আমরা উৎসব প্রিয়। তাই সবকিছুতেই হুল্লোড় খুঁজি। অনেক দিন বাড়িতে বসে আছি। চারপাশে সব বন্ধ। তাই করোনা অতিমারিকেই উৎসব বানিয়ে ফেললাম।
আমাদের দেশ সহ বিশ্বের ১৯০টি দেশে করোনা বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন চিকিৎসকেরা। সমস্ত সভ্য সমাজ তাঁদের কুর্নিশ জানাচ্ছে। আমরাই বা বাদ যাব কেন? আমাদের বলা হল, ঘরের ভিতরে দাঁড়িয়ে করতালি দিতে, আমরা ঢোল-করতাল নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়লাম। আমাদের বলা হল, বারান্দায় মোমবাতি জ্বালাতে, আমরা ছাদে উঠে আতস বাজি আর ফানুস উড়ালাম। আচ্ছা, যে ডাক্তার বাবুকে মাস খানেক আগেও আমারা ‘পয়সার ধান্দায় টেস্ট করতে দিয়েছে’ বলে গালমন্দ করতাম, হঠাৎ তাঁকে ‘হিরো’ হিসাবে মেনে নিলাম?
আজ্ঞে না! আমরা অনেক দিন বাড়িতে থেকে একঘেয়ে বোধ করছিলাম। একটু বিনোদন দরকার ছিল।
আরে, বুঝতে পারলেন না, সত্যিই যদি কুর্নিশ করার মানসিকতা থাকতো, তাহলে খোদ কলকাতা সহ রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় হাসপাতালে কাজ করার ‘অপরাধে’ স্বাস্থ্য কর্মী, নার্স, চিকিৎসকদের ‘একঘরে’ করতাম কি? ভাড়াটে চিকিৎসক কিংবা নার্স হলে, তাঁকে তল্পিতল্পা নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার নিদান দিতাম?
আসলে আমরা ভণ্ড। আপাদমস্তক ভণ্ড। আমাদের অন্যের পাশে থাকার মানসিকতা অনেক দিন আগেই হারিয়ে গিয়েছে! আমরা এখন যা করি, তার অধিকাংশ লোক দেখানোর জন্য। ছবি আপলোডের থেকে সুখের আপাতত আমাদের কাছে আর কিচ্ছু নয়।
আমাদের রাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্য কর্মীর এখন থাকার জায়গা নেই। তাঁদের ঘর ছাড়ার হুমকি দেওয়া হচ্ছে, কোথাও আবার সমস্যা হুমকিতে সীমাবদ্ধ নেই। শারীরিক হেনস্থার মতো অভিযোগও উঠেছে। কিন্তু আমাদের তো মুখে কুলুপ! আমরা তো কিচ্ছুটি বলছি না! আমরা, যাঁরা অতি উৎসাহ দেখিয়ে আতস বাজি পোড়ালাম, তাঁদের মধ্যে কেউ একবারের জন্যও, ‘থাকার সমস্যা হলে, আমার বাড়িতে আসুন’ বললাম না তো!
আমরা ভণ্ড। তাই আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাও ভণ্ড। সেটাই তো হওয়া উচিত। তাই চিকিৎসকদের বিশেষ পোশাকের বদলে যায় সস্তার রেনকোটে। আর উপযুক্ত মানের মাস্ক চিকিৎসকের পরিবর্তে ব্যবহার করেন রাজনৈতিক নেতৃবর্গ।
মহারাষ্ট্রে দিন কয়েক আগেই করোনা মোকাবিলায় যুক্ত চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে। আমরাও আর পিছিয়ে নেই। আমাদের শহরেও চিকিৎসক মারা গিয়েছেন। কিন্তু এতকিছুর পরেও আমাদের হুঁশ নেই। আমরা মনে রাখতে চাই না, আমাদের রাজ্যে প্রয়োজনের তুলনায় প্রায় ৬০০০ নার্স কম, চিকিৎসকের অভাবে জেলার একাধিক সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে বিভাগ চালু করা যায় না, ল্যাব টেকনিশিয়ানের অভাবে নাকানিচুবানি খেতে হয়। এই পরিস্থিতিতে একের পর এক চিকিৎসক করোনা আক্রান্ত হলে আমাদের বাঁচাবে কে? আমরা এসব প্রশ্ন করতে চাই না। এসব প্রশ্নের উত্তর বড্ড জটিল। তার চেয়ে বরং ছবি আপলোড হোক, পোস্টার, ফ্লেক্স টাঙানো হোক! আমরা প্রচারে ব্যস্ত থাকি। কারণ, ওটাই আমাদের সবচেয়ে প্রিয়।
একদম সত্যি দিদি। সস্তার তামাশা ক্রমে প্রিয়তর হয়ে উঠছে আমাদের কাছে।
এই সমাজে এই ব্যবহার খুব স্বাভাবিক। আমাদের সমাজ কোনদিন দায়িত্বশীল বা সংবেদনশীল ছিল না। অবক্ষয় ক্রমবর্ধমান।