গুজব কানে শোনার জিনিস। কানের সোনার জিনিসের মতই আকর্ষণীয়। গুজব ছড়িয়ে পড়লে মহামারী হয়, আবার মহামারী ছড়িয়ে পড়লে গুজব হয়। গুজবের মহামারী এবং মহামারীর গুজব দুটোই এই তুচ্ছ জীবনে দেখে ফেলেছি।
যেখানে আমার সরকারি চাকরির প্রথম পোস্টিং, সেই খড়গ্রাম ছিল গুজবের আঁতুড় ঘর। সাড়ে তিন বছরে তেত্রিশটা গুজবের মহামারী দেখেছি।
তার মধ্যে সবচেয়ে অদ্ভুত ও অশ্লীল গুজব ছিল ‘কোরো’। বারো থেকে বিরাশি বছরের পুরুষেরা দলে দলে হাসপাতালে আসছেন। তাঁদের বদ্ধমূল ধারণা গোপনাঙ্গটি আস্তে আস্তে দেহের ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে। অধিকাংশ মানুষই আসছেন আপত্তিকর অবস্থায়। লুঙ্গি বা পাজামার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে অঙ্গটি চেপে ধরে আছেন। যেন ছাড়লেই সেটা ফট করে হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে।
ধর্ম-টর্মের বর্ম ভেঙে পড়েছে। হিন্দু-মুসলমান কপালে, বুকে চুন লেপে পচা ডোবার কোমর জলে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে গল্প করছেন।
‘বুঝলে ঘোষদাদা, সবে শাদী-শুদা করেছি। এখন যদি যন্ত্রপাতিতে গণ্ডগোল হয়ে যায়, তাহলে বাড়িতে আগুন জ্বলবে। কিন্তু দাদা, তুমি তো দুই ছাওয়ালের বাপ, তুমি পানিতে কেন?’
ঘোষ রেগে বলছেন, ‘ওরে বেয়াদপ, অন্যেরটার দিকে না তাকিয়ে নিজের যন্ত্রের দিকে নজর দে। একমনে আয়াতুল কুরসি পড়।’
সেই খড়গ্রামের পাট কবেই চুকে বুকে গেছে। ধেড়ধেড়ে গ্রাম থেকে উত্তমগ্রামের পরিবর্তে মধ্যমগ্রামে ফিরে এসেছি। সরকারি চাকরির পাটও চুকেছে। সারাদিন খুপরিতে ঘুরে ঘুরে রোগী দেখে সংসার চালাই।
দিব্যি চলছিল। কিন্তু হঠাৎ হাজির হল আমাদের মতো দিন আনা দিন খাওয়া ডাক্তারদের চিন্তার কারণ ‘করোনা মহামারী’, চীন তার কারণ।
যে দেশই কারণ হোক, করোনা মহামারী কোনো দেশকেই ছাড় দিচ্ছে না। একমাত্র রঙ্গে ভরা বঙ্গদেশেই একটু যা দিশেহারা। বেশ কিছু মানুষকে মারতে সক্ষম হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রেনাল ফেলিওর, ইশ্চেমিক হার্ট ডিজিজ, সিভিয়ার ডায়াবেটিস (এটা কি বস্তু জানিনা) কৃতিত্ব নিয়ে যাচ্ছে।
আমাদের মতো খুপরি জীবি চিকিৎসকদের অবস্থা শাঁখের করাত। রোগী দেখলেও মরব, না দেখলেও মরব। মরতে যখন হবেই, শহীদের মৃত্যুই ভালো। বোতল থেকে, ইয়ে… স্যানিটাইজারের বোতল থেকে সাহস সঞ্চয় করে রোগী দেখতে থাকলাম। এবং রোগীর সাথে সাথে গুজবও দেখতে থাকলাম।
প্রথম জনতা কারফিউ এর দিন শুনলাম দুপুর রোদে ছাদে দাঁড়াতে হবে। এরোপ্লেন থেকে এন্টিভাইরাস ছড়ানো হবে। তারপর শুনলাম, থালা বাজানোর ভায়েব্রেশনে ভাইরাস ধ্বংস হয়ে যায়। এও শুনলাম প্রতি ঘন্টায় গরম জলে চুমুক লাগালে করোনার জলাঞ্জলি হয়।
ওষুধ নিয়ে তো নিত্যনতুন গুজব। তার ঠেলায় হাইড্রক্সি ক্লোরোকুইন বাজার থেকেই উধাও হয়ে গেছে। এজিথ্রোমাইসনও একই পথ অনুসরণ করত। কিন্তু বহুল পরিচিত ওষুধ এবং প্রায় সব কোম্পানিই তৈরি করে বলে এখনো বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। ইদানীং আবার গরীবের এন্টাসিড ফ্যামোটিডিনের দিকে সকলের নজর পড়েছে।
আজ আমার খুপরিতে পেটে ব্যথা নিয়ে একজন মাঝ বয়সী বউ এসেছিলেন। পেট টিপে টুপে মনে হল সাধারণ বদহজম। বললাম, ‘উল্টোপাল্টা খেয়েছিলেন নাকি?’
উনি রীতিমতো ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, ‘উল্টোপাল্টা কি খাব? খাচ্ছি তো রেশনের চাল, ডাল আর আলু সেদ্ধ। কোনদিন ভাগ্যে থাকলে ডিমের ঝোল। বর সোনার কাজ করতো। দেড় মাস কাজকর্ম নাই।’
বললাম, ‘তাহলে পেটে ব্যথা হল কেন?’
‘সেটা জানলে আপনার কাছে আসবো কেন? এই অকালে খামোখা আপনাকে ভিজিট দেবো কেন? নিজের চিকিৎসা নিজেই করতুম।’
আমি এবার পেটটা বাজিয়ে দেখবো বলে হাত বাড়াচ্ছি, হঠাৎ উনি চিৎকার করলেন, ‘রসুন।’
আমি ভ্যাবাচাকা খেয়ে হাত সরালাম। উনি আমাকে থামতে বলছেন কেন? পেট টিপে বুঝিনি বলেই তো বাজাতে চাইছিলাম। কাঁচুমাচু মুখ করে বললাম, ‘ইয়ে… আমাকে থামতে বলছেন?’
রোগিনী একগাল হেসে বললেন, ‘না না, সকালে খালি পেটে দুইখানা কাঁচা রসুন চিবিয়ে খেয়েছিলুম। তারপর থেকেই পেটে ব্যথা।’
‘রসুন?’
‘হ্যাঁ, ওই যে রসুন খেলে ভেতর থেকে কি একটা বেড়ে যায় না, যেটা করোনার সাথে লড়ালড়ি করে….’
‘ইমিউনিটি?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ… ঐটে বাড়ানোর জন্যই খেয়েছিলাম কাঁচা রসুন।’
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, ‘আর শুতে হবে না, এবার উঠে বসুন।’