নৈহাটির আম্পান বিধ্বস্ত কলোনি এলাকা গোয়ালাফটক। সেখানেই স্বাস্থ্য শিক্ষা নির্মাণ, প্রয়াস ও বারো ঘর এক উঠোনের আয়োজনে শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ ও ওয়েস্টবেঙ্গল ডক্টরস ফোরামের সহযোগিতায় ১৫ই জুন, ২০২০ সোমবার হল স্বাস্থ্য শিবির।
“””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””
হাসপাতালে গেলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিচ্ছে। বলছে, এখন যাও, কোন কাজ হবে না। একেবারে ন-মাসে এস। তিন মাস ধরে ঘুরছি নৈহাটি হাসপাতালে। লকডাউনে গাড়ি ঘোড়া চলেনি। এই অবস্থাতেই আধ ঘণ্টা হেঁটে নৈহাটি হাসপাতালে গিয়েছি। তবুও ওরা কার্ড করেনি। একনাগাড়ে ক্ষোভ উগরে দিয়ে একটু থামল ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা কবিতা রাজবংশী।
“আমার কোন ওষুধ পড়ছে না দিদি!! তাই ভাবলাম আপনাদের মেডিকেল ক্যাম্পে যাই, ওখানে তো ডাক্তার আছে, যদি আপনারা দুটো কিছু ওষুধ দেন!!” কবিতাকে আম্পান বিধ্বস্ত মেডিকেল ক্যাম্পের জন্য বরাদ্দ আয়রন, ফলিক অ্যাসিড ও বি কমপ্লেক্স জাতীয় কিছু ওষুধ দিয়ে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে নিয়মিত যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হলো। সেই সঙ্গে এটাও বোঝানোর চেষ্টা করা হলো ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা একজনকে মেডিকেল ক্যাম্পে চেকআপ করা সম্ভব নয়। বুঝলও। ওষুধ পেয়েই খুশি কবিতা। শুধু বলল, “আমার মত কত পোয়াতিরা হাসপাতালে যাচ্ছে, কিন্তু কার্ড হচ্ছে না। ওরাও যদি আপনাদের মেডিকেল ক্যাম্পের কথা খবর পেত!!!!”।
কিছুদিন আগেই হাসপাতালে ভর্তি হতে না পেরে মৃত সন্তান প্রসব করেছেন সালকিয়ার এক মহিলা। কবিতার কথায় সেই ঘটনার কথা মনে পড়ল, সত্যিই বড় ভয় হচ্ছে কবিতাদের জন্য!!
গত কয়েক মাসের লকডাউনে কোমর ভেঙেছে এই অঞ্চলের। আম্পানে ভেঙেছে ঘর। ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় সব বাড়িই। কারো বাড়ির টালির চাল ভেঙেছে, টিন উড়ে গেছে, কারো বা মাটির দেয়াল ভেঙে গেছে। এলাকার বেশিরভাগ মানুষই রাজমিস্ত্রি ও দিনমজুরির নানান কাজের সঙ্গে যুক্ত। তিন মাস কাজ না থাকায় খাবার সংস্থান নেই। তবে প্রায় প্রত্যেকেরই রেশন কার্ড রয়েছে। সরকারি রেশনও পেয়েছে। কিন্তু ওই টুকুই। এলাকার মানুষের কাছেই শুনলাম পানীয় জলের অবস্থা বেশ খারাপ। সেই মত পেটের রোগ, চর্মরোগও নিত্যসঙ্গী।
তীব্র দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করা গোয়ালাফটক এলাকার মানুষের কাছে স্বাস্থ্য সচেতনতা বা ডাক্তার দেখানো এক প্রকার বিলাসিতা। কারণ বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তার দেখাতে অনেক খরচা। অন্যদিকে করোনার ভয়ে সরকারি হাসপাতালের ফটক এখন বন্ধ। যেন করোনা আসায় পৃথিবী থেকে সব রোগ ধুয়ে মুছে গেছে! অন্যদিকে জনগণের ধারণা করপোরেট পুঁজির ঝা চকচকে হাসপাতালগুলির দরজাতেই স্বাস্থ্যদেবী লক্ষ্মীর মত বিরাজ করেন। গরিব গুরবো এই সব ইমলি ঝিমলি মানুষগুলোর কাছে সুস্থ থাকার চেয়ে বেঁচে থাকা অনেক বেশি প্রয়োজনের। তাই পেটের গোলমাল থেকে গায়ের ঘা সব কিছুই ঠিক হয় নিজের নিয়মে। অবশ্য কিছু নাছোড়বান্দা সমস্যার দাওয়াই দেয় স্থানীয় ওষুধের দোকান ও হাতুড়ে। কখনো কমে, কিছু সঙ্গে থেকে যায় আজীবন। আর ভগবানের ভরসায় চলতে থাকে কবিতারা। স্বাস্থ্য সেখানে গল্প কথা।
অথচ রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের স্বাস্থ্যরক্ষার দায়িত্ব ছিল সরকারের। যাক গে, সে সব কথা আর কে মনে রেখেছে!
গত সোমবার এই গোয়ালাফটক এলাকাতেই স্বাস্থ্য শিবিরের আয়োজন করা হয়েছিল। WBDF এর পক্ষ থেকে চিকিৎসক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ডাঃ পুণ্যব্রত গুণ, ডাঃ রাজীব পাণ্ডে, ডাঃ শিবেন্দ্রনাথ দাস, ও ডাঃ শুভাশীষ বিশ্বাস।
অবশ্য তার আগে থেকেই হালিশহর বিজ্ঞান পরিষদের ত্রিদিবদা, রঞ্জনদারা ওই এলাকায় খোঁজখবর নিতে গিয়েছিলেন। এদের সঙ্গে মিলে সৈকত, নীলাদ্রি, শুভজিৎ, অর্ক, সুস্মিতা, শিব ওই এলাকার মানুষের সমস্যা নিয়ে কাজ শুরু করেছিল। এরপর স্বাস্থ্য শিক্ষা নির্মাণের সদস্যরাও এই প্রচেষ্টার সঙ্গে যুক্ত হন। স্বাস্থ্য শিক্ষা নির্মাণের পক্ষ থেকে সুদীপদা, আত্রেয়ী, দেবাশীস, অরূপদা, অভিজিৎদা, সুনন্দাদি ওই এলাকার মানুষদের সঙ্গে গিয়ে কথা বলেন ও তাঁদের সমস্যাগুলো বোঝার চেষ্টা করেন। এবং প্রয়োজন বুঝে তারাই স্বাস্থ্য শিক্ষা নির্মাণের অন্যতম সংগঠক পুণ্যব্রত গুণকে ওই এলাকায় মেডিকেল ক্যাম্প করার অনুরোধও করেন।
“স্বাস্থ্য শিক্ষা নির্মাণ” গত দেড় বছর ধরে নৈহাটির হাজিনগর ও গরুর ফাঁড়ি এলাকায় তাদের কম খরচের যুক্তিসঙ্গত চিকিৎসার মডেল ক্লিনিক চালানোর পাশাপাশি বিভিন্ন রোগের বিষয়ে মানুষকে সচেতন করার কাজ করে চলেছে। এবং আগামীতে গোয়ালাফটক এলাকায় ধারাবাহিকভাবে কাজের পরিকল্পনাও করেছেন এরা।
এদিনের ক্যাম্পে সবচেয়ে বেশি মানুষ এসেছিলেন ব্যথা ও নানান রকম চর্ম রোগের সমস্যা নিয়ে। এছাড়াও সাধারণ সর্দি কাশি জ্বর, হাই প্রেসার ও ডায়াবেটিসের রোগী মিলিয়ে প্রায় ১০০ জনের মত চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন স্বাস্থ্য ক্যাম্পে। রোগ নির্ণয়ের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ওষুধও দেওয়া হয় ক্যাম্প থেকে।