লক ডাউনের সময়ে খারাপ রোগীদের নিয়ে মহা সমস্যা। যতই হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন থাক, কিছুতেই ভর্তি হতে চায়না।
বুকে ব্যথা নিয়ে ছটফট করতে করতে এক ভদ্রলোক এলেন। ঘণ্টা তিনেক ব্যথা হচ্ছে। ইনো, জেলুসিল, প্যান ডি- যতরকম গ্যাসের ওষুধ আছে সব কিছু দিয়ে চিকিৎসা চলেছে। ইসিজি করতে বললাম। একটি চ্যাংড়া ছেলে বলল, ‘ইসিজি করে কি হবে ডাক্তারবাবু। আপনি একটা গ্যাসের ইনজেকশন দিন না। আমার জেঠতুতো দাদারও এমন হয়েছিল। ইনজেকশন দিতেই কমে গেছিল।’
বিনীত ভাবে বললাম, ‘ইনজেকশন নিশ্চয়ই দেব। কিন্তু আপনি আগে ইসিজি করান।’
ছেলেটি বলল, ‘ইনজেকশন দিতে দেরী করলে গ্যাস যদি মাথায় উঠে যায়? বুক অবধি উঠে এসেছে। মাথায় উঠতে কতক্ষণ। আপনি তাড়াতাড়ি ইনজেকশন দিন। তারপর ইসিজি করাবেন।’
বললাম, ‘আপনি ইতিমধ্যেই গ্যাস কমানোর যাবতীয় ব্রক্ষ্মাস্ত্র প্রয়োগ করেছেন। তাতে গ্যাস উপরে ওঠা তো দুরের কথা, হাঁটুতে নেমে যাওয়া উচিৎ ছিল। তা স্বত্বেও ওনার যখন বুকে ব্যথা হচ্ছে তখন ইসিজি না করলে আমি চিকিৎসা করতে পারব না।’
ছেলেটি এমন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল, সত্য যুগ হলে শিওর ভস্ম হয়ে যেতাম। তারপর ভদ্রলোককে প্রায় চ্যাংদোলা করে পাশের ঘরে ইসিজি করতে নিয়ে যাওয়া হলো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ইসিজি হাজির। গ্রাফের অধিকাংশ রেখাই মধ্য লাইনের অনেক উপরে। বললাম, ‘রোগীর হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। শিগগিরি কোথাও ভর্তি করতে হবে।’
ছেলেটি বললেন, ‘অসম্ভব। এখন কোথায় ভর্তি করব? যেখানেই ভর্তি করব, করোনা হবে।’
‘করোনা হলে বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। কিন্তু একে এখুনি ভর্তি না করলে এনার বাঁচার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এই ওষুধগুলো তাড়াতাড়ি কিনে আনুন। আর একটা গাড়ি জোগাড় করুন। আর জি করে নিয়ে যেতে হবে।’
‘আর জি কর, সেতো অনেক দূর! কি ভাবে যাব?’
একজন অটোওলা ঘুরঘুর করছিলেন। বললেন, ‘যাবেন? রিজার্ভে চলে যাব। ভাড়া চার চাকার থেকে কম নেব?’
ছেলেটি ওষুধ নিয়ে ফিরে এলো। বলল, ‘ডাক্তারবাবু, সবইতো ট্যাবলেট। ইনজেকশন দেবেন না?’
বললাম, ‘সব ট্যাবলেট চারটে- চারটে করে চিবিয়ে খাবেন এখুনি। চেবাতে চেবাতে আর জি কর চলে যাবেন?’
ছেলেটি বলল, ‘হার্ট অ্যাটাক হয়েছে বললেন, তবু একটা ইনজেকশন দেবেন না আপনি? রাস্তায় যদি কিছু হয়?’
আমি বললাম, ‘কথা কম বলে তাড়াতাড়ি অটোতে ওঠাও। দেরী করলে বিপদ আরও বাড়বে।’
ঘণ্টা খানেকের মধ্যে সেই ইনজেকশন প্রিয় ছেলেটির ফোন পেলাম, ‘ডাক্তারবাবু, এখানেও তো ভর্তি নিতে চাইছে। ভর্তি হলে করোনা হবে নাতো? দুটো ইনজেকশন দিয়ে নিয়ে চলে আসব? বাড়িতে স্যালাইন, অক্সিজেনের ব্যবস্থা করতুম।’
বহু কষ্টে গালাগালটা চেপে গেলাম। বললাম, ‘বাড়ি আনলে ফেরার পথে আমার কাছ থেকে একেবারে ডেথ সার্টিফিকেটটা লিখে নিয়ে যেও। রাত্রিরে আর বিরক্ত কোরো না।’
ছেলেটি মিনমিন করে বলল, ‘তাহলে ভর্তিই করে দি। করে দি ভর্তি?’
এই অসময়ে চেম্বার করার সময় আমার অন্যতম সহায় ছিল, সাগর দত্ত মেডিকেল কলেজ। সেটাকে তিনদিন আগেই কোভিড হাসপাতাল ঘোষণা করা হয়েছে। তারপর আমি পড়ে গেছি সমস্যায়।
লক ডাউনে সাধারণ রোগীর সংখ্যা কিছুটা কমলেও এমারজেন্সি রোগীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। অনেকেই অন্তিম অবস্থায় খাবি খাওয়া রোগী ভ্যানে করে চেম্বারে নিয়ে আসছেন। তাঁদের কাছাকাছি সাগর দত্তে ধরে বেঁধে পাঠিয়ে দিচ্ছিলাম। গত সপ্তাহেই একটি কমবয়সী বুকে জল জমা ছেলেকে সাগর দত্তে পাঠিয়েছিলাম। ওখানে তাকে ভর্তি করে বুকের জল বের করে টিবি ডায়াগনোসিস করে তবে ছেড়েছে।
প্রায় একইরকম একটি মেয়েকে সাগর দত্তে পাঠিয়েছিলাম। কাল সে আবার আমার কাছে এসেছে। তাকেও সাগর দত্তে ভর্তি নিয়েছিল। এর আবার বুকে আর পেটে দু জায়গাতেই জল জমেছে। সেই জল বার করে পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু রাতারাতি কোভিড হাসপাতাল ঘোষণা করায় ওখানকার সব রোগীদের ছুটি হয়ে গেছে। বেচারা এক পেট জল নিয়ে কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। জল বের করে দিলেই হলোনা। সেটা নিয়ে আবার পরীক্ষা করতে হবে। লক ডাউনের কল্যাণে এনাদের স্বাস্থ্যের পেছনে খরচ করার ক্ষমতা প্রায় শূন্যে নেমে এসেছে।
সাগর দত্ত হাসপাতালের কোভিড হাসপাতালে রূপান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়ে বেশ গণ্ডগোলও শুরু হয়েছে। ওখানকার ইন্টার্নরা বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। ইন্টার্নশিপের সময় একজন হবু ডাক্তার মেডিসিন, সার্জারি, গাইনি, পেডিয়াট্রিক্স বিভিন্ন বিভাগে ঘুরে ঘুরে ডিউটি করে। কিন্তু কোভিড হাসপাতাল হলে কোভিড রোগী ছাড়া পুরো ইন্টার্নশিপে তাদের অন্য কোনো রকম রোগীর চিকিৎসা দেখার সুযোগ মিলবে না। একজন ডাক্তার হয়ে যাবে, একটিও প্রসব না করিয়ে। তারপর সে যখন প্রত্যন্ত গ্রামীণ হাসপাতালের লেবার রুমে আসন্ন প্রসবা মায়ের মুখোমুখি হবে, তখন কি করে সামাল দেবে একমাত্র ভগবানই জানেন।
দেখলাম, ইন্টার্নদের এই বিক্ষোভের খবরের নীচে মাথা মুণ্ডু কিছু না বুঝেই অনেকেই ডাক্তারদের উপর গায়ের ঝাল ঝেড়েছেন। অনেকেই বলেছেন, বিক্ষোভ রত ডাক্তারদের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করা উচিৎ। অনেকের মন্তব্যেই দুই, চার, ছয় অক্ষরের ছড়াছড়ি।
এই সব সর্বঘটের কাঁঠালি কলাদের ন্যূনতম ধারণাও নেই, কি ভাবে একজন ডাক্তার তৈরি হয়। একজন ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র যদি কোভিড ছাড়া অন্য কোনো রোগী দেখার সুযোগ না পায়, তাহলে কি করে সে স্টেথো বসিয়ে হার্টের ফুটো আছে কিনা বুঝবে? কি করে সে সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা শিখবে।
গ্রামীণ হাসপাতালে যখন বিষ খাওয়া রোগী আসবে সে কি করবে? একটি তড়কা জ্বরের বাচ্চা এলে কি করে সামলাবে? কিভাবে সে ভ্যাকসিন রাখার আই এল আর ঠিক আছে কিনা বুঝবে?
যাই হোক, সরকারি নির্দেশ, বিশেষত এই মহামারির সময়ে মেনে নিতেই হবে। খারাপ লাগুক, ভালো লাগুক, এই সরকারি নির্দেশ মানতে চিকিৎসক এবং সাধারণ মানুষ হিসাবে আমরা বাধ্য। কিন্তু অনেকেই আছেন, যারা এই সরকারি নির্দেশের ঊর্ধ্বে। নীচের ছবিটা দেখুন। ভাইরাল হওয়া ছবি। টাকার অঙ্ক দেখে আমারই আতঙ্ক হচ্ছে।
ছবিটা দিল্লীর একটি কর্পোরেট হাসপাতালের। করোনা রোগীদের জন্য প্রতিদিনের আইসিইউ এর ভাড়া ৫৩ হাজার টাকা। ভেন্টিলেটর লাগলে ৭২ হাজার টাকা। পরীক্ষা নিরীক্ষা, ওষুধ পত্র ও অন্যান্য খরচ আলাদা। সব মিলিয়ে দৈনিক খরচ প্রায় লাখ দেড়েক। কলকাতার কর্পোরেট হাসপাতাল গুলিতেও খরচ প্রায় এমনই বা এর চেয়েও বেশি। কয়জনের এই অর্থ ব্যয় করে চিকিৎসা কেনার ক্ষমতা আছে? ব্যবসায়ীদের হাতে স্বাস্থ্যকে ছেড়ে দিলে যা হওয়ার ঠিক তাই হচ্ছে। সরকার এই দিকে একটু নজর দেবে না? দেবে না একটু এই দিকে নজর?