ওই যে দেখছেন উস্কোখুস্কো চুলের ছেলেটা ছুটে বেড়াচ্ছে ওয়ার্ডের এমাথা থেকে ওমাথা… কিংবা ওই যে মেয়েটা দুদ্দাড় করে সিঁড়ি ভাঙতে গিয়ে হোঁচট খেল… ওদের চেনেন? ওরা সরকারি মেডিক্যাল কলেজের জুনিয়র ডাক্তার। ইন্টার্ন, হাউসস্টাফ, পিজিটি। কতই বা বয়স? চব্বিশ-ছাব্বিশ কিংবা আরেকটু বেশি।
সকাল থেকে ওরা এক মুহূর্ত বসার সময় পায়নি। ব্লাড টানা, চ্যানেল করা, গলায় খাওয়ার নল পরানো, ড্রেসিং, ক্যাথেটার, খাতাপত্রের কাজ ইত্যাদি যাবতীয় জিনিস সামলে ওরা যখন কোমর সোজা করে উঠে দাঁড়িয়েছে তখন সূর্য মাঝগগন ছেড়ে বেশ খানিকটা পশ্চিমে ঢলেছে। সকাল থেকে জল খাওয়াও হয়নি। অনকল রুমে গিয়ে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে, মাস্ক খুলে জল খাওয়া মানে বিরাট ঝক্কির কাজ। ও হ্যাঁ, সাবানও থাকে না বেশিরভাগ সময়। পেচ্ছাব হলুদ। জ্বালা করে। ব্যস্ত সরকারি হাসপাতালে কোনোকিছুই হাতের কাছে পাওয়া যায় না। একটা রক্ত নেওয়ার জন্য সিরিঞ্জ বা নিডল, তুলো, স্পিরিট, চেটানোর টেপ ইত্যাদি সব বেঁধেছেঁদে জোগাড় করতে যে সময় লাগে সেই সময়ে একটা বড়সড় ঘুরতে যাওয়ার ব্যাগ গোছানো হয়ে যায়। গ্লাভস বা মাস্ক পাওয়া যায় না অনেক সময়েই। মাস্ক চাইতে গেলে এমন সব চাউনি জোটে যে মনে হয় বড় কিছু অপরাধ করে ফেলেছে তারা। হাতে-পায়ে ছুঁচ ফুটে যাওয়া তো প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। তবু ওরা ছোটে। হাসপাতালগুলো ওদের হাতেই চলে।
হাতের কাজ কিছুটা মিটলে ওরা বৈভবপূর্ণ অনকল রুমে যাওয়ার সুযোগ পায়। এক চিলতে ঘরে খান তিনেক লোহার খাট। কাঁচভাঙা জানলা দিয়ে পশ্চিমের চড়া রোদ এসে শেঁকে, ভেজে যায়। বৃষ্টির ছাঁটে বিছানা সপসপে। শীতের উত্তুরে হাওয়ার পাতলা কাপড়ের পর্দা লতপতিয়ে ওড়ে। হাড় কাঁপিয়ে যায়। মেঝেতে আরশোলার লীলাক্ষেত্র। দেওয়াল ভর্তি মাকড়সার ঝুল। বাতাসে কান পাতলেই মশার পোঁ পোঁ। চেয়ার, টেবিলে লাল পিঁপড়ের লম্বা লাইন। বিছানায় চিটচিটে তোষক। চাদরগুলো ছিঁড়ে না যাওয়া অব্দি পরিবর্তনের আশা নেই। এসবের মধ্যে একটাই ভালো দিক। বিছানায় জুনিয়র ডাক্তারদের জন্য খাবারের অপরিমিত আয়োজন। “অবশ্য খাবার খেতে নয়, খাবার হিসেবে।” ছারপোকার দল চব্বিশ-পঁচিশের তাজা রক্ত বড্ড ভালোবাসে।
তারপর সেই আড়ম্বরপূর্ণ হিসি-হাগু রুম। দরজা ঠেললেই আওয়াজ ওঠে- ক্যাঁচ! রাজারাজড়ার ব্যাপার তো… ওসব আসলে শুভ-আগমনের সানাই। দরজা খুব ধীরে ঠেলতে হয়। না জানি কখন ভেঙে পড়ে। ঢুকেই সামনে দামী বেলজিয়াম গ্লাসের আয়না। নিন্দুকে বলে, মাকড়সার ঝুলে কিছুই দেখা যায় না। এমনিতেই কাঁচের বিভিন্ন জায়গায় বিস্তর ফাট। ওদের কথায় কান দেবেন না। ওরা শিল্পকর্মের কিছু বোঝে না তাই ওরকম বলে। ওগুলো আসলে কাঁচের ওপর নক্সা কাটা। শিল্পরসিক না হ’লে ভাঙা কাঁচ বলে ভুল করা স্বাভাবিক। অথবা, সেই প্রাগৈতিহাসিক জাদুঘর সদৃশ কোমোড… শোনা যায়, ওখানে বিম্বিসারের আমলের বিষ্ঠাচর্চিত নক্সারও দেখা মেলে। কী তার রূপ! কী তার বর্ণ! হলুদের ওপর বাদামীর বিভিন্ন শেড। যেন বা মাইকেল এঞ্জেলোর চিত্রকলা! লোকচক্ষুর আড়ালে শুধুমাত্র জুনিয়র ডাক্তারদের মনোরঞ্জনের জন্যই এত আয়োজন। ফ্লাশের জলে ধুয়ে চিত্রকলা যাতে নষ্ট না হয় তার ব্যবস্থাও পাকা। টিপলে জল পড়ে না। শব্দ হয়- খট! অথবা জল মেঝে ভাসিয়ে বাইরে যায়। খুব খারাপ দিনে মাঝে মাঝে ফ্লাশ কাজ করে। মিনিট পনেরো গুড়গুড় আওয়াজ করে ঝিরঝিরিয়ে জল পড়ে। তাতে বিষ্ঠারাজি নড়ে ওঠে কিন্তু কালের অতল গহ্বরে তলিয়ে যায় না।
এই বিপুল সমারোহে ভরা অনকল রুমে ওরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে থাকে। ঘামে ভেজা শার্ট। জুতোটা ছিটকে পাঁচহাত দূরে। হাতে খাপখোলা পেন। শুধু স্টেথোস্কোপটা বড্ড যত্ন করে রাখা। গলায় কিংবা মাথার কাছে। কে জানে কেন ওটার প্রতি বড্ড মায়া ছেলেমেয়েগুলোর…
রাতবিরেতে ডাক আসে। সাতদিন বাড়িতে ফেলে রেখে ঠিক খাবি খাওয়ার আগের মুহূর্তে পেশেন্ট হাসপাতালে আসে। মাঝে মাঝেই মদ্যপ গুটকাখোর কিংবা লোকাল রাজনৈতিক নেতার সাড়ে বত্রিশ নম্বর চ্যালাদের দেখা মেলে- “দাক্তার কোতায় **? দাক্তার গুমোচ্চে? নাক ডাকিয়ে গুমোচ্চে নাকি? রুগির কিচু ওয়ে গেলে কিন্তু…” চব্বিশ-পঁচিশের ছেলেটি কিংবা মেয়েটি কাঁপা কাঁপা হাতে স্টেথো বসায়। প্রেসক্রিপশন লিখতে গিয়ে মনে পড়ে জয়েন্টে মেডিক্যালে পঁচানব্বই র্যাঙ্ক করার পর সাতটা ফুলের তোড়া পেয়েছিল সে।
আবার কখনও অন্যরকম সকাল হয়। সেই কোন গড়বেতা থেকে আট বছরের ছেলেটা নিউমোনিয়া নিয়ে ভর্তি হয়েছিল। আজ চোদ্দদিন বাদে ছুটি। দোহারা চেহারার বাবা শিরা ওঠা হাত তুলে কপালে ঠেকায়, চোখে জল। বাচ্চাটা ডাক্তারকে নিজের হাতে আঁকা একটা ছবি তুলে দেয়। ছবিতে অ্যাপ্রন পরা একটা চেহারা। বড় মমতায় পৃথিবীর সব কালো ধুইয়ে দিচ্ছে সে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে জুনিয়র ডাক্তারের।
আজ ওদেরও দিন। যদিও ওরা ছুটি পায়নি। ওরা আজও কাজ করবে। ওদের কাজ ‘ঘন্টা’য় বেঁধে দেয়নি কেউ।