এই পর্বে একটা চিঠি পবিত্রর, আমাকে লেখা। বাকি চিঠি আমার চঞ্চলাকে লেখা। নির্বাচিত অংশ, অপরিবর্তিত। আজকে্র সংযোজন বন্ধনীর মধ্যে।
৩/৪/১৯৮২
দুপুর বারোটায় দুবেজী উকিলের স্ত্রীকে দেখতে বালোদ যেতে হয়েছিল। ইউনিয়ন অফিসে ফিরলাম বিকেল সাড়ে পাঁচটায়। প্রচুর পেসেন্ট বসে ছিল। রাতে অনেকগুলো emergency পেসেন্ট এসে গেল। ঠিক তক্ষুনি শৈবালও এসে হাজির হল। সব সেরে উঠতে রাত এগারোটা। সোজা শৈবালের কোয়ার্টারে গেলাম।
৪/৪/১৯৮২
আমি আর শৈবাল একটু আগে আমার ঘরে ফিরলাম। আজ এখানে থাকবে। আজ আমরা দুজনে বালোদ গেছিলাম, দুপুরে দুবেজীর ওখানে খেলাম।
এখানে খবর আগের মতই, বিনায়কদা পবিত্র না থাকায় বেশির ভাগ সময় রুগী দেখতেই চলে যাচ্ছে, মুহল্লায় কাজ করার সময় পাচ্ছি না, হেলথ কমিটির মিটিং হচ্ছে না। আগামীকাল নিয়োগী ফিরবে। সম্ভবত আনসারও। বিনায়কদা কবে ফিরবে জানি না। অরবিন্দ দু এক দিনের মধ্যেই ফেরার কথা। পবিত্রর খবর তো জানিই না।
ভাল করে gynaecology শিখে আয়, তারপর আমরা একটা মেডিকেল টিম বানাবো—শৈবালকে নিয়ে।
৫/৫/১৯৮২
এই মাত্র ঘরে ফিরেছি। রাস্তায় দেখলাম নিয়োগী মটর সাইকেলে ফিরছে, আনসার ফেরেনি, ও আজ আমাকে একটা চিঠি দিয়েছে। লিখেছে বৌদির (চঞ্চলা) সাথে দেখা করতে গেছিলাম।
আমার শরীর ভাল আছে, ইউনিয়ন অফিসে চৌকিদারের ওখানে যা হোক খাচ্ছি। (প্রথম যখন রাজহরা যাই তখন থাকতাম শ্রমিক মুহল্লার প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে ভিলাই স্টীল প্লান্টের সাহেবদের জন্য তৈরী একটা কোয়ার্টারে। পাকাপোক্ত ঘর। লাইট ফ্যান, বাথরুম রান্নঘর। দুটো শোবার ঘর, একটায় আমি থাকতাম, একটা্য বিনায়কদা। সমস্যা একটাই, তিন কিলোমিটার পাহাড়ী রাস্তা দিনে চারবার যাতায়াত। শৈবাল যখন পুষ্পা হাসপাতালে যোগ দিলো, তখন ওর বিরাট কোয়ার্টারে চলে যেতাম। সে খুব আনন্দের দিন গেছে। শৈবাল যতদূর মনে পড়ে ভালোই মাইনে পেত। রোজ সন্ধ্যেবেলা প্রচুর রান্না করতাম।
এই সময় অবিনাশ দেশপান্ডে রাজহরায় এসে হাজির হয়। ও শিল্পী, ছবি আঁকত। আমাদের স্বাস্থ্য আন্দোলনের কয়েকশ পোষ্টার ও এঁকেছিল। আমার যেমন একটা পোষ্টার বানাতে সারাদিন কেটে যেত, ও তার চেয়ে অনেক সুন্দর করে দিনে দশটা বারোটা পোষ্টার বানাতো।
পোষ্টারের বিষয় ছিল বিভিন্ন রকমের। স্ত্রী-স্বাস্থ্য, ডায়েরিয়া, সর্দি কাশি, ওষুধের অপব্যবহার ইত্যাদি। ওখানে ডাক্তার বলতে ‘কোয়াক ডাক্তার’। তারা কোন অসুখ হলেই একটা ইঞ্জেকশন ঠুকে দিত। মেয়েদের প্রসবে দেরী হলে, কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই একটা pitocin ইঞ্জেকশন দিয়ে দিত। এতে প্রসব তাড়াতাড়ি হত ঠিকই, কিন্তু জরায়ু মুখে কোন সমস্যা থাকলে মায়ের uterus ফেটে যেত এবং মা মারা যেত। আমরা এই ধরনের চিকিৎসার বিরুদ্ধে পোষ্টার লিখে মুহল্লায় প্রচার করতাম।
শৈবালের কোয়ার্টারে যে রান্নাটা আমরা বেশী করতাম তা হল বিভিন্ন সবজি দিয়ে খিচুড়ি। অবিনাশ বলত ছত্তিশগড়ী খিচুড়ী, যদিও এর মধ্যে ছত্তিশগড়ী কিছু ছিল না। আর ব্রেকফাস্ট বাসী ভাত পেঁয়াজ লঙ্কা টমেটো দিয়ে ভাজা। তাতে একটা ম্যাগী মিশিয়ে দিতাম, কি অপূর্ব স্বাদ।
রান্না মূলত আমি করতাম। অবিনাশ ছবি আঁকতো। অবিনাশের জিন্সের একটা নীল জ্যাকেট ছিল। আমার খুব পছন্দ। আর আমার মাউথ অর্গান বাজানো দেখে ওর খুব লোভ হত। শেষ পর্যন্ত আমরা দুজন অদল বদল করলাম—ও আমার মাউথ অর্গানটা নিল। আমি ওর জ্যাকেটটা।
খবর পেয়েছি অবিনাশ অকালেই মারা গেছে।
শৈবালের এই কোয়ার্টারে অনিল সদগোপালও কয়েকদিন এসে ছিলেন।
শৈবালের কোয়ার্টারেও একই সমস্যা রোজ তিন কিলোমিটার দিনে চারবার যাতায়াত করা। অনেক সময় নষ্ট।
তাই সিদ্ধান্ত নিই শ্রমিক মুহল্লাতেই থাকবো, ইউনিয়ন অফিসের কাছেই কচ্চে দফাই, একটা মুহল্লায় একটা পরিত্যক্ত শ্রমিক কোয়ার্টারে আস্তানা গাড়ি। একটাই ঘর। Asbestos-এর ছাদ। ইলেক্ট্রিসিটি, বাথরুম কিছুই ছিলনা, শৈবাল আমার সাথে মাঝে মাঝে থাকত। চান টান ইউনিয়ন অফিসে গিয়ে।
অরবিন্দও আমার পাশেই আরেকটা কোয়ার্টারে। ও ঘরে শ’খানেক পেরেক পুতে রেখেছিল। বলত এগুলো খুব জরুরী। সব জিনিষ টাঙ্গিয়ে রাখা যায়।
চৌকিদারের কাছে খাওয়ার সময় মাঝে মাঝে অরবিন্দ রেগে যেত। শুধু ডাল আর ভাত? সবজি না খেলে ভিটামিন deficiency হবে। প্রায়দিনই ও এক/দু টাকার শাক কিনে ডালে ফেলে দিত।
চৌকিদার কলিরাম রোজ একটা শুকনো লঙ্কা পুড়িয়ে আমায় দিত। একদিন কোথা থেকে কিছু ছোট মাছ পায়, সেগুলো আগুনে ঝলসায়—তেল ছিল না। এক কামড় দিয়ে আমি আর খেতে পারিনি।)
দু-দিন আগে দাড়ি কেটে ফেলেছি, অনেকদিন পরে দাড়ি কাটলাম—নিজেরই অবাক লাগছে অন্যরা তো বলছেই। আজ শৈবালও দাড়ি কেটে ফেলেছে।
(এই সময় আমরা চান করতে যেতাম বেশীর ভাগ দিন ইউনিয়ন অফিসে। মাঝে মাঝে কাছেই একটা নালায় চান করতে যেতাম। মঙ্গলবার আমাদের ছুটি থাকত। আমি আর শৈবালের সাথে আনসার কাছেই একটা বাঁধে চলে যেতাম। বাঁধ সাঁতরে ওপারে গিয়ে আমরা গুপ্তা স্টল থেকে দিনে পাঁউরুটি আর জিলাপী খেতাম।
প্রথম যখন রাজহরায় যোগ দিই তখন ইউনিয়নের সাথে আমার চুক্তি ছিল মাসে এক হাজার টাকা করে পাব। পরে যখন পবিত্র আসে তখন আমরা দুজনে ঠিক করি আমি মাসে ছয়শ টাকা করে নেবো। পবিত্র নেবে চারশো টাকা। কিন্তু ইউনিয়নের ভাঁড়ার বেশীর ভাগ সময়েই শূন্য, তাই প্রতিমাসে টাকা পাওয়ার কোন প্রশ্নই ছিল না। পবিত্র যে কমাস ছিল কোন টাকাই পাইনি তাই পবিত্রকেও কিছু দিতে পারিনি।
আগেই বলেছি নারায়ণ সিং দিবস উপলক্ষ্যে গ্রাম থেকে কৃষকেরা প্রচুর চাল আর বিউলির ডাল দিত। উৎসবের পরেও এই চাল বেঁচে থাকতো। ইউনিয়ন অফিসে রাখা থাকতো। তাই ইউনিয়নের ভাঁড়ার শূন্য থাকলেও দুবেলা ভাত ডালের অভাব হত না।
তবে আমাদের খুব একটা অসুবিধে হত না। শৈবালের মাইনের টাকায় মাঝে মাঝে বিলাসিতা হত। চঞ্চলাও ওর internship, housestaffship-এর কিছু টাকা আমাকে পাঠাতো, আর ইউনিয়ন অফিস থেকে মাঝে মাঝে কিছু টাকা পেতাম।)
২০/৪/19৮২
এখন দুপুর বারোটা, ডিস্পেন্সারীতে বসে লিখছি, এখন পেসেন্ট নেই।
গত পরশু রাতে সিনেমা হলের ম্যানেজার শর্মাকে (ইউনিয়নের কাছের লোক)—এক মদের ঠিকাদার ট্রাক চাপা দিয়ে খুন করার চেষ্টা করে। Multiple fracture আর head injury. ভিলাই-এ ভর্তি আছে। এখন একটু ভালো। গতকাল এই নিয়ে ইউনিয়নের mass meeting হল, মদের ঠিকাদার বৌ ছেলে সমেত পালিয়েছে। পুলিশ এখন কোন step নেয়নি। ভাবছি দু এক দিনের মধ্যে দেখতে যাব শর্মাজীকে, বিনায়কদা আজ গেছে।
আমাদের কাজকর্ম এখনো কিছু হচ্ছে না। বিরক্তিকর ব্যাপার। এই বার খুব ভাল করে চেষ্টা করব—দেখি কি হয়।
আমার শরীর একদম ভাল, কাজকর্মের কারণে মন একটু বিক্ষিপ্ত।
৫/৫/১৯৮২
পবিত্র–আমাকে
প্রিয় আশীষ, বাড়ী যাওয়ার পথে ট্রেন ছাড়তে দেরী হওয়ায়—পাঁচ মিনিট সময় হাতে নিয়ে চিঠিটা লিখছি। ব্যাপারটা অনেকখানি হঠাৎ করে “রামের সুমতি”। কারণ গত দুমাসে তোর ঐতিহ্য অনুসরণ করে আমিও তোকে শেষ চিঠি দিইনি। যাক—গালাগালি এখান থেকে দিয়ে লাভ নেই—কারণ অজস্র কথা আছে।
আমার খবর—বাবাকে নিয়ে অবস্থা আগের মতই। Left sided hemiplegia, practically কোন improvement হয়নি। আড়াই মাস ধরে bed-ridden, ফলে মানসিক দিক থেকে একেবারে ভেঙ্গে পড়েছেন। আরেক দাদার motor neurone disease—একমাস আগে diagnosis হয়েছিল। তারও এখন হাত পা paralysis, recently laryngeal involvement শুরু হয়েছে। দাদার অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ, এলোপ্যাথি ওষুধে কোন কাজ না হওয়ায় কবিরাজের কাছে চিকিৎসা চলছে। চিকিৎসার খরচ অনেক সেজন্য টাকা পয়সা জোগাড় করার চেষ্টা করছি। আর সবকিছুর ধাক্কায় শারীরিক দিক থেকে বিধ্বস্ত ও mentally খুব strain চলছে।
এখানে বন্ধুদের খবর মোটামুটি ভাবে ভাল। মোটা (স্মরজিত)/ দীপু সবার সাথে JDF (Junior Doctors Federation)এর একটা মিছিলে দেখা হয়েছিল। তোর বাঈ (বৌ)-এর সাথে হালফিল দেখা হয়নি। দুঃখিত ও লজ্জিত।
ওখানে ছাদ ঢালাই আশা করি শুরু হয়ে গিয়েছে, শর্মাজী এখন কেমন আছে জানাস। Health work-এর অবস্থা details-এ জানাস । Opening কবে হচ্ছে (হাসপাতালের)? ওষুধ ও instrument-এর ব্যাপারে নতুন কিছু list বানিয়েছিস কিনা/ বইপত্র কি নিয়ে আসলে ভালো হয় বিস্তারিত ভাবে জানাস।
নিয়োগীজিকে আসার সময় জানিয়েছিলাম—আমার estimate ও list পাঠানোর কথা ছিল—কিন্তু নানান ঝামেলার মধ্যে পারিনি। আমি চেষ্টা করবো এই মাসের শেষের দিকে কিছু দিনের জন্য ঘুরে আসার ও আমার সমস্ত problem গুলো নিয়ে তোদের সাথে কথা বলার।
বুড়ার (শৈবাল) খবর জানাস ।
চলবে…….