আজ যারা ভুমিষ্ঠ হয়েছে আগামীকাল তারা বড় হবে। আজ যাঁরা বড় তাঁরা আগামীতে বৃদ্ধ হবেন। জীবনের এটাই নিয়ম। নদীর ঢেউয়ের মতো এভাবে প্রবাহ চলে আসছে জীবনের, সেই অতীত থেকে, যখন থেকে মানুষ নামে জীবকুলের সৃষ্টি হয়েছিল এ পৃথিবীতে।
শিশু মনস্তত্ত্ব অত্যন্ত জটিল একটা বস্তু। তা সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করতে গেলে দরকার শিশুদের গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা। নিবিড় ভাবে অনুশীলন করা তাদের মন মানসিকতা, ভালো লাগা মন্দ লাগা ইত্যাদি। আজকের নাতিদীর্ঘ এ লেখাতে সে সব জটিল প্রসঙ্গে যাচ্ছি না। কেবল শিশুদের নিয়ে কিছু চমকপ্রদ তথ্য দিচ্ছি আপনাদের। আমি পেশায় একজন শিশু চিকিৎসক। দীর্ঘদিন ধরে এ পেশায় নিযুক্ত থাকার সুবাদে তাদের একদম কাছ থেকে দেখেছি। বোঝার চেষ্টা করেছি তাদের। অনেক ক্ষেত্রে তাদের আচার আচরণের ব্যাখ্যা পেয়েছি, অনেক ক্ষেত্রে পাইনি। তাদের সম্বন্ধে যা জেনেছি তার থেকে না জানার পাল্লা অনেক বেশি ভারি হলেও সামান্য যেটুকু জানা তাও কম চিত্তাকর্ষক হয়নি আমার কাছে। সেই বিপুল অভিজ্ঞতার ভান্ডার থেকেই কিছু বিষয় ভাগ করে নিচ্ছি আপনাদের সঙ্গে।
শিশু ও প্রেম
হয়তো অবাক লাগতে পারে। তবু শুনুন। আজ্ঞে হ্যাঁ। শিশুরাও কিন্তু একে অন্যের প্রেমে পড়ে এবং তা সম ও বিসম এই দুই লিঙ্গেই হতে পারে। এ প্রেমের শারীরিক ও মানসিক দুই দিকই থাকতে পারে। তাদের প্রেমের গভীরতাও কম নয়। তারাও সম্পর্কের ব্যাপারে খুব পজেসিভ। অনেক ক্ষেত্রে বড়দের থেকেও বেশি। তাদেরও বিচ্ছেদ যন্ত্রণা হয়। এ নিয়ে অনেক অভিভাবক খোরাক করেন তাদের। এ অবশ্য তাঁদের অনুভূতিহীনতা বা অজ্ঞতা। তাঁদের উচিত এ ব্যাপারটাকে উপেক্ষা না করা। চিন্তার এমন ধারা সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে আসা। ছোটরা ছোট, তাই তারা অপরিণত। তাদের মতো করে তাদের কাছে ব্যাখ্যা করা উচিত, প্রেম-ভালোবাসা জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন ও ইতিবাচক একটা বিষয়। এও বোঝানো উচিত তারা যদি প্রেমে পড়ে তবে তা দোষের নয়। বরং শারীরবৃত্তীয় ও মানসিক স্বভাবিকত্ব।
শিশুও চায় তাদের কথার শ্রোতা হোক
স্বাভাবিক বুদ্ধিবৃত্তির শিশু দুই থেকে তিন বছর বয়সের মধ্যে অর্থবোধক কথা বলতে শেখে। পাশের মানুষের সঙ্গে ভাব বিনিময় করতে শেখে। কিন্তু তার আগে থেকেই সে অনেক কিছু বলতে চায়। যদিও সঠিক ভাবে বোঝাতে পারে না তার মনের ভাব। যখন শিশু একটা দুটো শব্দ বলতে শেখে, যাকে বলে ব্যবলিং, তখন থেকেই সে চায় তারও অনেক মনোযোগী শ্রোতা হোক। তাঁরা শুনুন ও বোঝার চেষ্টা করুন তারা কি বলছে।
এর অন্যথা হলে তারা অসন্তুষ্ট হয়। কষ্ট পায়। আজকের অনুপরিবার ও ব্যস্ততার যুগে অনেক বাড়িতেই কেয়ারটেকার শিশুদের বড় করেন। তাঁরা অনেক ক্ষেত্রে শিশুদের সঙ্গে বেশি কথা বলেন না। তাদের আপাত অর্থহীন কথাবার্তার হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য মোবাইল ধরিয়ে দেন শিশুদের হাতে। শিশু যত শুনবে তত বলবে। যত দেখবে তত দেরিতে বলবে। ফলে মোবাইল দেখায় মগ্ন থাকা শিশুদের কথা বলতে শেখায় দেরি হয়। এ ব্যাপারটা গুরুত্ব দিয়ে বুঝুন। তাদের সঙ্গে কথা বলুন। তাদের কথা মনে দিয়ে শুনুন। হাতে মোবাইল দেবেন না। দিতে দেবেন না। টেলিভিশনও কম দেখে যাতে সে ব্যাপারে খেয়াল রাখবেন।
শিশুরা বড়দের থেকেও গুরুত্ব পেতে ভালোবাসে
শিশুরা প্রত্যেকে ছোট হলেও এক একজন করে পরিপূর্ণ মানুষ। অন্যন্য মানুষের মতো তারাও শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও গুরুত্ব পেতে ভালবাসে। আমরা অভিভাবকেরা এ ব্যাপারটাও একেবারে মনে রাখি না। মাথায় রাখিনা। বড়দের মধ্যে কথা বলতে এলে অকারণে তাদের সঙ্গে কর্কশ ব্যবহার করি। জ্যাঠা বলে বিদ্রুপ করে তাদের ধমকে দিই। এটা করলে ভবিষ্যতে কোনও কিছু নিজে নিজে করতে গেলে তাদের আত্মবিশ্বাসে ঘাটটি পড়ে। সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে তারা। হীনমন্যতার শিকার হয়। তাদের কোনও মতামতকে দূর-ছাই না করে গুরুত্ব দেবেন। পরিবারের মধ্যে তাদের ছোট ছোট দায়িত্ব দিয়ে বোঝাবেন, আপনারা তাদের যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছেন।
শিশুরা খুব আবেগপ্রবণ, অভিমানী
শিশুরা খুব আবেগপ্রবণ সাথে খুব অভিমানীও। কিন্তু অনেক সময়ে দ্বিধার কারণে তারা তাদের অভিমান ব্যক্ত করে না। মনের মধ্যে জমতে থাকে পুঞ্জীভূত মনখারাপ, অবসাদ ও বিষাদ। এভাবে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়। ব্যক্তিত্বের বিকাশ ব্যাহত হয়। অনেক সময় অসম্ভব গুটিয়ে যায় বা খুব ভায়োলেন্ট হয়ে ওঠে তারা। এ ব্যাপারটা খুব যত্ন করে মনে রাখতে হবে। একটা জিনিস শিশুদের সঙ্গে একদম করবেন না। তা হলো অন্য শিশুদের সঙ্গে তাদের ভালমন্দের তুলনা। এই সব শিশুরাই বড় হয়ে জীবন চলার পথে পরস্পরের সঙ্গে অস্বাস্থ্যকর ও নেতিবাচক প্রতিযোগিতায় মাতে।
চরিত্রগত ভিন্নতা
পৃথিবীতে কোনও মানুষের সঙ্গে অন্য কোনও মানুষের শতকরা একশ ভাগ প্রকৃতিগত মিল হয় না। শিশুদের ক্ষেত্রেও ওই একই ব্যাপার। এমন কি তারা আইডেনটিক্যাল টুইন হলেও অনেক ব্যাপারে আলাদা হয়। (গর্ভকালের একদম প্রথম পর্যায়ে শিশুর প্রাচীনতম সত্তা জাইগোট আড়াআড়ি ভাবে ভেঙে দুটো জাইগোট ও কালক্রমে দুটো শিশু তৈরি হয়ে তারা হয় আইডেনটিক্যাল টুইন)।
কোনও শিশু বহির্মুখী, কোনও শিশু অন্তর্মুখী। তাদের প্রত্যেকের পছন্দ ও ভাল লাগা ভিন্ন ভিন্ন। তাদের পাশে দাঁড়ান। সর্বদা চেষ্টা করুন তাদের ভালমন্দ লাগাকে নৈতিক সমর্থন জানানোর। তাতে তাদের নিজের মতো করে বেড়ে উঠতে সুবিধা হয়।
শিশুর মেজাজ
অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃতিগতভাবে শিশু খুব ঠান্ডা প্রকৃতির, আবার অনেক ক্ষেত্রে সে ভীষণ রাগী হয়। তার রাগকে উপেক্ষা না করে উৎস সন্ধানের চেষ্টা করুন। হতে পারে সে অকারণে রাগ করছে। অথবা এও হতে পারে তার রাগ করার যুক্তিযুক্ত কারণ আছে। প্রথমটার ক্ষেত্রে শিশুকে যুক্তি দিয়ে বোঝান তার কোনখানে ভুল হচ্ছে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে শিশুর প্রতি আচার আচরণে নিজেরা সংযত হন। পাল্টা রাগ করবেন না তার উপর। তাতে পরিস্থিতি জটিলতর হবে। শুধু নিজেকে নয়,তাকেও গুরুত্ব দিন। নতুবা তা আগামীতে আপনার সঙ্গে দূরত্বের কারণ হতে পারে।
শিশুর সাফল্য ও ব্যর্থতা
সাফল্য ও ব্যর্থতা জীবনের অঙ্গ। বড়দের মতো শিশুরাও সব ক্ষেত্রে আশানুরুপ সাফল্য অর্জন করতে পারে না। পারা সম্ভব নয়। বড়রা মানসিক ভাবে থিতু হওয়ার কারণে সাফল্য ও ব্যর্থতাতে মনের স্থিতিকে সহজে বজায় রাখতে পারে। শিশুদের ক্ষেত্রে ব্যর্থতার কারণে অবসাদ অনেক বেশি। আদর্শ অভিভাবক হন। কোনও ব্যাপারে শিশুর অকৃতকার্যতায় সর্বদা তার পাশে থাকুন। নয়তো তার ভবিষ্যৎ ব্যর্থতাগুলো সে আপনার থেকে লুকোবে। আপনি টেরও পাবেন না ভিতর ভিতর মানসিক ভাবে তার ভেঙেচুরে যাওয়া । তাদের সামলে রাখতে নজর রাখুন পরিস্থিতির দিকে।
শিশুর প্রাইভেসি বা স্পেস
শিশুও প্রাইভেসি চায়। স্বাধীন হতে চায় অনেক ব্যাপারে। সে অবদমিত হওয়া এবং অকারণেও শাসিত হওয়া পছন্দ করে না। তার ইচ্ছে, সাধ, শখ নিয়ে সবসময় হেলাফেলা হলে সে বিদ্রোহী হয়। সে কারণে বড়দের সঙ্গে সব ব্যাপারে অসহযোগিতা করার মানসিকতার জন্ম হয় তার। তাদের প্রাইভেসি ও স্বাধীনতা পাওয়ার ইচ্ছেকে শ্রদ্ধা করতে শিখুন। সে সব বিষয়ে গুরুত্ব দিন। প্রাইভেসি ক্ষতিকর না হলে তাতে ইন্টারফেয়ার করবেন না। তাকে বুঝতে দেবেন তার প্রাইভেসির ব্যাপারটা আপনি জানেন। বোঝেন।
শিশু চাপিয়ে দেওয়া পছন্দ করে না
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই একবার বললেই শিশু আপনার পছন্দ এবং অপছন্দ মনে রাখতে পারে। অর্থাৎ তাকে একই জিনিস বারে বারে বলে বিব্রত না করাই ভাল।
শিশু ন্যাগ করা পছন্দ করে না। তার থেকে আপনি কি চাইছেন তা স্পষ্ট করে বলুন। কড়া করে নয়। তাতেই কাজ হবে।
শিশুর কাছে কথা দিয়ে কথা রাখার গুরুত্ব অপরিসীম
শিশু আশা করে যে,আপনি তাকে যে কথা দিচ্ছেন সে কথা রাখবেন। প্রতিশ্রুতি কথাটার অসম্ভব মূল্য তার কাছে। সুতরাং তাকে কোনও কথা দিলে সে কথা রাখার চেষ্টা করবেন নতুবা সেও ভবিষ্যতে কথা দেওয়াকে কথার কথাই ভাববে।
আপনার শিশুও পর্যবেক্ষক
আমাদের প্রায় সব বড়দের ধারণা যে পরিবেশ পরিস্থিতি ও মানুষজনের চালচলন কেবল আমরাই খেয়াল করি। শিশুরা নয়। এ এক মস্ত ভুল ধারণা। তারাও কিন্তু প্রতিনিয়ত বড়দের দেখছে, পর্যবেক্ষণ করছে। মনে মনে ভালমন্দ গুনাগুন বিচার করছে তাদের। ফলশ্রুতি হিসেবে বড়দের, হয় তারা শ্রদ্ধা বা অশ্রদ্ধার আসনে বসাচ্ছে এবং তাঁদের অজান্তেই। শুধু তাই নয়। এর থেকেও মারাত্মক ব্যাপার যেটা তা হলো, বুঝতে শেখার বয়সের আগেও যদি তাদের সামনে অপ্রীতিকর বা সুখদায়ক কিছু ঘটে , সে সব ঘটনার মুহূর্তগুলোর স্মৃতি তারা তাদের মস্তিষ্কের স্মৃতিকোষে জমিয়ে রাখে। তারপর বোঝার বয়সে আবার টাটকা ঘটনা হিসেবে ফিরে ফিরে আসে সে সব ঘটনাপঞ্জি। তার কারণ খোঁজার জন্য শিশু যুক্তি খাটায় এবং দুইয়ে দুইয়ে চার করে। আপনার ত্রুটি আপনার দোষগুণ সব দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে যায় তার কাছে। সুতরাং সাধু সাবধান।
উপসংহার
আপনার শিশু ভবিষ্যতে ততখানিই সমাজ ও পৃথিবীর জন্য সম্পদ হয়ে উঠবে যতখানি আপনি তাকে তা হতে সাহায্য করবেন। অর্থাৎ পুরোটা না হলেও প্রায় সবটা নির্ভর করবে আপনার অভিভাবকত্বের ঔৎকর্ষের উপর। কি ভাবে আপনার শিশুকে প্রতিপালন করবেন, কি ভাবে তাকে ভালমন্দ, সত্যিমিথ্যে ও সততার-অসততার মধ্যে প্রভেদ করতে শেখাবেন সে সব নিয়ে অনেক মোটা মোটা বই আছে। অনেক পন্ডিতের বক্তৃতা আছে। কিন্তু সব থেকে ফলপ্রসূ ও কার্যকরী হলো আপনার সঠিক মূল্যবোধ দিয়ে আপনার মতো করে আপনার শিশুকে শেখানো। কারণ তার জীবনের প্রথম আইডল আপনিই। অন্য কেউ নন।
২৮.০৩.২০২৪