ডাঃ চঞ্চল রায় কোনো মহাপুরুষ নন। তিনি ভালমন্দ মেশানো সাধারণ মানুষ। তাঁর জীবনে অনেক সাধ আহ্লাদ আছে। ডাক্তারি পেশার জন্য তিনি জীবনটাকে নষ্ট করতে ইচ্ছুক নন।
তিনি একটি জেলা হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার। ডিউটি রোস্টার নিয়ে মাঝে মাঝেই সুপারের সাথে ঝগড়া করেন। আউটডোরে দু’শ রোগী দেখার পরে ধৈর্য হারিয়ে রোগীদের সাথে খারাপ ব্যবহার করে ফেলেন।
তবে ডাঃ চঞ্চল রায় ফাঁকিবাজ নন। ডিউটির ব্যাপারে অত্যন্ত সিনসিয়ার। এক্সট্রা ডিউটি দিতে হলে গাইগুঁই করেন। কিন্তু ডিউটি শুরুর পনের মিনিট আগে হাজিরও হয়ে যান।
আসলে ডাঃ রায় একটু ভীতু প্রকৃতির মানুষ। তিনি সুপারের ক্ষমতাকে ভয় পান, নেতাদের হম্বিতম্বি ভয় পান, রোগীর বাড়ির লোককে ভয় পান।
এই ভীতু ডাক্তারকে আবাসনের অন্যান্য প্রতিবেশীরা শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। অন্তত ডাক্তার বাবুর তাই মনে হতো। বিপদে আপদে ডাক্তার বাবুই ছিলেন তাদের ভরসা।
মাঝরাতে পেটে ব্যথা হলে তাঁরা নির্দ্বিধায় ডাক্তার বাবুর ফ্ল্যাটের বেল বাজাতেন। ডাক্তার বাবু ইনজেকশন দিয়ে ব্যথা কমাতেন। ঘুম চোখে ফিজিশিয়ান স্যাম্পেল ঘেঁটে ওষুধ খুঁজে দিতেন।
সেই ভীতু ডাক্তার বাবুর যে এমন আমূল পরিবর্তন ঘটবে কে জানতো?
করোনা মহামারী শুরুর পরে অনেক চিকিৎসকই এমারজেন্সিতে ডিউটি করতে ভয় পাচ্ছেন। আর ডাঃ রায় প্রায় প্রতিদিনই হাসিমুখে এমারজেন্সি করছেন। পি পি ই হিসাবে কয়েকটি কমদামি রেনকোট দেওয়া হয়েছে। চৈত্রের গরমে টানা আট ঘণ্টা প্লাস্টিকের রেনকোট পরে ঘামতে ঘামতে রোগী দেখছেন।
বাড়িতে স্ত্রী নন্দিনী কেঁদে ভাসাচ্ছেন। তোমার যদি কিছু হয়, আমরা কি করব?
ডাঃ রায় হাসি মুখে বলছেন, বুঝলে নন্দিনী, আমার মনে হচ্ছে ঠিক যেন যুদ্ধ ক্ষেত্রে আছি। স্টেথোস্কোপই আমার বন্দুক। শোনো, আজ থেকে আমি তোমাদের সাথে শোবো না।
তাহলে কোথায় শোবে?
তুমি দুই মেয়েকে নিয়ে শোবার ঘরে শুয়ো। আমি যে ঘরে পড়াশোনা করি, ওঘরের তক্তপোশেই শুয়ে পড়ব। দুই মেয়েকে বুঝিয়ে বলো আমার ধারে কাছে যেন না আসে।
কিন্তু তোমার মুখে গল্প না শুনলে ওরা যে ঘুমায় না।
আমি এঘর থেকেই হোয়াটসঅ্যাপ এ গল্প শোনাবো। তুমিও আমার ধারে কাছে এসো না। দূর থেকেই খাবার দিয়ে যেও।
আমার যে বড্ড ভয় লাগছে।
ডাক্তার বাবু হাসলেন, দূর পাগলী, সৈনিকের স্ত্রী কে ভয় পেতে নেই। বিশ্বাস করো নন্দিনী, এই প্রথম আমি চিকিৎসক হওয়ার জন্য গর্ব অনুভব করছি।
কিন্তু পরের দিনই ডাঃ চঞ্চল রায় একটা ঝামেলায় পড়লেন। একজন বয়স্ক জ্বরের রোগী এমারজেন্সি তে এসেছেন। তাঁর শ্বাসকষ্টও হচ্ছে। ভদ্রলোক দশদিন আগে ইতালি থেকে ফিরেছেন।
ডাঃ রায় রোগীর ছেলেকে বললেন, এনাকে এখানে অন্য রোগীদের সাথে রাখা যাবে না। এনাকে আই ডি হাসপাতালে নিয়ে যান।
রোগীর পুত্র প্রথম থেকেই আক্রমণাত্মক। সামান্য সর্দি-জ্বরের জন্য বাবাকে আই ডি তে রেফার করছেন! এজন্যই আপনার মতো ডাক্তাররা মার খায়।
সামান্য সর্দি-জ্বর! ডাক্তার বাবু চমকালেন। বললেন, উনি ইতালি থেকে ফিরেছেন। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণও তো হতে পারে।
রোগীর ছেলে বললেন, আমি এখানকার এম এল এ’র ভাইপো। আমি বলছি বাবা এখানেই ভর্তি থাকবে।
ডাক্তার বাবু বললেন, স্বয়ং এম এল এ সাহেব বললেও আমি এনাকে এখানে ভর্তি করব না। এতে রোগী ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের জীবনের ঝুঁকি হতে পারে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সুপার দৌড়ে এলেন। বললেন, ডাঃ রায়, আপনি ঝামেলা বাধাতে ওস্তাদ। ফালতু ফালতু এম এল এ’র কাছে আমায় একগাদা কথা শুনতে হলো। ওনাকে ভর্তি করুন।
ডাঃ রায় গোঁয়ারের মতো বললেন, আমি সরকারি গাইড লাইনের বাইরে যাব না।
সুপার বললেন, তাহলে আমিই ভর্তি করছি। তবে এর ফল আপনি ভুগবেন।
রোগী ভর্তি হওয়ার পর ওয়ার্ডের সিস্টার দিদিরা বেঁকে বসলেন। তারা এমারজেন্সির সমস্ত ঘটনা শুনেছেন। সকলের দাবীতে রোগীর লালারস আর রক্ত পরীক্ষার জন্য পাঠানো হল।
বাড়ি ফিরে চার মিটার দূর থেকে ডাঃ রায় তার স্ত্রীকে সব ঘটনা বললেন।
নন্দিনী বললেন, আমার সত্যিই খুব ভয় করছে। কি যে হবে?
কিছু করার নেই। চিকিৎসক হিসাবে এই সংকটের সময়ে সাধারণ মানুষের পাশ থেকে সরে যাওয়া সম্ভব নয়।
নন্দিনী বললেন, কোন মানুষের জন্য তুমি এতো ভাবছো? খবরে দেখছো না, দিকে দিকে সাধারণ মানুষরাই ভাড়া বাড়ি থেকে ডাক্তার নার্সদের পথে বের করে দিচ্ছে। তাদের পাড়া ছাড়া করছে।
ডাক্তার বাবু হাসলেন। বললেন, সব মানুষ ওরকম নয়।
দুদিন বাদেই ওই জ্বরের রোগীর রিপোর্ট এল। কোভিড ১৯ পজেটিভ। ডাঃ রায় সহ মোট বারো জন স্বাস্থ্য কর্মীকে বাড়ি থেকে কোয়ারান্টাইন সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হল। বিভিন্ন মিডিয়ায় সে খবর ফলাও করে দেখানো হল। এমনকি ডাঃ রায় ও বেশ কয়েকজন স্বাস্থ্য কর্মীর পরিচয় সমেত।
নন্দিনী ধাতস্থ হওয়ার আগেই আরেক আঘাত পেলেন। এতদিন যাদের ডাঃ রায় যন্ত্রণার উপশম করেছেন, আজ তারাই ডাক্তার বাবুর বিরুদ্ধে একজোট হয়েছেন। ডাক্তার বাবুর পরিবারকে এই আবাসনের মধ্যে ফ্ল্যাটে থাকতে তারা দেবেন না।
দুই শিশুকন্যার হাত ধরে নন্দিনী রাস্তায় নামলেন। কোথায় যাবেন জানেন না। লকডাউনের মধ্যে একটা গাড়ি যদি বা জোগাড় করতেও পারেন, কিন্তু কোনো আত্মীয় কি তাদের আদৌ আশ্রয় দেবেন। দুই শিশু কন্যার হাত ধরে এক ডাক্তারের স্ত্রী হাঁটতে শুরু করলেন। অনিশ্চয়তার লং মার্চ।