শেষ তিন- চার দিন ধরে ফোন পাচ্ছি। লোকজন বেশ সংকোচের সাথে জিজ্ঞাসা করছেন, ‘ডাক্তারবাবু আপনার কি কিছু হয়েছে?’
‘কিছু হয়েছে মানে?’
‘মানে শুনলাম… ইয়ে…. এখানে সবাই বলছে আপনার নাকি করোনা হয়েছে? আমি কিন্তু ঠিক বিশ্বাস করিনি।’
একটু রসিকতা করার ইচ্ছা থাকলেও এই গুজবের বাজারে সেসব আর করছি না। স্পষ্ট বলে দিচ্ছি, ‘এখনো হয়নি। হলে নিশ্চয়ই খবর পাবেন।’
আমাদের শহর এখন গুজব আর আতংকের শহর। করোনা প্রতিরোধের জন্য যে যা পারছেন, করছেন। সকালে গরম জলে লেবু দিয়ে খাচ্ছেন। রসুনের রস খাচ্ছেন। কাঁচা হলুদ চিবিয়ে খাচ্ছেন। যাঁরা আর্থিক সচ্ছল তাঁরা ভিটামিন-সি, মাল্টিভিটামিন, ভিটামিন-ডি কিচ্ছু বাদ দিচ্ছেন না। একটা নামকরা কোম্পানির জিংক যুক্ত পাঁচমিশালী ভিটামিন ট্যাবলেট মার্কেট থেকে হাওয়া হয়ে গেছে।
অনেকেই বাজার-টাজার করে এনে আলু- পটল, মাছ- মাংস স্যানিটাইজ করছেন। সেটাও তবু মানা যায়। কিন্তু অনেকেরই স্যানিটাইজেশনের বিষয়টা প্রায় বাতিকের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। তাঁরা অবসেসিভ-কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার রোগীর মতো আচরণ করছেন।
অনেক রোগী খুপরিতে ঢুকে প্রথমেই স্যানিটাইজারের বোতল থেকে দু-চার ফোঁটা তরল বসার চেয়ার, আমার টেবিলে ছড়িয়ে দিচ্ছেন।
আজ এক ভদ্রমহিলা গঙ্গাজলের মত আমার গায়ে কয়েক ফোঁটা স্যানিটাইজার ছিটিয়ে দিলেন। মানে চেয়ার-টেবিলের সাথে তিনি ডাক্তারকেও স্যানিটাইজ করে নিলেন।
ওদিকে রোগীর সংখ্যা রোজই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। অধিকাংশই জ্বরের রোগী। জ্বর আসলেই এখন অনেকে গন্ধ শুঁকছেন। একজন বললেন, ‘ডাক্তারবাবু, খাবার-দাবারের গন্ধ পাচ্ছি না। কিন্তু ডেটলের গন্ধ, ডেনড্রাইটের গন্ধ এগুলো দিব্যি পাচ্ছি।’
একজন রোগী দুদিন আগেই দেখিয়ে গেছেন। জ্বর কমছে না। আবার এসেছেন। তার পুরোনো প্রেসক্রিপশন পুরো সাদা। আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘এ কি? আমি কোন ওষুধপত্র লিখিনি নাকি?’
উনি বিব্রত মুখে জানালেন, ‘হ্যাঁ লিখেছিলেন। কিন্তু বাড়ি গিয়ে প্রেসক্রিপশন স্যানিটাইজ করতেই সব লেখা উবে গেছে।’
যাঁরা এসময় মারা যাচ্ছেন তাঁদের মৃত্যু সত্যিই ভয়াবহ। খুব খারাপ রোগীকেও কেউ হাসপাতালে ভর্তি করছেন না। বাড়িতে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন। মারা যাওয়ার পর তাঁদের বাড়ি গিয়ে দেখছি, দু- চারজন বাড়ির লোক ছাড়া আর কেউ নেই। কেউ প্রাণখুলে কাঁদছেন না। দু- তিনজন মিলে মৃতদেহ নিয়ে শ্মশানে রওনা দিচ্ছেন।
মধ্যমগ্রামের এখন সব পাড়াতেই করোনা রোগী। রোগীর সংখ্যা আরো অনেক বাড়তো যদি সকলকে পরীক্ষা করানো যেত। করোনা রোগী ধরা পড়লেই জলের শ্রাদ্ধ করে রাস্তা স্যানিটাইজ করা হচ্ছে। বাঁশ দিয়ে রোগীর বাড়ি বা রাস্তা ঘিরে করোনা মহামারী আটকানোর চেষ্টা হচ্ছে।
এসব অবৈজ্ঞানিক কাজকর্ম ও প্যানিক সৃষ্টির জন্য সবচেয়ে বেশি দায় মিডিয়ার। আমাদের মত পাতি ডাক্তাররা হাজার চিৎকার করলেও সাধারণ মানুষ শোনেন না। মিডিয়ার সেই ক্ষমতা ছিল। কিন্তু তারা সেই ক্ষমতার অপব্যবহার করে মানুষকে আরো বেশী ভীত করে তুলেছে। দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুগুলিকে বারবার হাইলাইট করা হচ্ছে। ভয়ে অনেকেই বাস্তব বুদ্ধিও হারিয়ে ফেলছেন।
অথচ করোনাকে যতটা ভয়ঙ্কর ভাবে দেখানো হচ্ছে, আজ স্পষ্ট বুঝতে পারছি এই রোগ ততটা ভয়ঙ্কর নয়। সুস্থ সবল ব্যক্তিরা তো বটেই, বেশ বয়স্ক সুগার- প্রেসারে আক্রান্ত ব্যক্তিরাও দিব্যি সুস্থ হয়ে উঠছেন। রোজই আমার একাধিক রোগীর রিপোর্ট পজিটিভ আসছে। গোনা ছেড়ে দিয়েছি। প্রায় সকলেই বাড়িতে আইসোলেশনে থাকছেন এবং সুস্থ হয়ে উঠছেন।
আরেকটি নতুন গুজব- ফ্লু ভ্যাকসিন নাকি করোনা প্রতিরোধ করতে পারে। প্রচুর মানুষ ফ্লু ভ্যাকসিন নিতে চাইছেন। ভ্যাকসিনের কোম্পানি থেকেও লোক আসছেন আমার কাছে। কি বিচিত্র পরিস্থিতি।
আমার প্রায় সমবয়সী এক মাস্টার মশাইয়ের জ্বর কমছে না। যেই বললাম, ‘এবার তাহলে করোনার জন্য সোয়াব টেস্ট করান’। অমনি মাস্টার মশাই চোখমুখ উল্টে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। ওনাকে চিত করে শুইয়ে পা উপরে তুলে জ্ঞান ফেরানো হলো।
ওনার করোনা ধরা পড়েছে। হোম আইসোলেশনে আছেন। প্রায় রাতেই ফোন করেন। বলেন, ‘দাদা, দিব্যি আছি। জ্বর কমে গেছে। মিথ্যে মিথ্যে ভয় পাচ্ছিলাম।
আমি যথাযথ সুরক্ষা নিয়ে নির্ভয়েই রোগী দেখছি। জানি হয়তো করোনা আক্রান্ত হতে পারি। কিন্তু ভাগ্য খুব খারাপ না হলে মরবো না। আমার ভয় না পাওয়ার একটাই কারন, শেষ কয়েক মাস আমি টিভি দেখিনা।
মধ্যমগ্রামে যেভাবে রোগ ছড়াচ্ছে, তাতে বলাই যায় আমরা মহামারীর পিকের কাছাকাছি আছি। আর কিছুদিন বাদে করোনার প্রকোপ আস্তে আস্তে কমতে শুরু করবে।
ভয় না পেয়ে সতর্ক থাকুন। নাক-মুখ আপাতত একটা সার্জিক্যাল মাস্কের আড়ালে থাকুক। রাস্তাঘাটে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখুন।
আর নিজের পাড়ার করোনা আক্রান্ত মানুষগুলির, লক ডাউনে কাজ হারানো নিরন্ন মানুষগুলির পাশে থাকুন।
মানবিকতার কাছে পরাজিত হোক মহামারী।
ভালো লেখা।