ইংরেজী পি অক্ষরটা তিনবার লিখে, অর্থাৎ পি থ্রি বলে একটা বেশ নামকরা কোম্পানী ছিল; তাদের গেঞ্জী আমি কিনেছি। এখন আর ওদের নাম শোনা যায় না। পরে এই তিনটে পি দিয়ে আরও কিছু কথা শুনেছি। এখন এই “পি পি পি” বললে আমরা বুঝি, পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ। সরকারী হাসপতালের মধ্যে সিটি স্ক্যান, MRI এসবের ব্যবস্থা; কিন্তু চালায় বেসরকারি কোম্পানি। প্রথম দিকে বাজারের থেকে সস্তায় এসব জায়গায় পরীক্ষা করা যেত। এখন তো সবটাই বিনামূল্যে; ভিখারী জমিদার সবার জন্যই।
এই তিনটে পি-এর মত তিনটে ডি বা থ্রি ডি বললে আমরা বুঝি থ্রি ডাইমেনশনাল। একটা ছবি দেখে যদি তার দৈর্ঘ্য প্রস্থ উচ্চতা বোঝা যায়, তখন তাকে থ্রি ডি বলা হয়। এই তিনটে ডি দিয়ে একটা ভালো জিনিস আজই জানলাম। আমাদের সাপের কামড় নিয়ে আলোচনার একটা ভারত বিখ্যাত হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপ আছে। এ দেশের চোদ্দ পনেরোটা রাজ্যের ছাড়াও, নেপাল বাংলাদেশের বিখ্যাত সব ডাক্তার -বিজ্ঞানী, সমাজ কর্মী আছেন সেই গ্রুপে। আজ হাওড়ার এক গ্রামীণ হাসপাতালের এক ডাক্তারবাবু একটি বিষধর চন্দ্র বড়া সাপের ছবি দিয়ে জানিয়েছেন যে, ওটি হাসপাতালের একটি বেডের তলায় ঢুকে ছিল। হাসপাতালে কি করে সাপ ঢুকল ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা শুরু হল।
কর্ণাটকের সর্পবিদ নাগভূষণ সুন্দর একটা কথা লিখেছেন। উনি লিখেছেন ডি থ্রি মেনে চললে এসব অবাঞ্ছিত ঘটনা আটকানো যায়। উনি যা যা করতে বলেছেন, আমরাও বছরের পর বছর ওসব কথা বলে আসছি। এদের যে এভাবে তিনটে ডি দিয়ে, সহজে মনে রাখার মত করে বলা যায়, আগে ভেবে দেখিনি।
স্বাভাবিক ভাবেই গ্রুপের অনেকেই এই থ্রি ডি ব্যাপারটা অনেক বিস্তৃত লিখতে বলেন। উনি লিখলেন, Deny Entry, Deny Food chain আর Deny Shelter. ব্যাপারটি খুব কঠিন নয়। কিন্তু বাস্তবে আমরা এর এক অনাও মেনে চলি না।
যে কথাগুলি নাগভূষণ ইংরেজীতে লিখেছেন, আমরা একটু নিজের ভাষায় বোঝার চেষ্টা করি। প্রথম কথাটা হল, সাপকে ঘরে ঢুকতে দেওয়া চলবে না। শহরে বসে কথাটা বলে দেওয়া যতো সহজ, গ্রামে এটা মেনে চলা ততো সহজ নয়। গ্রামে, বিশেষ করে মাটির বাড়িতে সাপের ঢুকে পড়া আটকানো প্রায় অসম্ভব। গ্রামের বাড়িগুলি একেবারে চাষের জমির মধ্যে না হলেও, বাগান বা ঝোপঝাড় দিয়ে ঘেরা থাকে। এই সব ঝোপঝাড় বা বাগান, ব্যাঙ আর ইঁদুর জাতীয় প্রাণীদের স্বাভাবিক থাকার জায়গা। সাপেদেরও। এই সব গাছপালা ঝোপঝাড় বাড়তে বাড়তে এক সময় বাড়ীর দরজা জানালায় চলে আসে। বিশেষ করে বাড়ীর পিছনের দিকের জানালা বেয়ে লতা গাছের উঠে আসা খুবই স্বাভাবিক। এছাড়া মাটির মেঝেতে ইঁদুরের গর্ত , ফাটল এসব তো আছেই। সাপেরা সহজেই ঘরে ঢুকে যায় । বারান্দায় , উঠানে , কলতলায় ঘুরে বেড়ায়। এই ভাবেই সাপের গায়ে পা পড়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
মানুষের থাকার জায়গায় সাপ চলে না এলে, সাপের কামড়ের দুর্ঘটনাও কমবে। বন জঙ্গল ছেড়ে সাপ যেন ঘর বাড়ীতে ঢুকতে না পারে, সেটা দেখতে হবে। এ নিয়ে একটা ভুল ধারণা বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। ঘরে একটা কার্বলিক এসিডের বোতল রাখলেই আর সাপ ঘরে আসবে না।
ভয়ংকর ভুল ধারণা। গোটা বাড়ির চারপাশে এসিড ছড়ালে হয়তো সাপের ঘরে ঢোকা আটকাতে পারে; বাস্তবে কি তা সম্ভব? আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, ঘরে একটা পোষা দেশী কুকুর থাকলে, সাপের ঘরে ঢোকা আটকায়। বেড়ালও তাই। ছোটকেল নামের একটি দেশী কুকুর কেমন করে একটি বড় চন্দ্রবোড়া সাপকে আটকে রেখেছিল, সে কথা আগেও কয়েকবার লিখেছি। আমাদের গ্রামের বাড়িতে এক সন্ধ্যায় একটি চন্দ্রবোড়া সাপ ঢুকতে গেলে, পোষা কুকুরটি তাকে আটকে রেখেছিল প্রায় এক ঘন্টা। কুকুরের অদ্ভুত ডাক শুনে দাদা আলো নিয়ে বেরিয়ে সাপটিকে দেখতে পায় । সাপ যাতে সহজে ঘরে ঢুকে আসতে না পারে সেটা দেখতে হবে, এটা হল প্রথম ডি।
দ্বিতীয় ডি হল Deny Food chain. Food chain বা খাদ্য শৃঙ্খল আটকাতে হবে। সাপের স্বাভাবিক চরিত্র হল মানুষের থেকে দূরে থাকা। প্রাণী মাত্রেরই খাদ্যের দরকার হয়। সাপের খাদ্য ইঁদুর আর ব্যাঙ। যেখানে ইঁদুর আর ব্যাঙ থাকে সাপ সেখানে চলে আসে শিকার ধরতে। ইঁদুর আসে ধান, চাল, ডাল খেতে। গ্রামের বাড়িতে বারান্দায় এই সব খাদ্যশস্য ছড়ানো ছিটানো থাকে, তাই অনেক ইঁদুর ঘরে বারান্দায় থাকে। সাপেরাও ইঁদুর ধরতে আসে; বিপদ তখনই ঘটে। ঘরে বারান্দায় ভাত মুড়ি পড়ে থাকলে সেসব খেতে পোকা মাকড় আসে। ঐ পোকা মাকড় খেতে আসে ব্যাঙ। কালাচ জাতীয় সাপও পোকা মাকড় খেতে আসে। তাই এই খাদ্য শৃঙ্খল ভেঙ্গে দিলে সাপ ঘরে ঢুকে আসার সম্ভাবনা কমে।
তিন নম্বর ডি হল, Deny Shelter; সাপ যেন লুকিয়ে বসে থাকার মত জিনিস আর জায়গা না পায়। ঘরে বারান্দায় অপ্রয়োজনীয় বা বাতিল জিনিসপত্র জমিয়ে রাখা আমাদের একটা বাজে অভ্যাস। সাপ কোন একটা সুযোগে ঝোপঝাড় থেকে উঠে এসে এই সব লুকানোর জায়গা খুঁজে আশ্রয় নেয়। চাষের জিনিস, খড় বিচালী, কলাই গাছ, তিল গাছ উঠানে, বারান্দায় জমানো থাকলে সাপ সেখানে আশ্রয় নেয়। উঠানে বড় গাছ থাকলে তার তলায় শুকনো পাতা জমতে থাকে। এই শুকনো পাতা নিয়মিত ঝাঁট দিয়ে সরিয়ে নিতে হবে।
এই হল আমাদের নাগভূষণের ডি থ্রী বা থ্রী ডি ফর্মুলা।
সাপেদের সাথে মানুষের সংস্পর্শের আরও অনেক জায়গা বা সম্ভাবনা আছে। বিশেষ করে চাষের জমিতে আর মাছ ধরতে গিয়ে সাপের কামড়ের সংখ্যাই বেশী। আমন ধান কাটার সময় দক্ষিণবঙ্গে প্রচুর চন্দ্রবোড়া সাপের কামড় ঘটছে। ধানের মাঠে কাজ করার সময় এই ব্যাপারটা মাথায় রেখে কাজ করতে হবে। ধান কাটার আগে একটা লাঠি বা গাছের ডাল দিয়ে কিছুটা ধান গাছ নেড়ে নিলে সাপ ওখান থেকে সরে যাবে। ছোট চাষীদের পক্ষে সম্ভব না হলেও, আজকাল ধান কাটার মেশিন ব্যবহার করে এই বিপদগুলি এড়ানো সম্ভব হচ্ছে।
অন্ধকার রাস্তায় চলা খুবই বিপজ্জনক। হাতে একটা আলো নিয়ে পথ চলা নিরাপদ।
কালাচের কামড় থেকে বাঁচার জন্য মশারী টাঙিয়ে বিছানায় ঘুমানো উচিত। মেঝেতে খোলা বিছানায় ঘুমানো উচিত নয়; এতে কালাচ সাপ কামড়ের বিপদগুলি হয়।
এই যে পরামর্শ দেওয়া হলো, এগুলি সবই সাপের কামড় যাতে না হয় তার ব্যবস্থা। সাপে কামড়ালে সময় নষ্ট না করে দ্রুত কাছের স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যেতে হবে।
খুব প্রয়োজনীয় লেখা স্যার। ধন্যবাদ।