দিন সাতেক আগের কথা। নভেম্বরের শীতের আমেজ ধীরে ধীরে গাঢ় হচ্ছে। বিকেলের চেম্বারে ঢোকার মুখেই পরিচিত এক যুবক প্রায় দৌড়ে এসে পথ আটকে বললেন, গাড়িতে করে অসুস্থ ভাইকে এনেছি। একটু দেখে দিন।
হাঁপাতে থাকা যুবককে আশ্বস্ত করতেই, যুবক বলতে শুরু করলেন – আজ সকালে দুই ভাই মিলে মাঠের কাজে গেছিলাম। দুপুরে মাঠ থেকে ফিরে স্নানের সময় ভাই ঠান্ডার ভয়ে পুকুরে নামতে চাইছিলো না বলে দুষ্টুমি করে ওর মাথায় ঠান্ডা জল ঢেলে দিয়েছিলাম। যেই না ঢেলেছি, ভাই সাথে সাথে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। আমি সঙ্গে সঙ্গে ওর মাথাটা কোলে নিতেই মিনিট খানেকের মধ্যেই জ্ঞান ফিরে আসে। আমার ডাকাডাকিতে বাড়ির লোকে ততক্ষণে চলে আসে। তাদের মধ্যে থাকা আমার দিদি যেই না আবার ভাইয়ের চোখে মুখে জল ছিটিয়েছে, অমনি আবার মিনিট খানেকের জন্য জ্ঞান হারিয়ে ফেলে ভাই। সবাই ভয় পেয়ে গ্রামের এক কোয়াক চিকিৎসককে ডেকে আনে। তিনি পরীক্ষা করে বলেন, সকাল থেকে রোদে কাজ করেছে বলে মাথায় রোদ লেগে পেটে গ্যাস জমে গেছে বোধহয়। সেটাই নাকি মাথায় উঠে এরকম সমস্যা পাকাচ্ছে। সেই বলে তিনি একটা গ্যাসের ইঞ্জেকশন বের করে যেই না পুশ করেছেন, অমনি আবার মিনিট খানেকের জন্য জ্ঞান হারায় ভাই। তারপরে আর রিস্ক নিইনি স্যার। সোজা আপনার কাছে নিয়ে এসেছি। ঐ গাড়ির ভেতরে আছে। একটু দেখুন স্যার।
ওর আকুতি ভরা আবেদনের মাঝেই আমার মাথায় তখন বেশ কিছু চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। খিঁচুনি রোগ (সিজার ডিসঅর্ডার) নয় তো? ব্রেনের প্যারেনকাইমা দখল করা কোনও টিউমার হয়নি তো? হার্টের বহুবিধ সমস্যায় এধরণের উপসর্গ দেখা দিলেও বছর ছাব্বিস বয়েসে হৃদরোগ? ঠিক যেন মিলছে না।
স্টেথোস্কোপ আর পালস অক্সিমিটার হাতে নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িটার দিকে এগিয়ে গেলাম। ভেতরে ঝুঁকে দেখলাম তরুণ যুবক ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে আছে। কপালের মাঝখানে চিন্তার কুঞ্চন। বাইরে থেকে দেখে বিশেষ কিছু বোঝার নেই। তবে পালস অক্সিমিটার হাতের আঙুলে গুঁজে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে যেই না রেডিয়াল ধমনীর ওপর হাত ছুঁয়েছি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম আমি। পালস প্রায় পাওয়াই যাচ্ছে না। পালস অক্সিমিটারেও কোনো রিডিং পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ দিব্যি বসে আছে রোগী। তড়িঘড়ি অপর হাত টা টেনে নিয়ে একই পরীক্ষা করে দেখলাম সে হাতেও একই অবস্থা। অনেক পরে পরে ক্ষীণ পালস হয়তো পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু তার গতি অস্বাভাবিক রকমের কম। মিনিটে খান পনেরো হবে। স্বাভাবিকভাবে মিনিটে ষাট থেকে একশো হবার কথা।
বিস্ময়ে একরকম অসাড়েই চিৎকার করে বললাম – “অ্যাট্রোপিন”।
কাছে দাঁড়িয়ে থাকা অ্যাসিস্ট্যান্ট ছেলেটি দৌড়ে অ্যাট্রোপিন ইঞ্জেকশন নিয়ে এলো।
ততক্ষণে পকেটে থাকা দু ইঞ্চির ছোট্ট ইসিজি মেসিনটি ওর বাম পায়ে বসিয়ে দুই হাতের বুড়ো আঙুল মেসিনের ওপর বসিয়ে মোবাইলের অ্যাপের মাধ্যমে ইসিজি লাইনে চোখ রাখলাম। হৃদযন্ত্রের অলিন্দ চলছে নিজের ছন্দে, নিলয়ের সাথে তার কোনো সম্পর্ক না রেখেই। অর্থাৎ কিনা থার্ড ডিগ্রি হার্ট ব্লক। সহজ ভাষায় অলিন্দ আর নিলয়ের বিচ্ছেদ, এ.ভি ডিসোসিয়েশন। ইতিমধ্যে অ্যাসিস্ট্যান্ট ছেলেটি অ্যাট্রোপিন ইঞ্জেকশন পুশ করতে শুরু করেছে। ইঞ্জেকশনের ঠেলায় যেই না সিম্প্যাথেটিক নার্ভ উদ্দীপিত হওয়া শুরু হলো অমনি ছেলেটি জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়লো পাশে থাকা ভদ্রলোকের কোলে। আমার ইসিজির গ্রাফ স্থির হয়ে গেল নিমেষেই।অর্থাৎ কিনা কমপ্লিট হার্ট ব্লক। যা কিনা প্রায় মৃত্যুরই সমতূল বলা চলে।কিন্তু সবাইকে চমকে দিয়ে আধা মিনিট পরেই আবার সচল হলো ইসিজির গ্রাফ। পালস ও ক্ষীণ ভাবে ফিরে এলো। হালকা কাশি দিয়ে সোজা হয়ে বসলো ছেলেটি। কিছুক্ষণের মধ্যেই অ্যাট্রোপিনের ঠেলায় পালস রেট খানিক বাড়লো। কিন্তু অলিন্দ আর নিলয়ের বিচ্ছেদ আর জোড়া লাগলো না। এক্ষেত্রে একমাত্র উপায় চটজলদি পেসমেকার বসানো। না হলে মৃত্যু অনিবার্য। কিন্তু এ মফঃস্বলে সে জোগাড় অসম্ভব।
কিন্তু মুস্কিল হলো এর পরেই। রোগীর বাড়ির লোককে সব কিছু বুঝিয়ে বলে কলকাতার কার্ডিওলজিষ্ট বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করিয়ে তড়িঘড়ি পেসমেকার বসানোর উপযোগিতা বুঝিয়ে বলার পরেও শুরু হলো অহেতুক দেরি। এদিকে অ্যাট্রোপিনের দৌলতে অলিন্দে থাকা হার্টের স্পন্দন তৈরীকারি এস.এ. নোডের স্পন্দনের হার বাড়লেও নিলয়ের সাথে যোগাযোগের পথ (এ.ভি. নোড) সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকায় নিলয়ের স্পন্দনহার বৃদ্ধি পেলো না। ফলে তূলনামূলক ভাবে কমপ্লিট হার্ট ব্লকের হার বৃদ্ধি পেলো। ফলে রোগী অজ্ঞান হবার হার বেড়ে গেলো। আপাতদৃষ্টিতে রোগীর বাড়ির লোকের মনে হলো, এই ইঞ্জেকশন দেওয়ার ফলেই বোধহয় সমস্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে তারা তাড়াতাড়ি পেসমেকার বসানোর ব্যবস্থা না করে বারেবারে অনুযোগ করতে শুরু করলেন আমার কাছে। এক্ষেত্রে অ্যাট্রোপিনই যে একমাত্র ওষুধ আর পেসমেকারই যে একমাত্র উপায়, চিকিৎসা বিজ্ঞানের এ জটিল বিষয় বোঝাই কি করে?
অবশেষে অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর কথা বুঝিয়ে বলায় রোগীকে নিয়ে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন বাড়ির লোক। মাঝপথে রোগীর অবস্থা আরও সঙ্গীন হওয়ায় মুঠোফোনে নির্দেশ দিলাম কাছের এক হাসপাতালের আই সি ইউ তে ভরতি রাখার। কিন্তু সে হাসপাতালেও পেসমেকার বসানোর সুবিধা নেই। কোনোমতে কিছু সময় কাটিয়ে অবশেষে কলকাতার হাসপাতালে নিয়ে যেতে পেরেছিলো ওরা।
ওখানে সাথে সাথে পেসমেকার বসানো হলো। নিয়মিত খোঁজখবর নিচ্ছিলাম আমি। কিছুক্ষণ আগেই ওখানকার চিকিৎসকের কাছ থেকে জানলাম, এখন এক্কেবারে সুস্থ ঐ যুবক। আগামীকাল ছাড়া পাবেন। তারপর থেকে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ভাবে বাকি জীবন সুখেই কাটবে আশা রাখি।
আমার চেম্বার থেকে অনতিদূরেই থাকা নবনির্মিত সুপারস্পেশালিটি হাসপাতাল আর নিকটবর্তী মেডিক্যাল কলেজ থাকা সত্ত্বেও কেন যে এই যুবকের জন্য আমাদের কলকাতা নির্ভর হতে হবে তার উত্তর খুঁজতে খুঁজতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে হতদরিদ্র গ্রামের দিকে তাকিয়ে দৈনন্দিন চরৈবতির পথে পা বাড়াতে চললাম আমি।