আমি অনেকদিন খবরের কাগজ পড়ি না। টিভিও দেখি না। সারাদিন মানুষ দেখি।
এই মুহূর্তে করোনা মহামারীর বিশ্বে ঠিক কি অবস্থা, বলতে পারবো না। করোনা ভ্যাকসিন কবে বাজারে আসবে তা নিয়েও মতামত দিতে পারব না। কিন্তু এটা নিশ্চিত করে বলতে পারি এই মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমরা জিততে চলেছি।
তাহলে কি করোনার প্রকোপ কমেছে?
তা একদমই নয়। বরঞ্চ কেস অনেক বেড়েছে। রোজই আমার রোগীদের মধ্যে দশ-বারোজনের করোনা ধরা পড়ছে। দু-তিন দিন আগে একদিনে বাইশ জন রোগীর করোনা ধরা পড়ল। তার মধ্যে এক বাড়িতেই আট জনের।
তবু করোনা যত ছড়াচ্ছে, মানুষের সাহস কমার বদলে বাড়ছে। মিডিয়ার দৌলতে এতদিন লোকে করোনাকে বাঘ-সিংহ ভাবছিল। সামনা সামনি হলে নিশ্চিত মৃত্যু। সামনা সামনি হওয়ার পর দেখা গেল করোনার দাঁত নখে তেমন ধার নেই। প্রায় সকলেই বাড়িতে সুস্থ হয়ে উঠছেন। বিশেষ কোনো চিকিৎসাও লাগছে না।
ফলে শ্রমজীবী মানুষেরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাইছেন। না ফিরে উপায়ও নেই। অধিকাংশ মানুষেরই দীর্ঘদিন ঘরে বসে থাকার মতো সঞ্চিত অর্থ নেই।
অনেকদিন বাদে চন্দ্রা আবার এসেছিল। ওর বর টোটো করে নিয়ে এসেছে। বর বলল, ‘করোনার ভয়ে ওকে আর মাঝের সময়ে বের করি নি। কিন্তু শ্বাস কষ্টটা বেশ বেড়েছে। তাই আনতেই হল।’
চন্দ্রা আমার অনেক পুরনো রোগী। পাঁচ বছর আগে গর্ভাবস্থায় ওর শ্বাস কষ্টের খুব বাড়াবাড়ি হয়েছিল। তখন থেকেই আমাকে দেখায়।
চন্দ্রার দু’পা কোমরের নীচ থেকে অসাড়। বছর তিনেক আগে অটো উল্টে গিয়ে হয়েছে। চন্দ্রার স্বামী ওকে নিয়ে অনেক ছোটাছুটি করেছে। সাধ্যের বাইরে গিয়ে চিকিৎসা করতে চেয়েছে। একটি কেবল কোম্পানিতে সামান্য ইলেকট্রিশিয়ানের কাজ করা ছেলেটি পঙ্গু স্ত্রীকে নিয়ে ভেলোর পর্যন্ত দৌড়েছে। ধারদেনা করে অপরেশন করিয়েছে। লাভ কিছু হয়নি।
ওদের একটি ছোট্ট মেয়ে আছে। আগে যতবারই এসেছে সঙ্গে নিয়ে এসেছে। এবার করোনার ভয়ে সম্ভবত আনতে সাহস পায়নি। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘মেয়ে কেমন আছে?’
চন্দ্রা হাসিমুখে জানালো, ‘ভালো আছে ডাক্তারবাবু। কিন্তু বড় দুরন্ত হয়েছে। সারাক্ষণ ছুটে বেড়ায়।’ তারপর সামান্য চুপ থেকে বলল, ‘আমি তো ওর পেছনে ছুটতে পারি না। ওর বাবা’ই যেটুকু সময় পায় ছোটে।’
চন্দ্রার বুকের মধ্যে সাঁই সাঁই শব্দ হচ্ছে। বললাম, ‘তুমি কিন্তু বড্ড মোটা হয়ে যাচ্ছ।’
ও হাসতে হাসতে হাসতে বলল, ‘সারাক্ষণ বসে বসে খাই। হুইলচেয়ারে ঘরের মধ্যে কত আর ঘুরবো? দিন না ডাক্তারবাবু রোগা হওয়ার একটা ওষুধ।’
বললাম, ‘রোগা হওয়ার আবার ওষুধ হয় নাকি?’
‘এত কঠিন কঠিন অসুখের ওষুধ হয়, আর রোগা হওয়ার ওষুধ নেই! নতুন ব্লাউজগুলো পর্যন্ত পরতে পারছি না। ছোট হয়ে যাচ্ছে। পুজোর সময় কি করব তাহলে? সাজবো কি করে?’
ওর বর গভীর ভাবে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘চিন্তা নেই। আমি আবার নতুন বানিয়ে দেব।’
আমার চমৎকার লাগছিলো। মহামারির শেষ কবে হবে বলা মুশকিল। মহামারী শেষে কে থাকবে কে থাকবে না তাও বলা মুশকিল।
তবু মহামারীর মধ্যে আমরা বেঁচে রয়েছি। যাবতীয় মানবিক আবেগ নিয়েই বেঁচে রয়েছি। এই বেঁচে থাকার মুহূর্তগুলোই আমার মহামারীর স্মৃতি হয়ে রয়ে যাবে।