ছোট্ট আফসানা (নাম পরিবর্তিত)-কে নিয়ে ওর মা গত কালই এসেছিলেন চেম্বারে। তিনমাস ওর বয়স। খুব সুন্দর একটা পিঙ্ক ফ্রক পরে এসেছিল।
নাম ধাম বয়স লিখতে লিখতেই বললাম ওর মাকে, বলুন কি অসুবিধে?
না তেমন কিছু না,ওই জন্মের পর লক ডাউনের জন্য তো সেইভাবে চেকআপ করানো হয়নি তাই একটু নিয়ে এলাম আর কি!
ও, ঠিক আছে, দেখে নিচ্ছি।
সারাদিনে দু তিনবার কিন্তু একটু দই তোলে মুখ দিয়ে।
ভাল করে ঢেঁকুর তোলাবেন খাওয়ানোর পর, ওটা কমে যাবে। আর যদি তোলেও ভয়ের কিছু নেই। দু তিন বার দুধ তোলা কোন বড় রোগের লক্ষণ না।
আচ্ছা ডাক্তারবাবু, রোজ চান করালে ক্ষতি কিছু হবে না তো?
না না, গরম কাল তো এখন, করাবেন।
ডাক্তারবাবু সাবান দিয়ে কি রোজ চান করানো যায়?
একদিন ছাড়া এক দিন বা সপ্তাহে দু দিন করাতে পারেন।
এই রকম ডজন খানেক প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার পর ভাবলাম বাচ্চাটিকে একটু দেখে নি।
টেবিলে শুইয়ে দিতে বললাম।
ফুটফুটে একটা মেয়ে। চোখে মুখে একরাশ বিস্ময় নিয়ে আমার মুখের মাস্ক আর ফেস শিল্ডের দিকে তাকিয়ে রইল। আমি একটি কাতুকুতু দেবার চেষ্টা করতেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। মনে মনে ভাবলাম ভাগ্যিস ওর মা ওকে মাস্ক পরিয়ে আনেনি; নাহলে এমন মিষ্টি হাসি দেখতে পাওয়ার উপরি পাওনাটা মাঠে মার যেত।
স্টেথোস্কোপটা বুকে ছুঁইয়েছি এমন সময় আফসানার মা একটু দ্বিধাগ্রস্ত গলায় বলে উঠলেন, ডাক্তারবাবু একটা কথা জিজ্ঞেস করব, কিছু মনে করবেন না তো?
না না বলুন।
ডাক্তার বাবু কিছু কি ওষুধ বা মলম পাওয়া যায় যাতে আমার মেয়ের গায়ের রংটা একটু ঠিক হয়। একদমই আমার রটা পেয়েছে।
তখনও পর্যন্ত আমি হয়ত সতর্ক ভাবে ওনাদের রঙের কথা ভাবিনি। আফসানার মায়ের শুধু মাত্র চোখ দুটোই বোরখার বাইরে ছিল। কিন্তু ওই ছোট্ট পরীর মিষ্টতার কাছে ওর চামড়ার রং যেন বড়ই ম্লান হয়ে গিয়েছিল।
সত্যি বলছি তখন ওর রঙের দিকে তাকানোর চেয়ে চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকল ওর মায়ের সারা জীবন ধরে বয়ে বেড়ানো একরাশ হীনমন্যতা, কটূক্তি, অপমানের জমাটবাঁধা ঘন কাল মেঘগুলো।
এইসব ভাবতে ভাবতে হয়ত একটু অন্যমনস্কই হয়ে গিয়েছিলাম। তখন আমি বুঝলাম হয়ত কেবল এই জিনিসটা জানার জন্যেই উনি চেম্বারে এসেছেন। এতটুকু বাচ্চাকে রোজ সাবান মাখানোও হয়ত সেই জন্যেই। চর্মরোগের ডাক্তারবাবুরা হয়ত এই জিনিস আরও কাছ থেকেই দেখেন।
সেই দিনই ঘরে ফিরে দেখলাম আমেরিকার ওই নির্মম ভিডিও টা যেখানে এক শ্বেতাঙ্গ কিভাবে ঠান্ডা মাথায় হাঁটু দিয়ে চেপে এক কৃষ্ণাঙ্গকে খুন করে ফেললেন। আর ভাবলাম আমাদের সমাজের মধ্যে আর আমাদের নিজেদের মধ্যেই ওই পুলিশ অফিসার লুকিয়ে আছে। নাহলে একটা তিন মাসের শিশুকে নিয়ে এক মাকে ছুটে আসতে হয় না ডাক্তার বাবুর চেম্বারে ফর্সা করার জন্যে!
খুব ভালো লেখা। ভীষণ ভালো। আরও লিখবেন।