বাংলায় ভোটের খেলা চলছে। সকলে তাই নিয়েই ব্যতিব্যস্ত। তবে আমার মতোও কয়েকজন রয়েছে যাদের ভোট নিয়ে আগ্রহ নেই।
খবরের কাগজ পড়া হয় না অনেকদিন, টিভি দেখা হয় না তার চেয়েও বেশি দিন। ফলে নানা গুরুত্বপূর্ণ খবর অজানা থেকে যায়। যেমন আমাকে জিজ্ঞেস করলে বলতে পারবো না কোন অভিনেতা এবার কোন দল থেকে কোথায় দাঁড়িয়েছেন।
তবে আমি একেবারেই অসামাজিক নই। সকাল থেকে রাত অবধি মানুষের সাথেই কারবার। তাদের জ্বালা যন্ত্রণার গল্প শুনি। তাদের কাছে নানা খবরা-খবর পাই। সেসব খবর কোনো সংবাদপত্রে ছাপলে পাবলিক খাবে না।
ঘামতে ঘামতে দাস মেডিকেলের খুপরিতে রোগী দেখছিলাম। এই খুপরিতে বেজায় গরম। চারদিক আটকানো। শুধু একটা ঘড়ঘড়ে দেওয়াল পাখা চলে। সেটা আবার ঘুরে ঘুরে হাওয়া দেয়। কিছুতেই স্থির করা যায়না। ঘুরতে ঘুরতে যেটুকু দমকা হাওয়া গায়ে এসে লাগে, সেটুকুই শান্তি।
আশ্চর্যের বিষয় হলো খুপরির দেওয়ালে একটি এসি বিরাজ করছে। তবে এসিটা চলেনা।
স্টেথো দিয়ে এসিটা ঠুকে ঠুকে দেখেছি। কেমন ফাঁপা আওয়াজ। সম্ভবত ভেতরে যন্ত্রপাতি নেই। খোলসটা টানিয়ে খুপরিটাকে থ্রি স্টার চেম্বার বলে চালানোর চেষ্টা হয়েছে।
মন মেজাজ খিঁচড়ে রয়েছে। খুপরিতে ঢুকতে দেরি হয়েছে।
আমি ঠিক সময়ে খুপরিতে ঢোকা ডাক্তার। আজও সময়ের মিনিট পাঁচেক আগেই ঢুকে যেতাম। কিন্তু রাস্তা জুড়ে এক রাজনৈতিক দলের বিশাল মিছিল বেড়িয়েছে। ব্যাণ্ড পার্টি, ছৌ নাচ, ঘোড়ার গাড়ি, রণ পায়ে চড়া লোক- কী নেই সেখানে। একেবারে হই হই কাণ্ড, রই রই ব্যাপার। সবই আছে, শুধু কারো মুখে মাস্ক নেই।
গতকালও আমার চারজন রোগীর করোনা ধরা পড়েছে। তার মধ্যে একজনের অবস্থা সুবিধার নয়। কালকে রাতেই তাকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাওতো অধিকাংশ জ্বরের রোগী পরীক্ষা করাচ্ছে না। সবাই পরীক্ষা করালে কেস অনেক বাড়তো।
দরজা ঠেলে একটি সাতেরো- আঠেরো বছরের ছেলেকে নিয়ে তার মা ঢুকলেন। ছেলেটিকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে গতকাল দোলের দিন সে চুটিয়ে রঙ খেলেছে।
জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হয়েছে?’
ছেলেটির মা বললেন, ‘ডাক্তারবাবু, মনে হচ্ছে জণ্ডিস হয়েছে।’
‘কী দেখে মনে হচ্ছে?’
‘কাল সারা রাত ও বমি করেছে। জল খেলেও ওয়াক ওয়াক করছে। চোখ দুটোও কেমন হলুদ হলুদ দেখাচ্ছে।’
‘কী রে, এখন আর বমি পাচ্ছে?’
ছেলেটি জবাব দিল, ‘না স্যার। এখন ঠিক আছি। কোনো অসুবিধা নেই।’
বললাম, ‘কী আজব জণ্ডিস। সারাদিন আপনার ছেলে চুটিয়ে রঙ খেলল। রাত্রে জণ্ডিস হল। আবার সকাল হতেই ঠিক হয়ে গেল!’
‘ডাক্তারবাবু, আপনি ওকে একটু ভালো করে দেখুন। রাত্রে ও কেমন যেন করছিল। বারবার বলছিল, মা কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমি এখুনি মরে যাব। অতবড় ছেলে ভেউ ভেউ করে কাঁদছিল।’ বলতে বলতে ওর মা কাঁদতে আরম্ভ করলেন। ‘একমাত্র ছেলে ডাক্তারবাবু, আপনি পরীক্ষা নিরীক্ষা লিখে দিন। আলট্রাসাউন্ড, লিভারের পরীক্ষা- সবকিছু।’
আমি ছেলেটির চোখে চোখ রেখে বললাম, ‘কী খেয়েছিলি? সিদ্ধি?’
ভদ্রমহিলা হাউমাউ করে উঠলেন, ‘না না ডাক্তারবাবু, ও তেমন ছেলেই নয়। ও কোনো নেশা করে না।’
জোড়দার ধমক দিতে বাধ্য হলাম, ‘চুপ, একদম চুপ। প্রশ্নটা আমি আপনাকে করিনি। কী খেয়েছিলিস বল।’
ছেলেটি মাথা নীচু করে বলল, ‘সিদ্ধি খেয়েছিলাম। বন্ধুরা জোর করে… ‘
মুহূর্তের মধ্যে ভদ্রমহিলা মমতাময়ী মা থেকে ঝগড়ুটে পিসি হয়ে গেলেন। তিনি ছেলেটির হাত ধরে টেনে তুললেন, ‘হতচ্ছাড়া, তোর জন্য আমি এত করছি, আর তুই নেশা করে বেড়াচ্ছিস। বাড়ি চল…’
ভদ্রমহিলার রুদ্র মূর্তি দেখে হকচকিয়ে গেলাম। মিনমিন করে বলতে গেলাম, ‘ইয়ে আমার ভিজিট টা…’
উনি শুনতে পেলেন বলে মনে হল না। যাক গে, একজনের ভিজিট না পেলেও আমার দিব্যি চলে যাবে।
পরপর রোগী দেখছি। বেশ ছন্দ এসে গেছে। বিড়ি খেয়ে হাঁপানির রোগী দেখলাম। মদ খেয়ে প্যানক্রিয়াটাইটিসের রোগী দেখলাম। সব সিলেবাসের মধ্যে। রোগীরা ঢুকছে আর বেরোচ্ছে।
ছন্দ কাটল একটি কম বয়সী মেয়ে। একটি বয়স্ক মানুষকে ধরে ধরে সাবধানে খুপরিতে ঢুকছে।
বললাম, ‘একটু তাড়াতাড়ি।’
‘দুঃখিত ডাক্তারবাবু একটু সময় লাগছে। বাবা একেবারেই দেখতে পায়না তো।’
যত্ন করে মেয়েটি বয়স্ক ভদ্রলোককে টুলে বসিয়ে দিল। বলল, ‘ডাক্তারবাবু, দেখুন না, বাবার বড্ড ঠাণ্ডা লেগে গেছে। এমনিতেই টানের দোষ আছে।’
বুকে স্টেথো বসালাম। দিব্যি সপ্তসুর শোনা যাচ্ছে। বললাম, ‘ভালোই ঠাণ্ডা লাগিয়েছেন। তা লাগালেন কী করে?’
ভদ্রলোক লাজুক মুখ করে বললেন, ‘আজ্ঞে ডাক্তারবাবু, দার্জিলিং গেছিলাম। বড্ড ঠাণ্ডা, অভ্যাস নাই তো।’
অবাক হয়ে বললাম, ‘দার্জিলিং? বেড়াতে গেছিলেন? আপনি তো চোখেই দেখেন না!!’
ভদ্রলোক হাতড়ে হাতড়ে মেয়েটির কব্জি চেপে ধরলেন। বললেন, ‘এই যে, এ মেয়ের জেদ। কতবার বারণ করেছি, শুনলো না।’
মেয়েটির চোখে অভিমান, ‘তুমি আমাকে বলোনি, তোমার পাহাড় দেখার ইচ্ছে? আমি চাকরি পেলে আমার সাথে পাহাড়ে যাবে বলোনি?’.
‘তখন তো চোখে দেখতাম। আর এখন…’
‘আর এখন কী? তুমি এখনো যথেষ্ট সুস্থ। দাঁড়াও এবার তোমার চোখটা ভালো করে দেখাতে হবে। ডাক্তারবাবু, রেটিনার সমস্যার জন্য কোথায় দেখালে ভালো হয়?’
বাবা আর মেয়ে ছাড়া ওদের বাড়িতে কে আছে জানি না। মেয়েটি কী চাকরি পেয়েছে তাও জানি না। তবে ওদের ভালোবাসার উত্তাপ দিব্যি টের পাচ্ছিলাম।
ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তা দার্জিলিং কেমন লাগলো?’
উনি হাসলেন, ‘খুব ভালো লেগেছে। কী ঠাণ্ডা হাওয়া। উঁচু নীচু রাস্তা। আর ও এতো বকবক করছিল। যা দেখছিল আমাকে শোনাচ্ছিল।’
ভদ্রলোক আরও কীসব বলে যাচ্ছিলেন। সন্তানের চোখ দিয়ে প্রথমবার পাহাড় দেখার আনন্দে উনি এখনো মশগুল হয়ে আছেন।