লক ডাউন হয়তো আরও বাড়তে চলেছে। কিন্তু সেই একই প্রশ্ন প্রথম থেকে মাথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। শুধু লকডাউন করেই কি এই আমরা এই মহামারীকে ঠেকিয়ে দিতে পারব। আমাদের মতো একটা গরীব দেশে অনির্দিষ্টকাল ধরে কি লকডাউন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব?
এতে কোনও সন্দেহ নেই, লক ডাউনের ফলে কোভিড-১৯ ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়ার গতিবেগ অনেকটা কমে গেছে। কিন্তু পুরোপুরি আটকায়নি। যে ধীর গতিতে ছড়াচ্ছে তাতেই আমাদের দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কঙ্কাল বে আব্রু হয়ে গেছে। সেটা হওয়ারই ছিল। আমাদের দেশের সবচেয়ে অবহেলিত দুটি বিষয় হল, স্বাস্থ্য আর শিক্ষা। কমতে কমতে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় জিডিপির ১% এ নেমেছে। এই দুটি ক্ষেত্রে কোনও সরকারই কোনদিন নজর দেয়নি। বরঞ্চ বেসরকারি হাতে মানুষের মৌলিক চাহিদা দুটি তুলে দিয়ে নিজেদের হাত ধুয়ে ফেলতে চেয়েছে।
একটি স্কুল চালাতে সরকারের যা খরচ হয়, সেই টাকায় অনেক গুলি ক্লাবকে অনুদান দেওয়া যায়। অনেক মানুষকে সামান্য কিছু টাকা পাইয়ে দিয়ে ভোটে জেতা নিশ্চিত করা যায়। একটি সরকারি হাসপাতালের ক্ষেত্রেও এই কথাটা সত্যি।
মাঝে মাঝে যখন স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দোষ ত্রুটি গুলো সকলের চোখের পড়েছে, তখন চিকিৎসককে বা অন্য কোনও স্বাস্থ্য কর্মীকে ভিলেন বানিয়ে মানুষের ক্ষোভ প্রশমিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। এমনকি শাসক দলের নেতারাও জনগণের ক্ষোভ প্রশমনের জন্য চিকিৎসকদের নিগ্রহ করেছেন।
আমি তখন মেডিক্যাল কলেজে মাস্টার ডিগ্রি করছি। এক রাতে ডিউটি করছি। হঠাৎ একজন স্বঘোষিত নেতা তার অনেক সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে ওয়ার্ডে ঢুকে গেল। এবং আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই অত্যন্ত অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করতে শুরু করল।
বুঝলাম, একটু আগে একজন সাপে কাটা রোগী ভর্তি হয়েছে। সেই রোগীকে কেন মেঝেতে জায়গা দেওয়া হয়েছে, এতেই ওই নেতার রাগ।
আমি বলতে গেলাম, বেড থাকলে তো দেব। অ্যাকুউট ওয়ার্ডে পঞ্চাশটি বেডে পঁচাত্তর জন রোগী ভর্তি আছে। স্বভাবতই সকল রোগীকে বেড দেওয়া সম্ভব নয়।
তাতে সেই নেতা তেড়ে আমাকে মারতে এলো। ইন্টার্ন ভাই আর সিস্টার দিদি কোনও রকমে তাকে আটকালেন।
মত্ত নেতা অত্যন্ত অশ্লীল ভাষায় বলতে থাকল, আগে ক্ষমতায় যে রাজনৈতিক দল ছিল, আমি সেই দলের দালাল। ওদের দলের নাম খারাপ করার জন্য গরীব মানুষের রক্ত চুষছি। আমাদের মতো চিকিৎসককে অবিলম্বে লাথি মেরে সরকারি চাকরি থেকে বের করে দেওয়া উচিৎ।
তার সাঙ্গোপাঙ্গরা একধাপ উপরে। চিৎকার করেছে, পারমিশন পেলে তারা আমার হাত পা খুলে নেবে।
মাতালদের সাথে তর্ক করা বোকামি ও বিপদজনক। তারা বেশ কিছুক্ষণ চিৎকার করে ওয়ার্ড থেকে বিদায় নিলো। পুরো সময়টাতেই একজন পুলিশ নির্বাক দর্শক হয়ে পিছনে দাঁড়িয়ে ছিল।
এবং পুরো ঘটনাটা ঘটে যাওয়ার পর আমরা অত্যন্ত শান্ত ভাবে সেই সাপে কাটা রোগীটিকেই প্রতিষেধক চালালাম। সিস্টার দিদি চারঘন্টা অন্তর তার রক্ত পরীক্ষা করলেন। পুরো ঘটনায় ওয়ার্ডের কোনও রোগী এবং রোগীর বাড়ির লোক কোনও প্রতিবাদ করেনি। নেতারা চলে যাওয়ার পর দুচার জন বাড়ির লোক সমবেদনা জানাতে এসেছিলেন। বললাম, একটু আগে ওদের সামনে সবাই মিলে প্রতিবাদ করলেন না কেন?
তাদের একটাই উত্তর, গরীব মানুষ বাবু। যদি ওনারা কোনও ক্ষতি করে দেন।
মুশকিল হল, যে রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, আমরা কম বেশি এরকম ব্যবহারই পাব। আর গরীব মানুষেরাও চিরকাল গরীবই থাকবে। যাঁরা ক্ষমতার শীর্ষে আছেন, তাঁরা সেটাই চান। গরীব মানুষের অনেক ভয়। সে প্রতিবাদ করার আগে হাজার বার ভাবে।
পরের দিন লিখিত ভাবে মেডিসিনের বিভাগীয় প্রধানকে ও স্থানীয় থানায় অভিযোগ জানাল হল। অভিযোগ পত্রটি লিখে মনের অশান্তি একটু কমা ছাড়া আর কিছুই কাজের কাজ হল না। সাপে কাটা রোগীটি সুস্থ হয়ে বাড়ি যাওয়ার সময় তিনি আর তাঁর মা দুঃখ প্রকাশ করে বার বার ক্ষমা চাইছিলেন। কিন্তু তাতে ক্ষতে প্রলেপ পরার বদলে ক্ষত আরও বাড়ছিল।
সব চিকিৎসকেরই এরকম বা এর চেয়েও খারাপ অভিজ্ঞতা আছে। দিনের পর দিন এই সব ঘটনার সম্মুখীন হতে হতে অনেকেই শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক সংগঠনের ছাতার তলায় গিয়ে কোনও রকমে পিঠ বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করেন। বাকিদের অবস্থা কহতব্য নয়। সারা জীবনের সুনাম একটি ঘটনাতেই ধুয়ে মুছে যায়। সংবাদ পত্রে সহকর্মীদের নাম হেডিং হতে দেখি। ফেসবুকে একদল গরীব(!!!) মানুষ তাঁর ট্রায়াল শুরু করেন। এই ট্রায়ালে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনও উপায় নেই।
চিকিৎসকদের ওষুধের কোম্পানি, ল্যাবরেটরির থেকে কমিশন পাওয়া ও তার বিনিময়ে অনৈতিক ওষুধ ও টেস্ট লেখা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই, চিকিৎসকদের মধ্যে বেশ কিছু ব্ল্যাকশিপ আছে। কিন্তু শুধু চিৎকার চ্যাঁচামেচি না করে সরকার চাইলে অনেক আগেই এগুলো বন্ধ করতে পারত। দরকার হলে সেই সব ব্ল্যাকশিপ দের বিরুদ্ধে বিশেষ শাস্তি মূলক ব্যবস্থা নিতে পারত। জেনেরিক নামে ওষুধ লেখার যে আইন হয়েছিল, তা মানা হচ্ছে কিনা এবং উন্নত জেনেরিক ওষুধ কমদামে আদৌ পাওয়া যাচ্ছে কিনা দেখার দায়িত্ব সরকারেরই ছিল।
করোনার আবহে চিকিৎসকদের বেশ একটা হিরো ইমেজ তৈরি করা হয়েছে। এবং বলতে নেই সেটা রাজনৈতিক স্বার্থেই। চিকিৎসকরা কেউই ভগবানও হতে চায়না, কেউ শয়তানও হতে চায় না। তারাও আপনার মতো স্ত্রী, পুত্র, কন্যাকে নিয়ে শান্তিতে জীবন কাটাতে চায়। তারা চায়, সকলের জন্য স্বাস্থ্যের অধিকার। রোগী অর্থের অভাবে ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছেন, এই ঘটনা কোনও চিকিৎসককেই খুব একটা খুশি করে না।
জানিনা করোনার মহামারী আর কতদিন চলবে। জানিনা লকডাউন তোলার সাথে সাথে আবার মহামারী নতুন করে ফিরে আসবে কিনা। জানিনা আর কতজন স্বাস্থ্য কর্মীকে ইচ্ছের বিরুদ্ধেও শহীদ হতে হবে।
তবে প্রতিদিনই রোগী দেখতে দেখতে বুঝতে পারছি, অনেক মানুষই অর্থনৈতিক ভাবে এবং মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছেন। পরবর্তী কালে আমাদের হয়তো অন্য আরেক মহামারীর সম্মুখীন হতে হবে।
অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক লেখা। ধন্যবাদ। সত্যিটা সত্যিই থাকে হাজার বিজ্ঞাপন, সুদৃশ্য দরওয়াজা বা ফুলের কেয়ারি দিয়ে জনমোহিনী বিজ্ঞাপন এই সত্যিটাকে চাপা দিতে চায়। কিছু লোকে খায়। আসলে এমন একটা ধারণা তৈরি করা হয়েছে যেন সরকার হাসপাতালে ঢেলে দিয়ে রেখেছে, হাসপাতালের ডাক্তারি আর অন্যান্য স্বাস্থ্য কর্মীরা ফাঁকিবাজ, চোর। লোকে বিশ্বাস করে কারণ আসল রূপের কথা লোকের কাছে পৌছায় না। সংখ্যা কম, মূলধারার মিডিয়া পিছনে নেই। লোকেতো উন্নয়ন আলিশান দরওয়াজা আর ফুলের কেয়ারিতে দ্যাখে।