ছোটবেলায় রবিবার দুপুরে শক্তিমান দেখা ছিল দৈনন্দিন জীবনের একটা ধ্রুবক। দুপুর বারোটার সময় উনি আসতেন আমাদের শৈশবের সমসত্ত্ব জগতে পোয়েটিক জাস্টিস নিয়ে। আমরা ভাবতাম জীবনের সত্যিটা বোধ হয় এরকমই। সমস্ত দুষ্টু লোক শুরুতে জয়ের গন্ধ পেলেও শেষ হাসি শক্তিমান এবং তাঁর ছত্রছায়ায় থাকা সৎ মানুষেরাই হাসে। তখন জানতাম না ছোটবেলার এই শিক্ষাটাই একটা স্ক্যাম- সবই আসলে মায়া।
তো সেই শক্তিমানের কিছু কিছু দৃশ্য এখনো মনে পড়ে। তার মধ্যে একটা ছিল, শহর জুড়ে আবার ত্রাস ছড়িয়েছে তমরাজ কিলবিশ। এবার তার লক্ষ্য ছোট ছোট বাচ্চারা। তাদের ভিডিও গেমের মাধ্যমে অন্য একটা জগতে আটক করে নেওয়া হচ্ছে। সেখানে তারা বিপথে চালিত হচ্ছে- এরকম কিছু একটা স্কিম ছিল। সেভাবে এই বাচ্চারাই হয়ে উঠছিল অন্ধকারের যোদ্ধা।
শুধু সিরিয়ালেই নয়। মাঝে ‘ব্লু হোয়েল’ গেম খুব কুখ্যাত হয়েছিল। যুবকদের ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন রকমের কঠিন কাজ করিয়ে অবশেষে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করছিল এই খেলাটা। বিভিন্ন অনলাইন এবং অফলাইন ওয়েব প্ল্যাটফর্ম এরকম বিভিন্ন পদ্ধতিতে মানুষের সাইকোলজির সঙ্গে খেলা করে, তাদের সম্পূর্ণ অন্য রকম মানুষে পরিণত করতে পারে।
এতদূর ভাবার দরকার নেই। যাঁরা নিয়মিত ভাবে বিভিন্ন গেম খেলেন, তাঁরাও জানবেন সেই খেলায় হারজিত কীভাবে তাঁদের মুডের পরিবর্তন করে। আসলে মানুষ যেই জগতেই একবার একাত্ম হয়ে যায়, সেই জগতের সব কিছুই তাকে ভীষণ ভাবে প্রভাবিত করে। একথা জানা, আমার, আপনার, সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের ব্যাপার- মিডিয়ারও।
আর এই মিডিয়াও তৈরি করেছে এমন একটা জগৎ, যেখানে শুধু কচিকাঁচারা নয়, আবালবৃদ্ধবণিতা সকলেই প্রভাবিত হচ্ছেন। ন্যাশনাল মিডিয়ায় এক দলের জয়জয়কার, রাজ্যের মিডিয়ায় এক দলের, আর যাদের কেউ নেই তাদের ভগবান (পড়ুন অনলাইন প্লাটফর্ম) আছেন- যাঁদের অনেককেই আপাতদৃষ্টিতে নিরপেক্ষ মনে হলেও তাঁরা সেটা নন- যত নির্বাচন এগোচ্ছে সেটাই জলের মতো পরিষ্কার হচ্ছে।
এখন এই জয়জয়কার নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা তাঁরা জনমানসে প্রতিনিয়ত যে ভীতির উদ্রেক করে চলেছেন, সেটা নিয়ে। অমুক দল না জিতলে দেশ তথা ধর্মনাশ হবে, তমুক দল না জিতলে গোটা দেশ বিক্রি হয়ে যাবে ইত্যাদি বহু মতামত বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছে। আর সেসব বিষয়বস্তু নিয়ে সারাদিন ব্যাপী আলোচনা সভা, তাতে অভব্য তর্কাতর্কি, বেলেল্লাপনার একশেষ।
সারাদিন এই জগতের সান্নিধ্যে যাঁরা আসছেন, স্বভাবতই তাঁদের মধ্যে অমূলক উদ্বেগের সৃষ্টি হচ্ছে, সঙ্গে আসছে অবসাদ। উদ্বেগ এই কারণে, যে দেশ এবং তাঁর ধর্মাচরণের উপর খাঁড়া নেমে আসতে চলেছে আর অবসাদ এই কারণে, যে ইভিএমে বোতাম টেপা ছাড়া তার এই বিষয়ে বিশেষ কিছু করণীয় নেই। নেতাগণ এবং মিডিয়া নিজের দেশেরই মানুষদের একে অন্যের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিচ্ছেন, পারস্পরিক অবিশ্বাসের বাতাবরণ সৃষ্টি করছেন। দিনের শেষে একটাই উদ্দেশ্য- ক্ষমতা এবং তার আড়ালে অর্থোপার্জন।
কিন্তু এই মানুষগুলোর জীবনে এই উদ্বেগ ও অবসাদের প্রভাব কিন্তু এর চেয়ে অনেক সুদূরপ্রসারী। এই কথাগুলো সে সারাদিন ধরে ভাবছে, কর্মক্ষেত্রে, যাতায়াতের পথে, বাসে-ট্রামে সব সময় আলোচনা করছে। যে আলোচনা করতে চায়না, তার সাথেও আলোচনা করছে। ভাবছে সে যদি এই কঠিন পরিস্থিতি থেকে উদ্ধারের কোনো পথ বের করতে পারে… এইভাবে সে ধীরে ধীরে মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছে- ক্লিনিকালি বা সব-ক্লিনিকালি। নিজেদের স্বার্থরক্ষার্থে দেশের নেতা এবং মিডিয়া প্রতিনিয়ত যে বিদ্বেষের বীজ রোপন করছেন, এর শাস্তি কী হওয়া উচিত আমি তা জানিনা।
এসকল উদ্বিগ্ন মানুষদের একটা কথাই বলবো, এই জগৎ একটা কুকুরের লেজ বই কিছু নয়। অযথা এই লেজ সোজা করার প্রচেষ্টা না করে, নিজের নিজের জীবনটাকে কীভাবে একটু সুন্দর করে তোলা যায় সেটা ভাবুন। নিজের পরিবার, নিজের প্রতিবেশীদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকুন। তাহলে জগৎটা এতোটাও ভয়ঙ্কর মনে হবেনা। এই নেতাদের কথায় প্রভাবিত হবেন না। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে একথা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত এরা প্রত্যেকে ক্ষমতার অপব্যবহার করতে দ্বিতীয়বার ভাবে না। আজ যারা ক্ষমতায় আছে, তারা যেমন চোর- যারা আজ বিরোধী, তারাও যখন ক্ষমতায় ছিল, তারাও ছিল চোর। নেতা এবং চোর আজ সমার্থক শব্দ। এরা যেই ক্ষমতায় আসুক, আপনার জীবনে তার বিশেষ কিছু পরিবর্তন আসবে না। এই চোরেদের কথায় নিজেদের মানবিক শান্তি বিপর্যস্ত হতে দেবেন না