সারি সারি দোকানের শাটার বন্ধ। চারিদিকে শ্মশানের নিস্তব্ধতা। তার মধ্যে শুধু কাকুর ওষুধের দোকানে আলো জ্বলছে, আর আমার খুপরিতে।
রাত মাত্র সাড়ে ন’টা বাজে। এসময় মধ্যমগ্রাম স্টেশনের পাশের এই জায়গায় ভিড়ে হাঁটা চলা মুশকিল। আমি স্কুটার নিয়ে এসে নিজের চেম্বারের সামনে স্কুটার রাখার জায়গা পাই না। আজ শুধু আমার একার স্কুটার।
খুপরিতে বসে শুনছিলাম কাকু একজনকে ধমকাচ্ছে। কাকুর একটু অসুখ অসুখ বাতিক আছে। ধারে কাছে কুকুর এলেই বাড়ি ফিরে রাত বারোটায় স্নান করে। পরবর্তী তিনদিন ধরে কুকুরের কামড়ানোর ভ্যাকসিন নেওয়া উচিৎ কিনা ক্রমাগত সেই প্রশ্ন করে।
একজন ওষুধ কিনতে এসে কাউন্টারে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছেন। কাকু গজগজ করছে, ‘আপনার তো আক্কেল জ্ঞান নেই। জানেন আপনার হাত থেকেও এখানে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে যেতে পারে’। আমি জানি লোকটি ওষুধ নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পরই কাকু স্পিরিট দিয়ে কাউন্টার মুছবে।
এর মধ্যে জেনে গেছি প্রধানমন্ত্রী তিন সপ্তাহের জন্য সারাদেশে লকডাউন ঘোষণা করেছেন। বড় অসহায় লাগছে। একেবারে তিন সপ্তাহের লকডাউন না করে সাতদিন সাতদিন করে বাড়ালে হয়তো এতটা অসহায় লাগতো না।
কাশতে কাশতে একজন খুপরিতে ঢুকলেন। সমস্যা হলো সকলের মুখই মাস্কে ঢাকা থাকায় পুরনো রোগীদেরও চিনতে পারছি না।
গলার আওয়াজ শুনে চিনতে পারলাম। আমাদের উল্টো দিকের পাড়ায় থাকেন। মধ্যমগ্রাম স্টেশনে লটারির দোকান আছে।
সঙ্গে তাঁর স্ত্রী এসেছেন। স্ত্রী বললেন, পাঁচ দিন ধরে জ্বর আর কাশি। বারবার বলছি আপনার কাছে আসতে। সেই এলো, ঝামেলা পাকিয়ে।
ভদ্রলোক বললেন, কিভাবে আসব ডাক্তারবাবু? গত দশ দিন লটারির দোকান বন্ধ। এক পয়সাও আয় নেই।
প্রেশার প্রচুর বেড়ে রয়েছে। জিজ্ঞেস করে জানলাম গত চারদিন তিনি প্রেশারের, সুগারের কোনো ওষুধই খান না। এন আর এস হাসপাতালে দেখাতেন। ট্রেন, বাস বন্ধ থাকায় সেখানেও যেতে পারছেন না।
আমি বললাম, আপাতত কিনে খান। আমি বাইরের ওষুধ লিখে দিচ্ছি।
ভদ্রলোক হাসলেন। বললেন, ওষুধ কেনার পয়সা জোগাড় করাই মুশকিল। অভাবের সংসার। লটারির দোকানে আর ক’টা টাকা হতো। আর এখন তো দু’বেলার চাল-ডালই জুটছে না। বেঁচে থাকার একটা পথই খোলা আছে ডাক্তারবাবু। এবার চুরি-ডাকাতি করতে হবে।
ধমক লাগালাম, একদম বাজে বকবেন না। মানুষের জীবন অনেক লম্বা। কোনো ভাবে সপ্তাহ তিনেক কাটালেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
ভদ্রলোক পকেটে হাত ঢোকাচ্ছিলেন। বললাম, ভালো থাকলে একেবারে তিন হপ্তা পরে আসবেন। তখন ভিজিট দেবেন।
ওনারা চলে যাওয়ার পরে মনে হলো সত্যিই কি সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে? সেই ঠিক হওয়া পৃথিবীটা দেখার জন্য আমি থাকব তো? স্যানিটাইজারের শেষ বোতলটাও শেষ হয়ে গেছে। সাবান দিয়ে হাত ধুলাম।
দশদিন অন্তর একজন দেখাতে আসেন। সব রোগী শেষ হওয়া পর্যন্ত চুপচাপ বসে থাকেন। রাত এগারোটা, সাড়ে এগারোটা যাই বাজুক কারো আগে ঢুকতে চান না। ভাঙাচোরা শরীর, তোবড়ানো গাল। চেহারা দেখে বয়স আন্দাজ করা মুশকিল।
তিনি সারাদিন ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন বাড়িতে জমি পরিস্কার করেন। নানারকম ফাই-ফরমাস খাটেন। আমার কাছে যখন আসেন হাতের প্লাস্টিকে থাকে তিনশো গ্রাম চাল, একশো গ্রাম ডাল, দুটো আলু, দশ টাকার তেল আর টুকিটাকি।
খুপরিতে ঢুকে হাত বাড়িয়ে বলেন, প্রেশারটা মাপো তো ডাক্তার।
আমি প্রেশার দেখে মাথা নাড়ি, ফার্স্টক্লাস।
পকেট থেকে সযত্নে দু’বছর আগের প্রেশক্রিপশান বের করে বলেন, এখানে প্রেশারটা লিখে রাখো।
প্রেশক্রিপশানের পুরোটাই প্রেশার লিখতে লিখতে ভরে গেছে। কোনো একটা ফাঁকে তারিখ দিয়ে প্রেশার লিখে দি।
তিনি একটা দোমড়ানো- মোচড়ানো একশো টাকার নোট বার করে বলেন, কিছুতো রাখো। নইলে তোমার চলবে কি করে ডাক্তার?
প্রত্যেকবারই আমি বলি, পরের বার দেবেন।
তিনি বারো টাকা পাতার প্রেশারের ওষুধ এক পাতা নিয়ে বাড়ি যান। সে বাড়িতে আর কে আছে আমি জানি না। শুধু জানি ঐ পাতা যেদিন শেষ হবে, তিনি আবার আসবেন।
উনি অনেক দিন আসেন নি। করোনা মহামারী ছড়ানোর পর আজ প্রথম ভয় লাগছে। উনি আর আদৌও আসবেন তো?