্যক্তি পঞ্চানন মন্ডল উর্ফ পাঁচু মোড়ল। খোঁচা খোঁচা ঝাঁটামার্কা চুল– গোঁফ পেকে গেছে তাই নির্গুম্ফ। চাঁদের মতোন মিষ্ট হাসি। অবসরে গান বাজনা করে থাকেন।
চতুর্থতঃ আন্তরিক মজুমদার। ইনি লিবারেল, বাংলায় যাকে এককথায় বলে সুবিধাবাদী। তীক্ষ্ণ চোখ ভোঁতা নাক এবং ভূষুন্ডি কাকের মতোন একমাথা কুচকুচে কালো চুল।
নিজের বেনসন হেজেস সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বার করে মুখে লাগিয়ে স্যাটিরিকবাবু আরম্ভ করেন (হেব্বি দেখতে লাগছিলো কিন্তু– একমুখ শ্বেতশুভ্র দাড়ি-গোঁফ, পাকা ব্যাকব্রাশ করা চুল, চকচকে পাঞ্জাবি, আলিগড়ী পাজামা আর চিত্রবিচিত্র হাতকাটা জ্যাকেটে)।
“বন্ধুগণ আজ সন্ধ্যায় আমরা স্বাধীনতার পরে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা পর্যালোচনা করবো এবং একই সঙ্গে “ক্যা” আজ ভারতের পক্ষে কতটা প্রয়োজনীয় এবং উপকারী সেটা বোঝাতে চেষ্টা করবো । ”
চপলবাবু নিজের কলপিত কুঞ্চিত কেশদাম অঙ্গুলি চালনায় সুবিন্যস্ত করে বল্লেন “সাধু সাধু, বিধর্মীশূণ্য হোক আমাদের পুণ্যভূমি– সনাতন ধর্মের পীঠস্থান সুজলা সুফলা মাতৃভূমি….” বলা বোধ করি বাহুল্য হবে না যে চপলবাবু একজন প্রবল হিন্দু ।
স্যাটিরিকবাবু ঈষৎ ভ্রূ কুঞ্চন করে পূর্বসুত্রের লাঙ্গুল ধরতে উদ্যত হলেন।
“আহা সম্প্রচারে বিঘ্ন ঘটাচ্চো ক্যানো হে ?” শ্রীকপোত মুহুরি চপলবাবুকে মৃদু ভর্ৎসনা করলেন।
স্যাটিরিকবাবু পুনঃপ্রচারোদ্যত। “এই অভাগা ভারতে যে কতো কতো মানুষ গৃহহীন তাদের কথা কেউই চিন্তা করে না। কদিন আগে এই রাস্তায় একটা পাগলীকে দেখতুম– নোংরা– স্নান না করা চেহারা কোটরে বসা চোখ– একটা বাচ্চা কোলে নিয়ে ঘুরতো – কদিন পর দেখি পাগলীটা সেই বাচ্চাটা মরে গ্যাচে সেই বাচ্চাটাকেই কোলে নিয়ে ঘুরচে– তার এক বচ্ছর পর দেখি আবার একটা সদ্যজাত বাচ্চা নিয়ে ঘুরছে ….. এই মানুষের নাগরিক অধিকারকে রক্ষা করে বলো দেখি? কীই বা এদের নাগরিক অধিকার আছে? খাদ্য নেই বস্ত্র নেই শিক্ষা নেই… ”
সঙ্গীতশিল্পী এবং পঞ্চায়েত কর্মাদির বিষয়ে বিশেষ দক্ষ শ্রীপাঁচু মোড়ল বলেন “ইসস মেয়ে মানে কি কেবলই কৃষ্ণগহ্বর? মানুষের রুচি নেই, বোধ নেই?” মোড়লমশাইএর আশ্চর্য হওয়ার ক্ষমতাও বিলুপ্ত। উনি কিঞ্চিত খাবি খান।
স্যাটিরিকবাবু নাক খুঁটে পরম যত্নে আঙুলদুটি টেবিল ঢাকনার উপরিদেশে মুছে নিয়ে বক্তব্য দীর্ঘায়িত করতে থাকেন “এই হাজার হাজার মানুষ যে পথে ঘাটে ফুটপাতে ইস্টিশনে থাকে – আমরা এদেরকে নিয়ে ভাবিই না। এদের আদমসুমারিতে ধরা হয়তো হয় হয়তো নয়……”
পাঁচু মোড়ল বলেন “বহু ক্ষেত্রেই হয় না, কে যাবে মশয় ঐ সব আস্তাকুঁড়ে? তাছাড়া এদের ঠিকানার ঠিক ঠিকানা নেই– আজ গয়েশপুরে তো আগামীকাল হেতমপুরে, তার পরের দিন বর্ধমানের ভাতারে … বুইলেন কিসু? … এরা কেউ নয় কিস্যু নয় জাস্ট ফালতু ”
স্যাটিরিকবাবু কিঞ্চিৎ ভেবে বলেন “তাহলে এদের নাগরিক অধিকার আদায় করার উপায় কি?”
চপলকান্তিবাবু ধুয়ো ধরেন “অবাঞ্ছিত মোল্লাগুলোকে বার করলেই এদের জন্যে কিছু ব্যবস্থা করা সম্ভব”
“কিন্তু চপলবাবু সব মুসলমানকে তো অন্য কোথাও পাঠানো যাবে না … যারা যুগ যুগ ধরে এদেশে আছে … তাদের কোথায় পাঠানো হবে? তাদের তো অন্য দেশে কিছুই নেই … সেতো ভারী মুশকিলের কথা…” পাঁচু গভীর সন্দেহ প্রকাশ করেন।
স্যাটিরিকবাবু পরম মমতায় হুঁ হুঁ করে হাসেন– “না হে না ঐ জন্যেই ঊনিশশো একাত্তর সালটাকে ভিত্তিবর্ষ ধরা হয়েছে .… এবার বুঝলেন মশয়রা?”
ইতিমধ্যে গোলগাল গোপাল একটা ট্রেতে করে ধূমায়িত কফি আর গর্মাগ্রম ফিশফ্রাই নিয়ে এলো। কফিতে চুমুক দিয়ে ডান হাতে ফিশফ্রাই ধরে স্যাটিরিকবাবু চালাতে থাকেন।“উত্তর প্রদেশে … কেবলমাত্র উত্তর প্রদেশে তিন কোটি আটাত্তর লক্ষ মানুষের ঘরবাড়ি নেই …হ্যাঁ এটা দু হাজার এ্যাগারো সনের আদমসুমারিতে জানা যায়। উত্তর প্রদেশের মোট জনসংখ্যা প্রায় কুড়ি কোটি চল্লিশ লক্ষ মানে প্রায়… উঁ উঁ উঁ … ঊনিশ শতাংশ লোকের ঘর বাড়ি নেই আর মহারাষ্ট্রে মোট জনসংখ্যা এ্যাগারো কোটি চল্লিশ লক্ষ তার এ্যাগারো দশমিক নয় শতাংশের মানে এক কোটি ছত্তিরিশ লক্ষ মানুষের ঘরবাড়ি কিস্যু নেই, নাগরিক অধিকার-স্বাস্থ্য–শিক্ষা- আব্রু- কিস্যু নেই– বুঝলেন?”
কচরমচর কচরমচর। শব্দটি ফিশফ্রাই চিবোনোর। এই মহতী বক্তৃতা দিতে দিতে ওনার গলা শুকিয়ে গেছে তাই কফিতে দ্বিতীয় চুমুক। “অবশ্যি কাশ্মীরের মাত্র এক দশমিক শূন্য এক শতাংশ লোকে গৃহহীন; এটাই সব চাইতে কম। আমাদের পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সাত দশমিক পাঁচ ছয় শতাংশ মানে আটষট্টি লক্ষ লোকের ঘরবাড়ি নেই …” স্যাটিরিক সেন একটু থেমে ফিশফ্রাইএর স্বাদগ্রহন করেন।
“গোটা ভারতে এই নিরক্ষর অসহায় খাদ্যহীন বস্ত্রহীন মানে মানুষ হিসেবে বাঁচার মিনিমাম কোনও উপকরণহীন মানুষের সংখ্যা নয় নয় করে ন’ কোটি তিরিশ লক্ষ পঁচাত্তর হাজার আটশো আটচল্লিশ.. উঁ উঁ উঁ উঁ ভারতের মোট জনসংখ্যার প্রায় সাত দশমিক দুই শতাংশ… এ্যাতো বড়ো বড়ো সংখ্যা তো? টুকটাক ছোটোখাটো ভুল থাকলে ক্ষমা করবেন। তবে মোটামুটি সংখ্যা টা বেশী হতে পারে কিন্তু কম নয়…”
“কিন্তু ক্যা? এখানে ক্যা কই?” আন্তরিক বাবু আন্তরিক ভাবে প্রশ্ন করেন।
স্যাটিরিক সেন একটা উচ্চ মার্গের হাসি দিয়ে বলেন “এখানেই তো ক্যা আর এনার্সির খেলা। ধরুন গিয়ে …. আসামে আদমসুমারিতে দশ লক্ষ আটাত্তর হাজার চারশো দশ জন গৃহহীন মানুষ পাওয়া গেছে কিন্তু এনার্সিতে এর বহু গুণ বেশী মানুষ বাদ গেছে। সুতরাং এই প্রায় দশ কোটি লোক ডিটেনশন ক্যাম্পে থাকবে– খাবার পাবে ঘর পাবে স—-ব পাবে। এছাড়াও প্রায় দশ কোটি লোক একাত্তরের আগের কোনও কাগজপত্র দ্যাখাতে পারবে না হুঁ হুঁ হুঁ হুঁ … মোট কুড়ি কোটি লোক কমে যাবে, তাহলে বিদেশ থেকে আসা টাকার থেকে পনেরো বিশ লক্ষ টাকা করে বাকিরা সবাই পেয়ে যাবে … ব্যস সব সমস্যার সমাধান ..হুঁ হুঁ হুঁ হুঁ ”
পাঁচুবাবু বলেন “একবার আমি একটা কুকুর পুষেছিলাম … ঘরে আটকে দিলেই সেটা কেঁদে চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় করতো .. মানে … মানুষ কি এভাবে থাকা পছন্দ করবে? এই কুড়ি কোটি লোক কি ক্যাম্পে থাকতে চাইবে .. মানে সেটা কি ঠিক হবে?”
চপলবাবু সন্দেহ প্রকাশ করেন। “আরে আপনি তো মহা ইতর লোক মশয়? কুকুরের সঙ্গে মানুষের তুলনা করছেন?”
কপোত মুহুরি চটে চট্টগ্রাম হয়ে ওঠেন।
হঠাৎ আন্তরিক বাবু হূ হূ করে কেঁদে উঠলেন “আমার তো একাত্তরের আগের কোনও কাগজপত্র নেই … মাগো আমার কি হবে?”
স্যাটিরিকবাবু আন্তরিকবাবুর মাথায় হাত বুলিয়ে সস্নেহে বলেন
“আহা আহা কানতে নেই কানতে নেই। এ্যাতোদিন তো সর্বহারার জন্যে বুক চাপড়ে কেঁদেছিলেন এবার সর্বহারাদের সঙ্গে থেকে তাদের বেদনার সঙ্গী হয়ে যান।”