শেষ সপ্তাহ দুয়েকে হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা কমেছে উল্লেখযোগ্য ভাবে। কিছুদিন আগেও জ্বরজ্বালা, র্যাশ, সর্দি-কাশি, পেট খারাপ মানেই করোনা ধরে নেওয়া যেত। হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ড থৈ থৈ করতো। অন্যান্য রোগী ভর্তি হলেও মূল নজরটা করোনার দিকেই থাকতো। রোজ রোজ সেই এক কথা, এক কাউন্সেলিং, আইসোলেশন ওয়ার্ডে যাওয়ার আগের সেই এক কান্নাকাটি… সব মিলিয়ে জীবনটা বিচ্ছিরিরকম একঘেঁয়ে হয়ে উঠছিল। সে দিক থেকে হাসপাতাল অনেকটা আগের ছন্দে ফিরছে।
আবার উল্টোদিকে ঘূর্ণিঝড় যশের অপযশ সামনে আসতে শুরু করেছে। ঝড় কেটে গেছে কিন্তু তার ক্ষত রেখে গেছে। এখন আর মিডিয়ার সেসব দেখার নেই। হাঁটু জলে সাঁতার কাটিয়ে কিংবা অনর্থক চিৎকার চেঁচামেচি করে টিআরপি বাড়ানোর খেলা নেই। অনেকেই বহুদিন হাসপাতালে আসতে পারেনি। সমস্ত ওষুধ বন্ধ। জিজ্ঞেস করলেই সোজাসাপ্টা উত্তর- “কী করি আসি বলেন… এক একবারে গাড়ি ভাড়া বাইশশো টাকা।” এ প্রশ্নের উত্তর সত্যিই আমার কাছে নেই। বিশেষত কিডনির রোগে যেসব বাচ্চাদের স্টেরয়েড দিয়ে চিকিৎসা হয় তাদের দফারফা। আগে যখন সবটা বুঝতাম না তখন বেমক্কা চেঁচামেচি করতাম- “হাসপাতালে না আসতে পারলে বাইরে থেকে কিনেও তো খাওয়াতে পারতে। প্রেসক্রিপশন তো সঙ্গেই ছিল।” বুঝতাম না, গ্রামের অধিকাংশ ওষুধ দোকানেই পাশ করা ফার্মাসিস্ট নেই। হাসপাতালে জেনেরিক নামে লেখা ওষুধ বোঝার ক্ষমতা নেই ওষুধ দোকানের ছেলেটির। বাজার চলতি ব্র্যান্ডের নাম লিখলে পাওয়া যাচ্ছে অথচ জেনেরিক নামে লেখা ওষুধ মিলছে না; এরকম হয়েছে বহুবার। এদিকে সরকারি জেনেরিক ওষুধের দোকান খুঁজতে গেলে মাইক্রোস্কোপের তলায় চোখ রাখতে হয়। ফলে হয় ওষুধ বন্ধ অথবা বাড়ির পাশের কোয়াক ডাক্তার, হোমিওপ্যাথ, কবিরাজ বা সবজান্তা দাদার পরামর্শে পুরো ঘেঁটে ঘ অবস্থা। যাদের ওষুধ কেনারই ক্ষমতা নেই তাদের কথা ছেড়ে রেখে বললাম। অনেকে আবার এক ধাপ এগিয়ে নিজেরাই চিকিৎসা শুরু করে দিয়েছেন। ভাবখানা এমন, ও ডাক্তার আর কী করবে? ওই তো এক ওষুধ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেয়। ওই এক ওষুধেরই যে কত রকমের কোর্স হয় সেসব নিয়ে ভাবতে ভাবতেই আইসিইউ-র ভেতরে ঢুকে আসি। এতগুলো বছর কাটলো। এখনো ডাক্তারির ‘ড’ টুকুও শিখিনি। অথচ কিছু মানুষ এত আত্মবিশ্বাস পান কোত্থেকে?
এখনো বর্ষা ভালোভাবে শুরুই হলো না ডেঙ্গি ভর্তি হতে আরম্ভ করেছে। আইসিইউ-র বাচ্চাটার অবস্থা বেশ আশঙ্কাজনক। পেটে বুকে জল জমেছে। পেচ্ছাব কমে আসছে। ছটফট করছে আর চিৎকার করছে- “ও ডাক্তার, কাল বাড়ি যাবো? ও ডাক্তার, জল খাবো?” আমি নৈর্ব্যক্তিক ভাবে চোখ রেখে চলি রক্তচাপে, হৃদস্পন্দনে, থার্মোমিটারে। বামদিকে কোণের বাচ্চাটা শ্বাসকষ্টে নীল হয়ে যাচ্ছে। যন্ত্রচালিতের মতো গলায় নল পরাচ্ছি, হাওয়া ভরা ব্যাগ পাম্প করছি, বাড়ির লোককে ডেকে জানাচ্ছি। আগে এসব কাজ করতে ভীষণ উত্তেজনা হ’ত। দিনের পর দিন রোগ আর মৃত্যুর মাঝে থাকতে থাকতে সবকিছু কেমন অভ্যাসের মতো হয়ে আসছে। ডিউটিতে থাকাকালীন কাজে ঢিলেমির প্রশ্নই নেই কিন্তু ওই যে একটা যুদ্ধে-টুদ্ধে যাচ্ছি; এরকম একটা ব্যাপার মনে হ’ত সেটা কেটে গিয়ে সব রোজকার থোড়-বড়ি-খাড়া হয়ে যাচ্ছে। থোড়-বড়ি-খাড়া রাত কেটে আবার একটা থোড়-বড়ি-খাড়া ভোর হয়। আইসিইউ’র জানলার বাইরের পাতলা রাতের চাদর ফিকে হয়ে আসে…
এরই মধ্যে কোনও একদিন খবর পাই, আসামে করোনা রোগীর চিকিৎসা করার সময় আক্রান্ত হয়েছেন জুনিয়র চিকিৎসক। রোগী মারা গেছেন এটাই অপরাধ। সবাই জানেন, চিকিৎসায় গাফিলতি না হ’লে মানুষ অমর। কাজেই প্রিয়জনের মৃত্যুর পর ডাক্তারকে ধরে পেটানো আপনার হক। আসামের মুখ্যমন্ত্রী ও প্রশাসন তৎপরতার সাথে দোষীদের কড়া সাজা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আমি অন্তত এরকম জিনিস এর আগে দেখিনি। চিকিৎসকের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আপনাদের ধন্যবাদ।
আজকের লেখাটা শেষ করবো সেই একই কথা দিয়ে। প্রথম তরঙ্গ গেছে, আপনার টনক নড়ে নি। দ্বিতীয় তরঙ্গ এসেছে, আপনি মানতেই চাননি। উল্টে বিভিন্ন রকম আন্তর্জাতিক চক্রান্তের আজগুবি গল্প খাড়া করেছেন। তার ফলাফল হয়েছে মারাত্মক। আবার লকডাউন। আবার কাজ হারানো। হাসপাতালে গেটের মুখে এক ভদ্রলোকের ছোট্ট গুমটি দোকান ছিল। বাচ্চাদের খেলনা বিক্রি করতেন। লকডাউনে বিক্রিবাটা নেই। এখন পাশের হোটেলে চায়ের কাপ-প্লেট ধোওয়ার কাজ নিয়েছেন। অনেকে সম্পূর্ণভাবে কাজ হারিয়ে ফেলেছেন। অথচ, সামান্যই ক’টা বিষয়- হাত ধোওয়া, মাস্ক পরা, অকারণে ভিড়ভাট্টায় না যাওয়া। জানি না, আরও কত মৃত্যু, কত যন্ত্রণা শেষে আপনার চোখ খুলবে? আপাতত সে প্রশ্নের উত্তর বাতাসেও নেই।
(ছবিতে আইসিইউ-র বাইরে আকাশের ঘুম ভাঙছে)