শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ
ইদানীং বেশ খারাপ খারাপ জ্বরের রোগী আসছে। রোজই বেশ কয়েকজনকে হাসপাতালে ভর্তির জন্য বলতে হচ্ছে।
একজন রোগিণী খুপরিতে ঢুকেই মাথা টাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিল। পেছনের বয়স্ক মহিলা তাঁকে প্রায় জড়িয়ে ধরে সামলালেন। তারপর চিরাচরিত উৎকণ্ঠা গলায় ঢেলে বললেন, ‘ডাক্তারবাবু, শিগগিরি দেখুন। মেয়েটা আমার জ্বরে মরতে বসেছে।’
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, ‘যেভাবে আপনি জ্বরের রোগীর সাথে জড়াজড়ি করছেন, তাতে আপনিও মরবেন।’
বয়স্ক মহিলা বললেন, ‘আমার যা হওয়ার হবে, আমার মেয়ে সুস্থ হয়ে যাক।’
এই ধরণের বক্তব্য আকচার শুনছি। যুবক ছেলের জ্বর আসার পর বয়স্ক বাবা-মা রাত জেগে ক্রমাগত জলপটি দিয়ে গেছেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছেন। ছেলেটি দুদিনেই সামলে উঠেছে। কিন্তু বাবা মায়ের প্রায় যায় যায় অবস্থা। দুজনেই আপাতত কোভিড হাসপাতালে ভর্তি আছেন। করোনা যে বাড়িতে ঢুকছে, সে বাড়ির প্রায় প্রত্যেকেই আক্রান্ত হচ্ছে। এর জন্য বাঙালি পরিবার গুলির সদস্যদের মধ্যে স্নেহ- ভালবাসা অনেকটাই দায়ী।
বয়স্ক মহিলা মেয়েটির মাস্ক টেনে খুলতে যাচ্ছিলেন। আমি হই হই করে উঠলাম, ‘করেন কী, করেন কী?’
ভদ্রমহিলা বললেন, ‘মাস্কের জন্য ওর দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। নিঃশ্বাস নিতে পারছে না।’
জোরদার ধমক দিতে বাধ্য হলাম। বললাম, ‘মাস্কের জন্য কারও নিঃশ্বাস আটকায় না। অতো আতুপুতু করলে আমি রোগী দেখতে পারব না।’
ভদ্রমহিলা আমার দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকালেন। সম্ভবত তিনি আমাকে মায়া-দয়াহীন কসাইএর সমগোত্রীয় বলে ভাবছেন। আমি পালস অক্সিমিটার মেয়েটির আঙুলে লাগালাম। ৯৮%। মাস্কের আড়ালে হেসে বললাম, ‘আপনার মেয়ের মোটেই নিঃশ্বাস আটকাচ্ছে না। এই দেখুন শরীরে অক্সিজেন ভালোই আছে।’
এবার রোগিণীকে পরীক্ষায় মন দিলাম। প্রেশার বেশ কম। চোখের নীচের পাতা টেনে দেখলাম, বেশ ফ্যাকাশে। বললাম, ‘কতোদিন ধরে জ্বর?’
নিস্তেজ গলায় মেয়েটি উত্তর দিল, ‘সাতদিন।’
‘ওষুধ কী খেয়েছেন? করোনা পরীক্ষা হয়েছে?’
মেয়েটি ঘাড় নাড়ল। বলল, ‘পরীক্ষা হয়নি। ওষুধ? ঐ জ্বর এলে প্যারাসিটামল খেয়েছি।’
আমি রেগে মেগে বয়স্ক মহিলাকে বললাম, ‘এতোদিন মেয়েকে বাড়িতে ফেলে রেখেছেন, আর ডাক্তারখানায় এনে দরদ দেখাচ্ছেন!’
ভদ্রমহিলা বললেন,’ ‘আমার কাছে থাকলে তো ডাক্তার দেখাবো। আজই শ্বশুরবাড়ি থেকে এসেছে।’
‘শ্বশুরবাড়িতেও তো ডাক্তার দেখাতে পারতো?’
‘তাহলেই হয়েছে। ওর শাশুড়ি যা জিনিস।’
আমি বললাম, ‘ওর শাশুড়িকেও জিজ্ঞাসা করলে উনিও বউমা সম্পর্কে একই উক্তি করবেন।’
‘আপনি জানেন না ডাক্তারবাবু। ওর স্বামীর জ্বর এসেছিল। কেউ ধারে কাছে ঘেঁষেনি। শাশুড়ি মেয়েটাকে স্বামীর ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বলেছে তোমার স্বামী, তুমিই সেবা যত্ন করবে। জামাই যখনই একটু সুস্থ হয়েছে আর আমার মেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে, তখন পত্রপাঠ মেয়েকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে।’ বয়স্ক মহিলা এবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে আরম্ভ করলেন।
আমি বুঝলাম এ সমস্যার সমাধান করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। অতএব মেয়েটিকে ওষুধপত্র লিখে বললাম, ‘কালকেই গ্রামীণ হাসপাতালে গিয়ে টেস্ট করুন। আর আপনার যদি জ্বর আসে আপনিও এই ওষুধ শুরু করে দেবেন।’
‘গ্রামীণ হাসপাতালে আজ গেছিলাম। কী ভিড়! অনেকক্ষণ লাইনে দাঁড়ানোর পর বলল আজ আর পরীক্ষা হবে না। যে কটা পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল হয়ে গেছে। ওখানে ভোর থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে ঠেলাঠেলি করে মেয়ের পক্ষে পরীক্ষা করা সম্ভব না। তাতে মেয়ে আরো অসুস্থ হয়ে পড়বে।’
বললাম, ‘তাহলে প্রাইভেটে করুন।’
‘সেতো অনেক খরচ। অতো টাকা কোথায় পাব? আপনিই ওর একটা টেস্ট করে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেন না। আপনাদের তো অনেকের সাথে চেনাজানা থাকে।’
এবার চেম্বার ছেড়েছুড়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। সবাই পেয়েছেটা কী? সকাল থেকে লোকজন বলছে ‘কোথাও বেড পাচ্ছি না। একটা বেডের ব্যবস্থা করে দিন না।’ ‘তিনদিন ঘুরে ঘুরে ভ্যাক্সিন পাচ্ছি না। একটা ভ্যাক্সিনের ব্যবস্থা করে দিন না।’ ‘অক্সিজেন সিলিন্ডার পাচ্ছি না। কম খরচে একটা অক্সিজেন সিলিন্ডারের ব্যবস্থা করে দিন না।’ আমি যে একজন পাতি খুপরিজীবি ডাক্তার, রোগী দেখে ওষুধ লেখা ছাড়া আর কোনো ক্ষমতাই নেই কেউ বিশ্বাস করতে চাইছে না।
বয়স্ক মহিলা এবং মেয়েটিকে বিদায় করলাম। মেজাজটা একদম তিতকুটে হয়ে গেছে। পরের রোগী কাশতে কাশতে ঢুকলেন। এনারো চারদিন ধরে জ্বর।
বুকে স্টেথো বসিয়েই আবিষ্কার করলাম ওনার বুক পকেটে একবান্ডিল বিড়ি। উনি কিছু বোঝার আগেই বিড়ির বান্ডিলটা খপ করে বের করে বললাম, ‘ছি ছি, চারদিন জ্বর, এমন কাশছেন, স্যাচুরেশন ৯২%, আর আপনি বিড়ি খাচ্ছেন?’
ভদ্রলোক কাঁচুমাচু মুখ করে বললেন, ‘বিশ্বাস করুন ডাক্তারবাবু, বিড়ি একদম কমিয়ে দিয়েছি। ওই না খেলে পায়খানা হয় না, তাই বাধ্য হয়ে খাই।’
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, ‘কমাবেন কেন? বিষ যখন খাবেনই ঠিক করেছেন, একবারে বেশি করে খান। ঝামেলা চুকে যাক। তিলে তিলে মরার কোনো মানে হয়না।’