কী ভাবছেন সবাই? সর্বাত্মক প্রতিবাদে ভেসে গিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ? আজ্ঞে না, ভুল ভাবছেন।
গণেশ পুজোর প্যাণ্ডেলে আলোকসজ্জা কম পড়েনি কোত্থাও। তারস্বরে মাইকে বাজছে — ‘জিমি, জিমি, জিমি, আ যা আ যা আ যা’—
প্রত্যন্ত অঞ্চলে নয়, আমার বেহালার পাড়ায়।
বেহালা ট্রাম ডিপোর মার্কেটের ভিড় উপচে পড়েছে ডায়মণ্ড হারবার রোডে — ঘর্মাক্ত, হাস্যমুখ, বাজারু জনতার হাতে রঙচঙে কাপড়ের প্যাকেট।
কালী আর হনুমান মন্দিরের সামনে ভক্তের ভিড়, দেদার বিকোচ্ছে মালা, ধূপ, প্যাঁড়া, মিষ্টি।
মুঠোফোনের সোশ্যাল মিডিয়ার পাতায় চোখ ফেরালেই হরেক রিল, তার মধ্যে কিছু হয়ত সাম্প্রতিক নারকীয় ঘটনা এবং সর্বোচ্চ আদালতের শুনানি প্রক্রিয়া সংক্রান্তও রয়েছে। রিলের নিচে মন্তব্যের সেকশন খুলে দিলে নরক একেবারে গুলজার। বাংলায় লেখা মন্তব্য, অতএব বাঙালি নেটিজেন। তাদের যে মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে — এই শোচনীয় দুঃসময়েও — তাতে মন আর পীড়িত হচ্ছে না, ক্ষোভে, শোকে উন্মাদ হয়ে উঠছে।
আমার পাড়ায় জোরকদমে চলছে পাকা পুজোমণ্ডপ তৈরির কাজ। পাড়ার বাসিন্দাদের হোয়াটস্যাপ গ্রুপে ছড়িয়ে পড়েছে ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ প্রত্যাখ্যান করার ফর্মের প্রতিলিপি — সঙ্গে ঘোষণা, যার প্রয়োজন নেই, তিনি ফিরিয়ে দিন। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার একটি জনকল্যাণমূলক প্রকল্প — কোনো শাসকের প্রতি আনুগত্যের প্রাইজ নয়, কারোর পৈতৃক সম্পত্তির খয়রাতও নয়, এ কথা শহুরে, শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত বাঙালির একটা বড় অংশ যদি বুঝেও না বোঝার ভান করেন, গ্রামীণ, দরিদ্র, স্মার্টফোনহীন প্রান্তিক মানুষজন কি বুঝছেন, তা সহজেই অনুমেয়।
আমি বারবার বলেছি, এই নাগরিক আলোকবৃত্তের উপচ্ছায়ায় পড়ে থাকা দূর গাঁয়ের মানুষগুলোকে তাদের ভাষায় বুঝিয়ে প্রতিবাদে শামিল না করতে পারলে আন্দোলন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। এখনো একই কথা বলব।
শহরের সরকারি হাসপাতালে সুরক্ষার অপ্রতুলতা, ডাক্তার-রোগী অনুপাত, চিকিৎসাশিক্ষার পরীক্ষার স্তরে, প্রশাসনিক কাজকর্মের স্তরে, চিকিৎসক বদলির স্তরের দুর্নীতি বোঝার চাইতে অনেক সোজা ‘ডাক্তারের গাফিলতিতে’ রোগীমৃত্যু ব্যাপারটা বুঝে নেওয়া।
যে প্রান্তবাসিনী মধ্যরাতে নিজের ঘরের পাশের শৌচালয়ে যেতে নিরাপত্তার অভাব বোধ করেন, তাঁকে ঝাঁ চকচকে রাজধানীর হাসপাতালের সিসিটিভিহীন সেমিনার রুমে লেডি ডাক্তারের নাইট ডিউটির বিপদ বোঝানো কষ্টকর।
এমন নয় যে প্রত্যন্ত এলাকার মানুষ অসংবেদী বা নির্বোধ।
তাঁদের বহু যুগ ধরে বুঝিয়ে চলা হয়েছে, শহুরে ‘এলিট’ জনগণ হচ্ছে গণশত্রু, প্রিভিলেজড ক্লাস। আর এই সুবিধা তারা পেয়েছে, পাচ্ছে গ্রামকে শোষণ করে। বিশ্বায়ন পরবর্তী সময়ে গ্রাম শহরের যত্নে টানা সীমারেখা ঘুচতে বসলেও, চিন্তনের ফারাক বিশেষ হয়নি। বাজার অর্থনীতি, চুঁইয়ে পড়া উন্নয়নের হাত ধরে গ্রামেও তৈরি হয়েছে শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত শ্রেণী। তারাও birds of same feather flock together এর মন্ত্রে হয়ে উঠেছে শহরমুখী। যদিও শহরে কাজের সুযোগ সাংঘাতিক ঊর্ধ্বমুখী, এমন চিত্র নেই।
এই বাপ পিতেমোর জীবিকা আঁকড়ে পড়ে থাকা গ্রামীণ মানুষগুলি, উত্তরবঙ্গের চা শ্রমিক, রাজবংশী আদিবাসী, ভাগীরথীর দুই পারের দুই জেলার সংখ্যালঘু মানুষজন, রাঢ়বঙ্গের বিশাল কয়লা শিল্পাঞ্চলের খনিশ্রমিক ও অবাঙালি মজদুর, উত্তর চব্বিশ পরগণা আর হাওড়ার মরে হেজে যাওয়া কারখানাগুলোর প্রাক্তন শ্রমজীবী, দক্ষিণবঙ্গের বাদা অঞ্চলের মৎস্যজীবী ও মউলে বাউলে, তাঁদের পরিবার — এঁরা কতটা একাত্ম বোধ করছেন এই আন্দোলনের সঙ্গে?
আমি সত্যিই জানি না।
আমার ফেসবুক বন্ধুরা হাজারটা রাত দখলের ভিডিও নিয়ে আমার বক্তব্য খণ্ডন করতে এগিয়ে আসবেন জানি, তবু, আমার অবস্থান থেকে আমি সরব না।
কারণ, বাস্তবটা আমি দেখেছি।
বাস্তব মানে কেবল রাজধানী, তার উপকণ্ঠ আর সুভদ্র যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পন্ন মফস্বল নয়। মানুষ মানে জীবন ও জীবিকার খোঁজে শহরের সঙ্গে নিত্য যোগসূত্রে বাঁধা পড়া সচেতন মানুষ শুধু নয় — অজানা গাঁয়ের রামা কৈবর্ত আর রহিম শেখদের পরিবারও বটে।
তাঁরা সালিশি সভা বোঝেন, স্বাস্থ্যসাথী আর কন্যাশ্রী বোঝেন, দেবতাসম স্থানীয় নেতানেত্রীদের দাপটও বোঝেন — শ্রেণী ও পেশা নির্বিশেষে গণজাগরণ তাঁদের মধ্যে তত আন্তরিক সাড়া ফেলে না।
আমি ভুল প্রমাণিত হলে, আমিই সব থেকে খুশি হবো।
আর আমাকে ভুল প্রমাণ করার জন্য আরো দুটো বছরের দরকার নেই, আসন্ন দুর্গাপুজোর মরশুমই যথেষ্ট।
তবে কি কোথাও কিছু হচ্ছে না?
হচ্ছে বৈকি! দাঁতে দাঁত চিপে, সুশৃঙ্খলভাবে, শান্তিপূর্ণভাবে রাজপথে লড়ে যাচ্ছে আমাদের মেধাবী সন্তানেরা। কীসের জন্য লড়ছে?
লোভ যেন তাদের বিপথগামী করতে না পারে, দমবন্ধ করা দূষিত কর্মপরিবেশ যেন তাদের কাজের সদিচ্ছা আর কুশলতা কমিয়ে দিতে না পারে, সেবা আর শুশ্রূষার পীঠস্থান যেন
গুণ্ডারাজ, দালালচক্র আর সন্ত্রাসের পীঠস্থান না হয়ে উঠতে পারে, তার জন্য লড়ছে।
আর কোনো অভয়াকে যেন অপরিসীম যন্ত্রণা আর চরমতম লাঞ্ছনা সয়ে অকালে ঝরে যেতে না হয়, তার জন্য লড়ছে। রাষ্ট্র যেন ধর্মযুদ্ধকালে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের মতো নীরব না থাকে, সেটার জন্যও লড়ছে।
লড়ছে সাধারণ মানুষের জন্য, কারণ হাসপাতাল পাঁকমুক্ত হলে তার সুফল রোগী থেকে ডাক্তার সকলেই ভোগ করবেন।
এই কথাটি সেই অসম্পৃক্ত সাধারণ মানুষটিকে বোঝাতে হবে, তাঁকেও জড়িয়ে নিতে হবে এই প্রতিরোধে — অপশাসনের ভয় দেখিয়ে নয়, হুকুম জারি করে নয়, ‘আমরা বেশি বুঝি’র দম্ভ প্রদর্শন করে নয়, যুক্তি সহকারে পরিস্থিতির গুরুত্ব বোঝাতে হবে। শুনতে হবে তাঁদের কথাও, নিতে হবে তাঁদেরও মতামত।
শুধু ‘ওঃ, আমরা তো নিকৃষ্ট অনুদানভোগী, শিরদাঁড়াহীন ভিখারি জাতি’ বলে শ্লেষ করলে চলবে না। তাতে অগ্নিতে ঘৃতাহূতি দেওয়া হবে, পক্ষের বিপরীতে পক্ষ তৈরি হবে, সামাজিক বিভাজন গভীর হবে আরো — সুশাসনের স্বপ্ন সুদূরপরাহত হয়ে চলে যাবে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
শ্রেণীভিত্তিক যে ঘৃণার রাজনীতি ডালপালা মেলে অসাধুদের লীলাক্ষেত্র করে ফেলেছে আমাদের রাজ্যটিকে, তার হাত থেকে বাঁচতে মরুঝড়ের সামনে উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজে থাকলে আর চলবে না। সবরকম ছুঁতমার্গ ভুলে সকলের একজোট হওয়ার এখনই মাহেন্দ্রক্ষণ।
কোনো ব্যক্তিবিশেষকে মূর্তিমান স্বৈরতন্ত্র ভেবে উচ্ছেদ করতে চাইলেই সমস্যার সমাধান হবে না। এটা গণতান্ত্রিক দেশ — কোনো রাজার রাজত্ব নয়। ব্যক্তি এখানে প্রতীক মাত্র। একক শয়তান বা একক মসীহা কেউ হয় না, হতে নেই। এইটুকু পরিণতমনস্কতা একটা ৭৭ বছরের পুরোনো গণতন্ত্রের নাগরিকদের থাকা প্রয়োজন।
ঠিক বলেছেন!