ভদ্রমহিলা থাকেন মধ্যমগ্রামের দোহাড়িয়ায়। সত্তরের উপর বয়স। ছোটো খাটো চেহারা। এখনও সোজা হয়ে গটগটিয়ে হাঁটেন।
আগে একটি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন। অবসর গ্রহণের পর বসে নেই। একটি কেজি স্কুল খুলেছেন। সেখানে নিজেও বাচ্চাদের পড়ান।
এমনিতে ওনার কোনও বড় সড় অসুখ নেই। মাঝে মাঝে জ্বর বা অন্য কোনও সমস্যা নিয়ে দেখাতে আসেন। একাই আসেন। উনি বিয়ে থাওয়া করেননি। ভাইয়ের সাথে থাকেন।
শনিবার ধুম জ্বর নিয়ে দেখাতে এসেছেন। সঙ্গে এসেছে ভাইয়ের ছেলে। সে অনুযোগ করল, দেখুন না, এই জ্বর নিয়েও গতকাল পিসিমা একাদশী পালন করছেন।
ভদ্রমহিলা হাসলেন। বললেন, আমার কিছু হবে না। আমার ভয় তোদের জন্য। এখন আমার বেশি কাছে টাছে আসিস নে।
আমি বললাম, নিজের জন্য ভয় পাবেন না কেন? মহামারীর ভয়ে লোকে কাঁটা হয়ে আছে। তাছাড়া করোনা ভাইরাস সংক্রমণে ভয় তো আপনাদের মতো বয়স্ক মানুষদেরই।
ভদ্রমহিলা বললেন, দ্যাখো ডাক্তার, আমি মহামারী বেঁচে ফেরা লোক। তুমি শক্ত করে আমার হাতটা একবার ধরো। তারপর অবশ্য নিজেও সাবান দিয়ে হাতটা ধুয়ো। ওতেই মহামারী পালিয়ে যাবে। তোমারা থাকতে মহামারীর ভয় কি?
আমি বললাম, আপনি মহামারী দেখেছেন?
তাহলে একটা গল্প শোনো। আমার তখন উনিশ বছর বয়স। যশোরে থাকতুম। দেখতে শুনতেও খারাপ ছিলুম না। পড়াশুনাতেও ভালো ছিলুম। ম্যাট্রিক পরীক্ষায় যশোর জেলায় দ্বিতীয় হয়েছিলুম। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানের সেনারা পূর্ব বঙ্গে হত্যা লীলা শুরু করল। আমাদের বাড়ি ইন্ডিয়া বর্ডারের চেয়ে খুব বেশি দূরে নয়। তাই আমরা প্রথম দিকে ততটা ভয় পাই নি।
কিন্তু মে মাসের পর পরিস্থিতি খারাপ হোল। শোনা গেল খান সেনারা আমাদের গ্রামের দিকে এগিয়ে আসছে। বাবা অত্যন্ত দুশ্চিন্তায় পড়লেন। বিশেষ করে আমাকে নিয়ে। কারণ কানাঘুষোয় শোনা যাচ্ছিল, সুন্দরী হিন্দু যুবতীরা যে বাড়িতে আছে সেই বাড়িতেই খান সেনাদের প্রথম পা পড়ে।
আমার মা ছোটো বেলাতেই মারা গেছেন। বাবা আমাকে আর দুই ভাইকে নিয়ে ইন্ডিয়ায় আসতে চাইলেন। কিন্তু বড় দাদা রাজি হোল না। সে দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়বে। এক রাত্রে সে গৃহত্যাগ করল। আর কোনও দিন তার কোনও খোঁজ পাইনি।
বাবা, আমি আর ছোটো ভাই বর্ডার পার হয়ে বনগাঁ উদ্বাস্তু শিবিরে এলাম। সেখানে প্রায় নারকীয় পরিস্থিতি। ভারত সরকারের রেশনে কোনও রকমে দুবেলার পেট চলে যায়। কিন্তু পয়ঃপ্রণালীর অবস্থা খারাপ। অত্যধিক ভিড়ে জন্তুর মতো আমাদের গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে।
কয়েকদিনের মধ্যেই কলেরা মহামারীর মতো উদ্বাস্তু শিবিরে ছড়িয়ে পড়ল। খান সেনাদের চাইতে সে কম নির্দয় নয়।
অসহায় মানুষগুলো দলে দলে মরতে আরম্ভ করল। মাত্র একদিনের বমি পায়খানায় বাবা মারা গেলেন। কিন্তু আমার তখন শোক করার মতোও অবস্থা নেই। আমি নিজেই কলেরায় আক্রান্ত হয়ে বেহুঁশ পড়ে আছি। মাথার মধ্যে একটাই বোধ কাজ করছে। ভাইটার কি হবে?
সেই ঘোরের মধ্যে মনে হোল কে যেন আমার একটা হাত আঁকড়ে ধরেছে। আমার মাথাটা তার কোলে তুলে পরম মমতায় আমার ঠোঁটের মধ্যে অমৃত ঢেলে দিচ্ছে।
আমি আস্তে আস্তে ভালো হয়ে উঠলুম। মেডিকেল কলেজ থেকে অনেক তরুণ ডাক্তার এসেছিলেন। তাঁরা আমাদের ওআরএস বানানো শেখালেন। বড় বড় গামলায় ওআরএস বানানো হত। দিব্যি শিখে নিজেই ওআরএস বানিয়ে অনেককে সুস্থ করে তুললুম। আমি তরুণ ডাক্তারদের মুখ ভালো করে দেখতুম। এদের মধ্যে কে আমার জীবন দাতা? একজন সুদর্শন, লম্বা তরুণ চিকিৎসককে দেখে সন্দেহ হয়েছিল। লজ্জায় মুখ ফুটে তাঁকে জিজ্ঞাসা করতে পারিনি।
তারপর বারাসাতের এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে আমার আশ্রয় মেলে। আমি কলেজেও ভর্তি হই। কিন্তু ওই অলৌকিক স্পর্শ আমি কোনও দিনও ভুলতে পারিনি।
সঙ্গে আসা ছেলেটি তাড়া দিল, চল পিসি। আরও রোগী বসে আছে।
ভদ্রমহিলা যাওয়ার সময় বললেন, মহামারীকে আমি ভয় পাই না। কারণ জানি শেষ পর্যন্ত মহামারীই মানুষের কাছে পরাজিত হবে। ওই অলৌকিক স্পর্শই মহামারীকে পরাজিত করবে। আমরা যারা বেঁচে থাকব, তারা মানুষ হিসাবে আরও ভালো হয়ে উঠবো।