৩১শে মার্চ, ২০২০
আমার বহির্জগতের পরিবেশ যতই দমচাপা উত্তেজনার সৃষ্টি করুক না কেন মনে, বাড়ির আবহাওয়া কিন্তু আগের মতই ছিল— নিরুদ্বেগ মুহূর্তগুলো কেটে যাচ্ছিল মন্দ লয়ে।
অসুস্থতা ও বয়সের কারণে, মা স্বাভাবিক ভাবেই গৃহবন্দী, দেশ জোড়া লকডাউন তার রোজনামচায় কোনো বদল ঘটাতে পারেনি দৃশ্যত।
তার উপর হাসপাতালে স্পেশ্যাল রোস্টার ডিউটি পড়ার ফলে মা আমার সঙ্গও অনেক বেশি সময় ধরে পাচ্ছে এখন। আগে আমি যতটুকু সময় বাড়িতে থাকতাম, আমার ঘড়ির কাঁটা মাকে ঘিরেই আবর্তিত হতো। তবু, কোথাও একটু ফাঁক থেকে যেত হয়ত — আমার ছিয়াত্তর পার করা নিঃসঙ্গ মায়ের কিছুটা অসঙ্গত নিরাপত্তাহীনতার বোধের সঙ্গে আমার নিজস্ব ‘টাইম ম্যানেজমেন্টে’র একটা অসম লড়াই ছিল।
করোনার প্রকোপে এই বাধ্যতামূলক ঘেরাটোপ-বাসে, মায়ের কল্পিত নিরাপত্তাহীনতার বোধটা প্রায় উধাও হয়ে গিয়েছে। হৃদরোগের সাতটা ওষুধের বদলে আমার সাহচর্যের নিরাময়ক্ষমতা বেশি বলে নিজের কাছেই নিজের বড়াই করার ইচ্ছে হচ্ছে আজকাল।
দোকান বাজার, মুদিখানার জিনিসপত্তর কিনতেও অসুবিধে হয়নি ক’দিন। হাসপাতাল থেকে ফেরার পথে, মাছ-সব্জির ভাঙা হাট আর প্রায় নিশুতি পাড়ার মুদির দোকান থেকে সওদা নিয়ে ফিরে এসেছি ফাঁকায় ফাঁকায়।
পরশুও তাই ফিরেছি।
ফেরার পথে একটা বেয়াড়া ভাবনা মাথায় ঠোক্কর মারছিল আমার। আচ্ছা, এই যে এত অজস্র ঝাঁপ বন্ধ দোকানপাট, এর মধ্যে কত শতাংশ বড় ব্যবসায়ী? মানে ঠিক কতজন দু’আড়াই মাস ব্যাপী লকডাউনের ঝাপটার ‘সামান্য ক্ষতি’ স্বীকার করে আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে এই আর্থিক বছরেই? আর ছোটো দোকানী বা অন্যতর জীবিকা যাঁদের? মনে মনে একটা তালিকা বানাবার চেষ্টা করলাম, এঁরা কারা হতে পারেন।
ফল-সব্জি-মাছ-মুদিখানা-ওষুধের দোকানকে বাদ দিলেও এঁদের সংখ্যা কিন্তু কম নয়।
ধরুন, জেরক্স-খাতা-পেন-পাঠ্যবইয়ের ছোটো দোকানদার, হার্ডওয়্যারের দোকানি, টিপ-দুল-হার-চুড়ি-কাপড় শুকোনোর ক্লিপ-সস্তার ব্যাগ-বিছানার চাদর, কাঁচ,প্লাস্টিকের থালা-বাটি-গ্লাস-কাপপ্লেটের ফুটপাথি হকার, ঢাউস ব্যাগ কাঁধে বাড়ি বাড়ি ঘোরা খুচরো শাড়ির ব্যাপারি, লোকাল কোম্পানির আচার-চাটনি-জ্যাম-জেলির সেলসম্যান, পাতকুয়ো, কল সারাইয়ের মিস্ত্রি, শিল-কাটাই ওয়ালা, দিনমজুর, রাজমিস্ত্রি বা রঙ-মিস্ত্রির জোগাড়ে, টোটো-অটোর চালক, বাসের ড্রাইভার-খালাসি, পুরোনো কাগজের ফেরিওয়ালা, পাড়ার দর্জির দোকানের কর্মচারী, বাসন বিক্রেতা, জঙ্গল পরিষ্কার/বাগান পরিষ্কার/বহুতলে খাবার জল তুলে দেওয়া বা এই ধরণের নানা কাজ করে পেট চালানো মানুষ, যাদের অড জব ম্যান বলে, রোল-চাউমিন-চপের দোকানি— এঁরা সবাই, সক্কলে সামলে নিতে পারবেন তো এই ক’মাসের বেরোজগারের ধাক্কাটা?
ভাবতে ইচ্ছে করল, রাষ্ট্রের সাহায্য নিশ্চয় আসবে— এঁরা তো রাষ্ট্রেরই সন্তান, আমাদেরই মতো। আমরা হয়ত এই রোগ-যুদ্ধে ফ্রন্ট লাইনার, কিন্তু আমাদের শ্রম অনেক সুরক্ষিত, দাবিদাওয়াগুলো নিয়ে চিৎকার করার একাধিক প্ল্যাটফর্ম রয়েছে আমাদের— সবটুকু না হোক, কিছুটা আমরা আদায় করেই ছাড়ি। হ্যাঁ, তার সবটাই নিজেদের স্বার্থে নয়, অনেকটাই বৃহত্তর সামাজিক স্বার্থে। তবু, এই ঝড়ে কোথাও একটা দাঁড়াবার জায়গা বোধ হয় আমাদের আছে।
কিন্তু এঁদের কি হবে?
চিন্তাটা অস্বস্তিকর, তাই বেশিক্ষণ এটা নিয়ে ভাবতে ভালো লাগল না।
হাসপাতালে, হাজার অনিশ্চয়তার মধ্যে, সবথেকে বেশি করে যেটা দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফেলছিল কপালে, সেটা হলো রক্তের অভাব।
এই সময়ে সামাজিক দূরত্বের রাষ্ট্রীয় নির্দেশ মেনে রক্তদান শিবির করা যে অসম্ভব, সেটা বুঝতে পারছিলাম। আর বুঝতে পারছিলাম, যে রোগীরা নিয়মিত রক্তের চিকিৎসার উপরেই নির্ভরশীল, তাদের প্রয়োজনটা যতই লকডাউনের জগদ্দল পাথরের নিচে চাপা দেওয়া থাকুক না কেন, খুব শিগগির সেই অতৃপ্ত চাহিদার বিস্ফোরণ ঘটবে, আর অপ্রস্তুত ব্লাডব্যাংককে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে হবে, হাতিয়ারের অভাবে থ্যালাসেমিয়া আর অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইটাই করা গেল না তেমন করে।
দুশ্চিন্তাটা হালকা করে দিল একটা অর্ডার। এমনিতে গভর্নমেন্ট অর্ডার দেখলেই আমার হৃৎকম্প শুরু হয়— না জানি কি তুঘলকি ফরমান আবার নিশ্চিন্দির চাকরিটার দফা রফা করে দেবে রে বাবা— তবে আজকের অর্ডারটা এক ঝলক স্বস্তির হাওয়া নিয়ে এলো গুমোট ব্লাড ব্যাংকে।
রাজ্য সরকারি নির্দেশে সমস্ত থানা আর কমিশনারেটের পুলিশকর্মীরা রক্তদান করবেন, কলকাতা ও জেলার বিভিন্ন ব্লাড ব্যাংকের ক্রাইসিস মেটাতে। হ্যাঁ, সোশ্যাল ডিস্টান্সিং মেনেই।
অর্ডারের খুদে খুদে অক্ষরগুলোর উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে দেখলাম মেডিক্যাল কলেজ ব্লাডব্যাংকের ভাগ্যে তিনটি শিবির জুটেছে। এপ্রিলের ছ’ তারিখ দুটি, একটি উত্তর চব্বিশ পরগণার জগদ্দল থানায়, অন্যটি নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে, কলকাতা পুলিশের উদ্যোগে। আর এপ্রিলের সাত তারিখে তৃতীয় শিবির, ঐ নেতাজি ইনডোরেই।
আমাদের ডিরেক্টর স্যার অনুমান করলেন তিনটি শিবির থেকে অন্তত একশো কুড়ি ইউনিট রক্ত আমরা পাবো।
উল্লসিত হতে চাইলাম, কিন্তু মনে পড়ে গেল মেডিক্যাল কলেজ ব্লাডব্যাংকের প্রতি মাসের সংগ্রহ হচ্ছে গড়ে তিন হাজার ইউনিট—এই দুর্যোগের আগে, জানুয়ারি ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্তও তাই ছিল।
মুহূর্তের জন্য একটা আনমনা দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গতে, ‘জলসাঘর’-এর বিশ্বম্ভর রায়ের সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করলাম যেন।
ফেরার পথে, বাড়িতে কি কি সামগ্রী ফুরিয়েছে, তার লিস্ট করছিলাম মনে মনে। ক্রিম ক্র্যাকার বিস্কুট খুঁজে খুঁজে পাচ্ছি না ক’দিন, ওটা ছাড়া মায়ের আবার চলে না, আজ জোর তল্লাশ করতে হবে। ডিম নিতে হবে ক’টা, সার্ফ ফুরিয়েছে—হবে না, যা কাচাকুচির ধুম পড়েছে! ওহ, সার্ফের কথায় মনে পড়ল, গায়ে মাখা সাবানও লাগবে— এদিকে বসার ঘরের দেওয়াল ঘড়িটা দু’দিন হলো বন্ধ হয়ে রয়েছে, ব্যাটারি খতম—আজ পেন্সিল ব্যাটারি নিতে হবে মনে করে—বন্ধ ঘড়ি দেখলেই আমার বুকে কেমন চাপ লাগে, ভালো লাগে না—
চিন্তার জাল ছিঁড়ল হোয়াটস্যাপের টুংটাং আওয়াজে। মেসেজ। ব্লাড ব্যাংকের গ্রুপে। হেড অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট মেসেজ করেছেন, আজ কলেজ কাউন্সিলের মিটিংএ সিদ্ধান্ত হয়েছে যে মেডিক্যাল কলেজে ইমার্জেন্সি রোগী ভর্তি আবার চালু হবে, চালু হবে স্বাভাবিক আউটডোরও। জনবহুল এলাকা হওয়ার কারণে, ‘রাজ্যের একমাত্র করোনা হাসপাতাল’ হিসেবে চিহ্নিতকরণ আপাতত স্থগিত রইল। সব ধরণের রোগীই আবার দেখা আরম্ভ হবে এখানে। সমস্ত পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ট্রেনি, হাউস স্টাফ ও ইন্টার্নদের কোভিড পূর্ববর্তী ডিউটি শিডিউলে ফিরতে বলা হয়েছে। যদিও, যাকে ইলেক্টিভ ওটি বলে, মানে আগে থেকে স্থির করা অস্ত্রোপচার, বা নন ইমার্জেন্সি কোল্ড কেস, সেগুলোর চিকিৎসা হয়ত এখনই আরম্ভ হবে না, তবু, এই বা কম কি?
মৃত্যুসম স্থবিরতা থেকে জেগে উঠলে বুঝি এমনই অনুভব হয়! মনের যাবতীয় জড়তা কাটিয়ে উঠে, স্কার্লেট ও’হারার মতো ভাবতে ইচ্ছে করল — Tomorrow is another day.
(চলবে)