একটা লোক জীবনের বেশির ভাগ সময় জুড়ে পয়সার বিনিময়ে অভিনয় করেছেন- কোন বাছবিচার না করেই করেছেন। বেশির ভাগ গল্প জুড়ে আছে গুণ্ডাদের জাতে তুলে দেওয়ার ফিকির, নানারকম অপ্রয়োজনীয় গল্পের মোড়কে যেমন করে মায়েরা শিশুদের খাইয়ে দেন, অনেকটা সেরকম–পুলিশ মানে ঘুষখোর আর গুণ্ডা কিন্তু লুটেরার ভেতর আছে একটা দরদী মন বা পুলিশ অফিসারটি ভালো কিন্তু গুণ্ডাটি ততোধিক ভাল! গুণ্ডা গুণ্ডা হয়েছে কারণ সমাজ থেকে সে কিছু পায়নি, সমাজের পক্ষপুটে তার আশ্রয় জোটে নি।
অমিতাভ অভিনীত রাগী যুবকের এই তো স্টোরি লাইন, একান্ত ক্লিশে এক একটা বাজে গল্প, তার সাথে বলিউডি মশালা, শরীরি নাচ, মদ্যপান আর কুৎসিৎ বেলেল্লাপনা। এর জন্য হল হাউসফুল, ব্ল্যাকে টিকিট কেটে অল্পবয়সী বেলবটম পরা ছোকরার দল। অথচ, অন্যায় অবিচার আর ভ্রষ্টাচারের বিরুদ্ধে সংগঠিত সংগ্রাম বাস্তব সত্য। তাকে মানুষের অন্তর থেকে নির্বাসিত করার জন্য এমন একটি বিনোদন যা মানুষের চিন্তাশক্তিকে পঙ্গু করে তোলে। অমিতাভ তাঁর অভিনয় প্রতিভার প্রতি সুবিচার করেননি। তিনি এমন কিছু করেননি যার জন্য মানুষ তাঁকে মনে রাখবে অন্ততঃ কিছুকাল।
তিনি সেই অমিতাভ, লোকটি পয়সার জন্য ডিটারজেন্ট থেকে সোনার বন্ধকি কারবার সব কিছুর জন্য নিজেকে বিক্রি করে ফেলেন। আম জনতা মনে মনে বিরক্ত হলে তিনি আসেন “শিশুর হাজার দিন” নিয়ে- নিখুঁত বিজনেস স্ট্রাটেজি। তিনি যে শক্তির নতুন সূত্র আবিষ্কার করে ফেলবেন, অমাবস্যায় কিভাবে অশুভ শক্তি আসে আর ঘন্টা বাজিয়ে হারমোনিক ভাইব্রেশন তৈরী করে ভাইরাস তাড়াতে হয় সেটা নিয়ে মত ব্যক্ত করবেন তাতে আর আশ্চর্য কি?
প্রশ্ন হলঃ করোনা চিকিৎসার বলি 106 জন চিকিৎসাকর্মীর জন্য আমরা কিছু ভেবেছি? এই তো সেদিন একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞ করোনার বলি হয়ে চলে গেলেন। কে ফেলেছে তাঁর জন্য দুফোঁটা চোখের জল। এই সেদিন এইমসের একটা বাচ্চা ছেলে করোনা রোগীকে বাঁচাতে গিয়ে পিপিই খুলে ফেলতে বাধ্য হল, তারপর নিজেই আক্রান্ত হল। কোন টুইট, নেতা মন্ত্রী শান্ত্রীদের একটু আহাউহু! না, সে আশা বৃথা! ডাক্তার নাকি অর্থঘৃধ্নু আর এম এল এ-র পনের কোটি দর যারা দেয় আর যারা ঐ মূল্যে বিক্রি হয় তারা হল সমাজের মাথা। এসবও ঠিক আছে কিন্তু অমিতাভরা যখন নিজেই সেই রাজনীতির কোন্দলে টর্চবাহক হ্ন তখন আসে ক্রোধ ও বিবমিষা!
কম উপসর্গ বা উপসর্গহীন হলেও তাঁর জন্য আম্বানিদের হাসপাতালে জায়গা বাঁধা। এ তো গানের মাস্টার নয় যে নিজেকে নিংড়ে ছাত্র তৈরী করেছে কিন্তু ভাঁড়ে মা ভবানী বা কোন মেডিকেল কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক নয় যে একটা সামান্য পরীক্ষা করাতেই কালঘাম ছুটে যাবে! এ হল হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক একজন চতুর অভিনেতা!
আমাদের তুলসী চক্রবর্তী কথা ভাবুন! শুধু বিশ্বমানের অভিনেতা বললে কম বলা হয়- চরম দারিদ্রে দিন কাটিয়েছেন, কেউ কি তাঁর জন্য দু ফোঁটা চোখের জল ফেলেছিল? এ কে হাঙ্গল তো বোধহয় অনাহারে মারা গেছেন। পারভীন বাবি উপবাসে প্রাণত্যাগ করেছিলেন, মিনা কুমারী হাসপাতালের বিল মেটাতে পারেননি। একটা গুগল সার্চ করলেই আরো কত নাম ভেসে আসবে- ভারত ভূষণ, ও পি নাইয়ার…। অমিতাভ সারা জীবন মারদাঙ্গার ছবি করেছেন, সেখান থেকে সমাজের প্রাপ্তি কী কে জানে! আমাদের গীতা দে, রবি ঘোষরা এত বড় বড় অভিনেতা, জীবনে কিছুই পেলেন না! তাঁদের কি সম্মান দিয়েছে এই অমিতাভ ভজনায় ব্যস্ত সমাজ?!
আমরা ভাবছি আর দুঃখের ইমোজি দিয়ে ফেসবুক স্টাটাস লিখছি- এই ১৮-র সদ্য তরুণ কি অপরাধ করেছিল যে এভাবে তাকে অকালে চলে যেতে হল? শুভ্রজিতের একমাত্র অপরাধ সে এই ক্ষয়িষ্ণু সমাজে জন্মেছে অথচ তার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা নেই। এই নির্দয়, নির্মম সমাজে তার বাবা মা তাকে ভালো মানুষ করে গড়ে তুলতে চেয়েছিল, চোখ রাঙিয়ে তারা অধিকার আদায় করতে পারে নি। তার আরো বড় অপরাধ সে আমাদের মত ক্লীব মানুষের মধ্যে জন্মেছে- সে বা তারা সবাই যারা আমাদের অজান্তে ১ বছর হওয়ার আগে হাজারে ২৫ জন করে মরে যাচ্ছে, হাজার হাজার শিশু অপশিক্ষা শিখছে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে, আরো হাজারে হাজারে চায়ের দোকানে, ইঁটের ভাটায়, বিড়ি বাঁধার কাজে শৈশব কৈশোর বিসর্জন দিচ্ছে। ঠুলি পরা বিবেক নিয়ে আমরা পালাবদলের স্বপ্ন দেখছি। মানুষের মধ্যে যদি চেতনার স্ফূরণ না হয়, ভেতরের সব ক্ষোভ যদি জমাট বরফ হয়ে ওঠে, সেখান থেকে যদি প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে অগ্নুৎপাত না হয় তাহলে পালাবদলেও দিন বদল হবে না।
শুভ্রজিতের মৃত্যুর জন্য আমরা সবাই দায়ী। আমরা যারা বচ্চনের জন্য ব্যাকুল হৃদয়ে প্রার্থনা করছি তারা দায়ী। আমরা যারা কখনো বলি নি কেন শয্যা কম, যারা ভাবি নি স্বাস্থ্যব্যবস্থার জন্য কেন টাকা নেই অথচ মূর্তির টাকা অক্লেশে জোগাড় হয় তারা সবাই অল্প করে দায়ী। আমরা ধর্ম-জাত-বর্ণ ভেবে ভোট দিই তখন কখনো ভেবেছি অসুস্থ হলে বেড পাবো কিনা? নিজের ছোট ছোট বাচ্চাদের যখন অপরকে ঘৃণা করার শিক্ষা দিয়েছি তখন কখনো ভেবেছি বড় হয়ে সে কত স্বার্থপর হবে? তার হৃদয় কি মানুষের দুঃখে কাঁদবে না, সে পেছন ফিরে দেখতে চাইবে কান্নাটা ধর্মের প্রাচীর ভেদ করিয়ে হৃদয় থেকে উৎসারিত হবে কিনা! আমরা ভাবি নি, কারণ নির্মমতা ও নির্দয়তার শিক্ষা আমরা দিই ও তার পেছনে যুক্তিও খাড়া করি। চিকিৎসক এই সমাজ থেকেই উঠে আসে, তার সব ভালো মন্দ সব কিছু নিয়ে।
তারপরও একদল চিকিৎসক সবকিছু ফেলে সুন্দরবনে ছুটে যান মানুষের সেবা করবেন বলে। দেখি মেডিকেলের ছাত্রছাত্রীরা সাধারণ মানুষের চিকিৎসার দাবীতে আন্দোলন করেন। শ্রমজীবী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে একদল চিকিৎসক নামে মাত্র অর্থ নিয়ে সারাজীবন কাটিয়ে দিতে পারেন! আশির দশকের জুনিয়ার ডাক্তার আন্দোলনের একদল নেতা কর্মী ছুটে গেছেন ভোপাল, ছত্তিশগড়, কালাহাণ্ডি আরো কত কত জায়গায়। কেউ কেউ নিজের সর্বস্ব ঢেলে দিয়েছেন সামাজিক প্রতিষ্ঠানে।
তাই বলে কি খারাপ নেই? আমরা অনেকেই নিজের সামাজিক দায়িত্ব ভুলে যাই। আমি বৃদ্ধ ডাক্তারকে ট্রলিতে শুয়ে বুকের ব্যথায় কাতরাতে দেখেছি- তার জন্য বেড ব্যবস্থা করতে পারি নি। আমি অসুস্থ পঙ্গু সন্তান নিয়ে ডাক্তারকে আউটডোরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। তাঁর পূর্বতন কলিগরা ফিরেও তাকাননি। ভালো মন্দ সব সমাজে আছে। একের জন্য পুরো সম্প্রদায়ের উপর দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়।
আমাদের এই সম্মিলিত ক্ষোভ কিন্তু ক্ষণস্থায়ী, কখনো ফেসবুকের বাইরে এর কোন অস্তিত্ব নেই। ক্ষোভের পাহাড় নিয়ে বিজয়ের মত ধ্বংসের মিসাইল হতে হবে না, বরং ক্ষোভের উৎসমুখ সঠিক দিকে ধাবিত করে মানুষের আন্দোলনে সামিল হতে হবে। সমাজের খোলনলচে পাল্টে দিতে হবে। তার জন্য চাই দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলন। যে আন্দোলন মানুষের ছোট ছোট চাওয়া পাওয়ার দাবী করবে, দাবী করবে শিক্ষার অধিকার, বাসস্থানের অধিকার, খাদ্যের অধিকার, স্বাস্থ্যের অধিকার, সম্মানজনক ভাবে বাঁচার অধিকার। এই অধিকার সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার। এ যদি আদায় না করতে পারি শত শত শুভ্রজিতের প্রাণ অকালে চলে যাবে। এই নির্মম নির্দয় রাষ্ট্রব্যবস্থা তার দিকে ফিরেও তাকাবে না। স্বাস্থ্য আমাদের জন্মগত অধিকার। সেই অধিকার যতদিন ছিনিয়ে আনা না যায়, ততদিন অনেক শুভ্রজিতরা স্রেফ বিনা চিকিৎসায় মরে যেতে পারে। সমাজের ভাবনা বদলে ফেলতে হবে, সমাজটাকেই পাল্টে দিতে হবে।
দারুন আবেগপ্রবন ও সময় উপযোগী। আমরা কি পারি না জাতি ধরম নির্বিশেষে একটি অরাজনৈতিক মঞ্চ গড়ে তুলতে যাতে আর কোনো শুভজিৎতের অকালে চলে যাওয়া রোধ করতে পারি। সাধারণ মানুষ একত্রিত হলে শুধু হবে না এগিয়ে আসতে হবে আপনাদের। সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে হবে।