পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন কেন আট দফায় করতে হচ্ছে তা নিয়ে রাজনৈতিক তরজা প্রথম থেকেই তুঙ্গে। গত দু সপ্তাহে করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ তীব্রতর হওয়ায় তা এক অন্য মাত্রা পেয়েছে। এই মুহূর্তে বঙ্গ জীবনে কোভিড শুধুমাত্র অতিমারির কারণ নয় তা নির্বাচনী সঙ্কটও বটে। তাই প্রচার থেকে শুরু করে নির্বাচন পরিচালনা সবেতেই কোভিডের ছায়া, এমনকি করোনা আক্রান্ত হয়ে প্রার্থীদের মৃত্যু পর্যন্ত হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে রাজনীতির বাইরেও অতিমারি মোকাবিলায় তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন জননীতির (পাবলিক পলিসি) মূল্যায়নে উঠে আসছে; কেন এই দ্বিতীয় ঢেউ, টিকার অপ্রতুলতার কারণ, এবং অতিমারির মধ্যে নির্বাচন পরিচালনায় কমিশন কতটা দক্ষ।
অতিমারির শুরু থেকে আজ অবধি করোনা ভাইরাসের দৈনিক সংক্রমণ চলতি বছরের জানুয়ারির শেষের দিকে থেকে ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত সবচেয়ে কম ছিল। তারপর থেকে আবার বাড়তে থাকে। সবমিলিয়ে এই দ্বিতীয় ঢেউয়ে এখন পর্যন্ত (২৩ ফেব্রুয়ারী থেকে ১৮ এপ্রিল ২০২১) আনুমানিক ৩১ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন, এবং দৈনিক সংক্রমণের নিরিখে ভারতবর্ষ এই মুহূর্তে পৃথিবীতে পয়লা নম্বরে। প্রথম ঢেউয়ের তুলনায় দ্বিতীয় ঢেউয়ে সংক্রমণের হার অনেকটাই বেশি। প্রথম দু মাসে দৈনিক সংক্রমণের সংখ্যা দ্বিগুন হতে প্রথম ঢেউয়ে যেখানে গড়ে ২৮ দিন লেগেছিল, তা এখন ১০ দিনে হচ্ছে।
ভাইরাস ক্রমাগত চরিত্র-বদলে বিভিন্ন ভেরিয়্যান্ট বা প্রকারভেদ বাইরে থেকে দেশে এসেছে, বা তৈরি হয়েছে— তা সবাই দ্বিতীয় ঢেউকে সংক্রমণের হারের বিচারে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে। অথচ ভারতে ব্রিটেন ভ্যারিয়েন্ট-এর সংক্রমণ প্রথম ধরা পড়ে ২০২০ এর ২৯ ডিসেম্বার এবং পরের ষোলদিনে আরও ১০৯ জন ঐ একই ভ্যারিয়েন্ট-এ আক্রান্ত হয়। আশ্চর্যজনক ভাবে তার পরেও দেশের এপিডেমিক ইন্টেলিজেন্স ব্রিটেন বা অন্নান্য ভ্যারিয়েন্টকে অতি সংক্রামক হওয়া থেকে রুখতে ব্যর্থ হয়। কারণ জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে সংক্রমণ তলানিতে ঠেকলে পর মহামারি রোখার আপদকালিন শর্তগুলোই(স্ক্রিনিং-ট্রাকিং-টেস্টিং এবং যথাযথ প্রচার) শিথিল হয়ে যায়। তাছাড়া ভাইরাসের ভ্যারিয়েন্ট চিহ্নিতকরণে যে ‘জিনোম সিকুএন্সিং’ (যা রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা-প্রনালিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়) এর দরকার হয় তাও দেশের অতিমারি পরিকল্পনায় স্থান পায়নি। ২০২১-এর প্রথম তিন মাসে সমস্ত কোভিড পজিটিভের মাত্র এক শতাংশেরও কম স্যাম্পেলের ল্যাবরেটারিতে জিনোম সিকুএন্সিং হয়েছে। তাই এপিডেমিক ও জেনেটিক সারভিলিয়েন্সের ব্যর্থতাতেই ভাইরাস বিবর্তন-পরিবর্তন এর মাধ্যমে গোষ্ঠী সংক্রমণের সৃষ্টি করেছে।
এটা বোঝা দরকার মহামারি রোখাটা জায়গা বিশেষে (যেমন কোন শহর বা তার অংশ বিশেষ) একটা আপদকালিন ব্যবস্থা কিন্তু অতিমারির সঙ্গে লড়াই একটা দীর্ঘকালীন যুদ্ধ যেখানে ভৌগলিক সীমারেখা থাকে না। অতিমারিতে সংক্রমণ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছড়ায়। তাই ভারতের মত বৃহৎ দেশে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের সমন্বয় ছাড়া এই যুদ্ধ জেতা সম্ভব নয়। আজ পর্যন্ত জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কোন কেন্দ্র-রাজ্য সমন্বয় সমিতি তৈরি হয়নি যা দেশ জুড়ে অতিমারি পরিস্থিতি সর্বক্ষণ নজরে রাখবে ও রাজ্য/স্থান বিশেষে মহামারির সম্ভাবনা নিয়ে নিরন্তর বিশ্লেষণ ও পরিকল্পনা প্রদান করবে। তাই ফেব্রুয়ারির শেষ থেকে ধারাবাহিক ভাবে ধীর গতিতে সংক্রমণ বাড়তে থাকার পরও সারা মার্চ মাসে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে একবারও আন্তঃ-রাজ্য যাতায়াতে রাশ টানা এবং স্থানিক ভাবে রাজনৈতিক/সামাজিক/ধর্মীয় কারনে জমায়েতের উপর কোন সতর্কতা জারি করা হয়নি।
কেন্দ্র ও রাজ্য স্তরে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে যে টাস্ক-ফোর্স ও উপদেষ্টা মণ্ডলীগুলি আছে তারা মূলত নিজ-নিজ সরকারকে ‘রেসপন্স ম্যানেজমেন্টে’ (চিকিৎসা পরিকাঠামো, টিকাকরণ, টেস্টিং কৌশল) নীতি নির্ধারণে সাহায্য করছে কিন্তু মহামারি রোধের (এপিডেমিক প্রিপেইয়ার্ডনেস) ক্ষেত্রে আন্ত-রাজ্য ও কেন্দ্র-রাজ্য পরিকল্পনায় কোন সম্মিলিত প্রয়াসে সামিল হচ্ছে না। বিভিন্ন রাজ্যে অক্সিজেন বণ্টন ব্যবস্থা ভেঙে পড়া এর সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ। প্রসঙ্গত কেন্দ্র ও রাজ্যের মন্ত্রি-আমলাদের যৌথ মিটিং-এ প্রসাশনিক কর্মপদ্ধতি আলোচনা করা যায়, কিন্তু জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ছাড়া এপিডেমিক ইন্টেলিজেন্স বিশ্লেষণ করা যায় না। তাই দ্বিতীয় ঢেউ প্রাথমিক ভাবে কেন্দ্র-রাজ্য সমন্বয়হীনতা ও সর্বোপরি এপিডেমিক ও জেনেটিক ইন্টেলিজেন্স সঠিকভাবে ব্যাবহার না করার পরিনাম। ফলস্বরুপ মিনি-লকডাউন, রুগি বৃদ্ধির জন্য চিকিৎসা পরিকাঠামোর ভেঙে পড়া, অগুন্তি মৃত্যু ও সামাজিক ভাবে অর্থনৈতিক অসাম্য বাড়ার ভ্রুকুটি আবারও দেখতে হচ্ছে।
ভাইরাসের বিরুদ্ধে এই অসহায়তার হাত থেকে রক্ষা পেতে টিকা অন্যতম রক্ষাকবচ। কিন্তু টিকার অপ্রতুলতা সারা দেশেই রাজনৈতিক অস্থিরতার সৃষ্টি করেছে। অনেক বিরোধী দলই সরব কেন ভারত সরকার আগে নিজের দেশের মানুষের চাহিদা না মিটিয়ে বিদেশে টিকা পাঠাচ্ছে। এটা সত্যি যে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত দেশে যত টিকা উৎপাদন হয়েছে তার প্রায় ৪০ শতাংশ বাণিজ্যিক এবং মানবিক স্বার্থে ৮৪টি বাইরের দেশে পাঠানো হয়েছে। উল্টোদিকে এটাও বাস্তব যে এখনও পর্যন্ত পৃথিবীতে ১০০-র অধিক গরিব দেশে টিকার একটা ডোজও পৌঁছয়নি কারন উচ্চ-আয়শীল দেশ গুলো সব টিকা নিজেদের নাগরিকদের জন্য সুরুক্ষিত করছে। তাই বৈদেশিক কূটনীতির বাইরে গিয়েও ভারত যে সংকীর্ণ ‘টিকা জাতীয়তাবাদ’ -এ আটকে না থেকে বিশ্বমানবতার উদাহরণ হয়ে উঠছে তা প্রশংসনীয়।
টিকার অপ্রতুলতার কারণ টিকা উৎপাদক সংস্থাগুলোর কম উত্পাদনশীলতা এবং তাদের সঙ্গে সরকারের আগ্রিম চুক্তি না হওয়ার ফল। তাই টিকা-প্রতি ডোজে বনিবনা না হওয়ায় কোভিশিল্ড উৎপাদনকারি সেরাম ইন্সটিটিউট উৎপাদন বাড়ানোর জন্য বাড়তি মূলধন তার লভ্যাংশ থেকে না বিনিয়োগ করে কেন্দ্র সরকারের কাছ থেকে অনুদানের (তিন হাজার কোটি টাকা) ভিত্তিতে পেতে চেয়েছে। বর্তমানে মাত্র তিনটি সংস্থা দেশে করোনা ভাইরাসের টিকা উৎপাদনে যুক্ত। অথচ কেন্দ্রীয় সরকার যদি এই সংকটময় মুহূর্তে জনস্বার্থের উদ্দেশে পেটন্টে নীতির সাময়িক পরিবর্তন করে ‘বাধ্যতামূলক লাইসেন্স’ নীতি আরোপ করে তাহলে দেশের অন্যান্য টিকা উৎপাদক সংস্থাও উৎপাদনে অংশগ্রহণ করতে পারে। সেক্ষেত্রে সরকারের কোষাগারও বাঁচবে আবার টিকার ঘাটতিও অচিরেই কমবে। কিন্তু সংগঠিত পুঁজির বিরুদ্ধে এই রাজনৈতিক সদিচ্ছা বিরল তাই কেন্দ্রীয় সরকার টিকার বাজারিকরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে যেখানে রাজ্যগুলি ও সাধারন মানুষকে সরাসরি টিকা কেনার প্রতিযোগিতায় নামতে হবে। বলাবাহুল্য টিকার যোগান ও চাহিদায় সামঞ্জস্য না থাকায় এই নীতি টিকাকরণ প্রক্রিয়াকে আরও বিলম্বিত করবে।
টিকাকরণে কিছু কৌশলগত পরিবর্তনও জরুরি। আমরা যদি রাজ্য-ওয়ারি কোভিড-১৯ রোগের প্রাদুর্ভাব (prevalence rate) দেখে টিকাকরণ প্রক্রিয়ায় অগ্রগতি মাপি তাহলে দেখব ত্রিপুরা বা সিকিমের মত রাজ্যে যেখানে রোগের প্রাদুর্ভাব কম সেখানে মোট জনসংখ্যার অনুপাতে টিকাকরণের হার অনেক বেশি। বিপরীতে মহারাষ্ট্র বা দিল্লির মত বেশি প্রাদুর্ভাব যুক্ত রাজ্যে টিকাকরনের হার মোট জনসংখ্যার অনুপাতে তুলনামূলক ভাবে অনেক কম। দেশে এখন ‘বয়স ভিত্তিক রিস্ক-গ্রুপিং’ করে টিকা প্রদান হচ্ছে যেখানে রোগের প্রাদুর্ভাব নয় বরং ব্যক্তির বয়স ও ক্লিনিকাল হিস্ট্রি (কো-মরবিডিটি) হল রিস্ক নির্ণয়ের মাপকাঠি। তার বদলে রোগের প্রাদুর্ভাব দেখে ‘শহর/জেলা/রাজ্য ভিত্তিক রিস্ক-গ্রুপিং’ করে সেখানে সকল বয়েসের মানুষের টিকা প্রদান কর্মসূচি নিলে ভবিষ্যতে সংক্রমণ রোখার ক্ষেত্রে জনস্বাস্থ্যের বিচারে তা অনেক বেশি কার্যকরী হবে।
তবে একথা বলা প্রয়োজন যে বর্তমানে টিকার অপ্রতুলতার সাথে দ্বিতীয় ঢেউয়ের কমা বা বাড়ার কোন সম্পর্ক সেভাবে নেই। টিকাকরণের শুরুর থেকে (১৬ জানুয়ারি ২০২১) থেকে ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত ভারতের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১.২ শতাংশ মানুষ টিকার দুটো ডোজই পেয়েছে এবং ৭.৮ শতাংশ মানুষ একটা ডোজ পেয়েছে। সাধারণত দুটো ডোজ নেওয়ার দুসপ্তাহ পরে ভাইরাসের সংক্রমণের বিরুদ্ধে শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে। তাই এটা বলাই যায় যে বর্তমান টিকাকরণের প্রক্রিয়া দ্বিতীয় ঢেউকে সঙ্কুচিত করতে পারবে না, বরং ভবিষ্যতের ঢেউ কে আটকাতে সাহায্য করতে পারে।
পরিশেষে অতিমারির মধ্যে আট দফা নির্বাচন নিয়ে যে বিতর্ক উঠছে তাতে কমিশনের ভূমিকা না দেখে জনসাস্থ্যের সাথে নির্বাচনী প্রশাসনিকতার যে সম্পর্ক তার মূল্যায়ন হওয়া উচিত। পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক হিংসার যে পরম্পরা আছে তাতে গণতান্ত্রিক মত প্রকাশের অবাধ ও সুস্থ ব্যবস্থা করতে আট দফা নির্বাচনের সিদ্ধান্ত বোধহয় আইন ও প্রশাসনের চোখে যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু এই দফা গুলোতে নির্বাচনী বিন্যাস জেলা ভিত্তিক করার বদলে বিধানসভা ভিত্তিক করা হয়েছে। তাই বিভিন্ন জেলায় দু-দফায় এমনকি তিন দফায় নির্বাচন হচ্ছে। এর পেছনে কোন প্রশাসনিক যুক্তি আছে জানা নেই, কিন্তু জনস্বাস্থ্যের নিরিখে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাওয়া মুশকিল। যদি জেলা ভিত্তিক বিন্যাসের মাধ্যমে উত্তর বঙ্গ থেকে ধাপে ধাপে আটটা দফায় দক্ষিণ বঙ্গে নামা যেত (বা উল্টোটা) তাহলে একই জেলায় বার বার রাজনৈতিক জমায়েত ও একসঙ্গে অনেক মানুষের আনাগোনা অনেকদিন ধরে হত না। এখন একই জেলাতে বিভিন্ন দফায় নির্বাচন রাখায় মানুষের জমায়েত ও যাতায়াত একাধিক বার হয়েছে যা এই দ্বিতীয় ঢেউ চলাকালীন অত্যন্ত বিপদজনক। অতিমারি সময়ে নির্বাচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক প্রক্রিয়া জনস্বাস্থ্য পরামর্শ মেনে হওয়া আবশ্যক।
অতিমারি থাক বা না থাক জনস্বাস্থ্যর গুরুত্ত্ব জননীতিতে কম হলে তা সমাজ, অর্থনীতি ও সর্বোপরি রাজনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করে। একই সঙ্গে চলা কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ ও পশ্চিমবঙ্গের আট-দফা নির্বাচন তা আবার মনে করিয়ে দিচ্ছে।
এই লেখার অংশবিশেষ আনন্দবাজার পত্রিকায় ২৯ এপ্রিল ২০২১ এর উত্তর-সম্পাদকীয় নিবন্ধে প্রকাশিত হয়েছে।