আউটডোরে বসলে সারাক্ষণ চেঁচামেচি আর বকবক করে যাওয়া আমার স্বভাব। অবশ্য একেকদিন এত ভিড় হয় যে মুখ তুলে দেখারই সময় থাকে না। তাছাড়া প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য-উপদেশ না দিয়ে শুধু খসখসিয়ে দুটো ওষুধ লিখে দেওয়া আমার ধাতে নেই। দোল-হোলি মিলিয়ে আউটডোরে ভিড় একটু কম। আমি মনের সুখে বকবক করে যাচ্ছি-
– ওষুধ বন্ধ কেন? পরিষ্কার লেখা আছে নভেম্বরের শেষে দেখিয়ে যেতে। এতদিন কোথায় ছিলে?
– (চুপ)
– শোনো, এভাবে নিজের খেয়ালখুশি মতো চিকিৎসা করিয়ে লাভ নেই। কতবার বলে দেওয়া হয়েছে নিজের ইচ্ছে মতো ওষুধ বন্ধ করবে না…
– (চুপ)
– নির্বাক পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলে যে? হঠাৎ এতদিন বাদে হসপিটালের কথা মনে পড়েছে সেও ভালো। তা এসে এরকম চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলে কী করে চলবে?
– চোখের সামনি অত বোড়ো ছ্যালাটাকে মরতে দেখলি কার মাথার ঠিক থাকে বলঅ ত?
– মানে?
– এমনু এমনু কি আর আসিনি? কেউ কি বাচ্চার ক্ষতি চায়? বোড়ো ছ্যালাটার হার্টের রোগ ছিল। করনার জন্যি ভালঅ কর্যি ডাক্তার দেখাইতে পারিনি। বাচ্চাটাকে বাঁচাইতে পারলি নি। অর বাপের হাতে কাজ ছিল নি। পয়সাকড়ি জুগাড় করি তবে ত আসব বলঅ?
নিস্তব্ধতা জায়গা বদলে টেবিলের এপারে এসে জাঁকিয়ে বসে। যদিও তা সাময়িক। সামলে নিই। প্রফেশনাল ‘আমি’টাকে টেনে নিয়ে হাতড়ে বেড়াই যন্ত্রণার দুনিয়ায়। অন্য কোথাও। বকবক থামে না-
– কবে থেকে পাতলা পায়খানা?
– তা পেরায় মাস দুয়েক হবে। পথমে সুদু জল জল হাগত। এখন পাইখানায় রক্তও আছে।
– বুকের দুধ খায় তো?
– না। ডিবার দুদ খায়।
– কেন? সাড়ে চার মাসের বাচ্চাকে কৌটোর দুধ দিচ্ছো কেন? বলে দাও, দুধ হয় না? তারপর পাড়ার ওষুধ দোকানির পরামর্শে কৌটোর দুধ দিচ্ছি…
চেনাজানা প্রশ্নপত্র পেলে লোকে যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে লিখতে শুরু করে সেভাবেই শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছি।
– অর মা নাই। আমি মাসি।
– মা আসেনি কেন?
– মা মরে গ্যাছে।
মুখ দিয়ে অজান্তে ‘স্যরি’ বেরিয়ে এলো।
– কেন? মানে কীভাবে?
– জামাই বাইরে খাটাখাটনির কাজ করত। লকডাউনের পর থ্যেকানু ঘরে। যেটুকু রোজগার হ’ত সেটাও গ্যাছে। দশ দিনের জ্বরে ভুগ্যা মোর দিদিটা… হয়ত বোড়ো জায়গায় দেখাইতে পারলে…
***
এগুলো কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সাময়িক স্বস্তির পর পুরোদমে করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গ এসে পড়েছে। মারীর কুপ্রভাব ঘিরে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য-সচেতনতা দূরে থাক, এক নতুন শ্রেণীর আবির্ভাব হয়েছে যাঁরা বেশ জোর গলায় বলতে শুরু করেছেন ওসব মাস্ক-ফাস্ক পরে কাজ নেই। সব মিডিয়ার চক্রান্ত। অনেকেই বক্তব্যের সমর্থনে অদ্ভুত সব যুক্তি আর আর্টিকেল খুঁজে খুঁজে বের করছেন। বলাই বাহুল্য, তাঁরা সবাই সমাজের তথাকথিত শিক্ষিত মানুষ। বেশ বুক ফুলিয়ে বলছেন, মাস্ক না পরেও তো দিব্যি আছি। কিংবা, এত করে কী হ’ল? সেই যদি কোভিড হবে তাহলে এতদিন মাস্ক পরে কী লাভ হ’ল?
কয়েকটা কথা বলবোঃ
১.
মারণ ভাইরাস আজ অব্দি ২৮ লক্ষ মানুষের প্রাণ নিয়েছে। আগুন নিজের বাড়িতে না লেগে পাশের বাড়িতে লাগলে সেটাকে আতসবাজি ভেবে ফেলবেন কিনা সে সিদ্ধান্ত আপনার।
২.
‘আমি হেলমেট না পরেই বাইক চালাই অথচ আমার আজ অব্দি অ্যাক্সিডেন্ট হয়নি’ কিংবা ‘আমি চেইন স্মোকার অথচ আমার ক্যান্সার হয়নি’ এসব যুক্তিতে হেলমেট না পরা কিংবা সিগারেট খাওয়াকে প্রশ্রয় দেবেন কিনা সে সিদ্ধান্তও আপনার।
৩.
প্রথম ধাক্কাটা অনেক কষ্টে সামলে ওঠা গেছে। যদিও তখন রোগ সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানা ছিল না। এখন অনেককিছু জানার পরেও দ্বিতীয় তরঙ্গের ভ্রুকুটির মূল কারণ স্রেফ আর স্রেফ কিছু মানুষের অবিমৃষ্যকারিতা। আসলে কেউ কেউ শ্রোতা হ’তে বড্ড হীনমন্যতায় ভোগেন। সবসময় কিছু বলতে না পারলে বোধহয় মানসম্মান যায়। দুঃখের বিষয়, সত্যিকারের প্রয়োজনে এই মানুষগুলিকে কখনোই পাওয়া যায় না। দোহাই, আর কিছু না করুন অন্তত নিজেদের মুখগুলো বন্ধ রাখুন। তাহলে সামনের সারিতে থেকে যাঁরা লড়াই করছেন তাঁদের কাজগুলো খানিক সহজ হয়।
সবার জন্য একটাই মেসেজ- মাস্ক পরুন। কোনও স্বঘোষিত বিজ্ঞানীর কথায় কান না দিয়ে মাস্ক পরুন। মারীর রক্ততৃষ্ণা মেটেনি। তার সামনে সহজ শিকার হয়ে দাঁড়ানোর মধ্যে বীরত্ব নেই, বোকামি আছে। মারীর দেশের দ্বিতীয় তরঙ্গের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে বোকামির বিলাসিতাও নেই।