প্রথম ঢেউয়ের সময়ে করোনার কেস বেড়েছিল ধীরেসুস্থে। এবারে ঝড়ের গতিতে বাড়ছে। মানিয়ে গুছিয়ে নিতে সমস্যা হচ্ছে।
আজ প্রায় অর্ধেকের বেশি রোগীই জ্বরের। কয়েকদিন আগেও বেশ সুগারের, প্রেশারের, হাঁটু ব্যথার রোগী দেখে দিন কাটাচ্ছিলাম। জ্বরের রোগী সংখ্যায় ছিল নগণ্য। দিন পনেরোর মধ্যেই পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। জ্বরের রোগীর চাপে অন্যসব রোগী পিছু হটছে। জ্বরের সাথে কাশি, গলা ব্যথা, পেট খারাপ। বেশ কয়েকজনের আবার ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ হয়ে গেছে।
এক-একটি বাড়ি থেকে পাঁচজন-সাতজন দেখাতে চলে আসছেন। প্রত্যেকেরই জ্বর আসছে। জ্বরের কারণ কী বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না। যেটা অসুবিধা হচ্ছে সেটা হল জ্বরের রোগীরা অনেকেই আগের থেকে নাম লেখাচ্ছেন না। ফলে সঞ্জয়দার সাথে ঝামেলা লাগছে।
রোগীর ভিড়ে হাঁসফাস করছি। সকলেরই প্রায় একই সমস্যা থাকায় একটি বাড়ির সব সদস্যদের জন্য একটাই প্রেসক্রিপশন করে বলছি সবাই মিলে এক ওষুধ খেতে। গ্রামীণ হাসপাতালে গিয়ে সকলকে করোনা পরীক্ষা করতে বলছি। বেশিরভাগেরই রিপোর্ট পজিটিভ আসছে।
দূর্ভাগ্যজনক ভাবে জ্বরের রোগীরা অনেকেই আসছেন মাস্ক না পরে। তাঁদের মাস্ক পরে আসতে বললে অনেকে অসন্তুষ্ট হচ্ছেন। দু-একজন গোঁয়ারের মতন তর্ক করছেন।
আমি ভ্যাকসিনের দুটো ডোজ পেলেও আমার এসিস্ট্যান্ট দুজন, সঞ্জয়দা ও গৌড়ের ভাগ্যে ভ্যাকসিন জোটেনি। ৪৫ বছরের নীচে ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু না হলে ওদের পাওয়ার আশাও নেই। অথচ দুজনেই প্রচুর করোনা রোগীর সংস্পর্শে আসছে। আমি অপরাধ বোধে ভুগছি।
সকলে মাস্ক ব্যবহার করলে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের ছড়িয়ে পরা অনেকটাই শ্লথ করা যেতো। কিন্তু সাধারণ মানুষ মাস্ক না পরে করোনাকে আটকানোর জন্য অন্যান্য অনেক কিছু করছেন।
এক মহিলা চেম্বারে ঢুকে চেয়ার টেবিলে স্যানিটাইজার ছড়িয়ে নিলেন। অথচ তাঁর মাস্ক থুতনির নীচে।
তাঁকে বললাম, ‘এভাবে আপনি করোনাকে আটকাতে পারবেন না।’
উনি বললেন- সেটা উনিও জানেন। কিন্তু এভাবে স্যানিটাইজারের ব্যবহার তাঁর অভ্যাস হয়ে গেছে। বাইরে যেখানেই বসেন, স্যানিটাইজার ছড়িয়েই বসেন। না হলে অস্বস্তি হয়। কোথাও গেলে বাড়ি ফিরে এই গরমেও গরম জলে স্নান করেন, জামা- কাপড় সব কাচেন।
এটাই অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজওর্ডার। আমাদের অজান্তেই নানা রকম মানসিক রোগের মহামারী ছড়িয়ে পড়েছে।
এই জটিল সময়ে যাঁদের সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা তাঁরা সকলেই ভোট নিয়ে ব্যস্ত। মাস্ক ছাড়াই জনসভায় নানা রকম গরম গরম ভাষণ দিচ্ছেন। বক্তব্যের কোথাও একবারও করোনা মহামারী নিয়ে জনসাধারণকে সচেতন করার প্রয়াস নেই।
এক বছরের বেশি সময় ধরে স্কুল বন্ধ। কিছু স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে-মেয়েরা অনলাইনে ক্লাস করার সুযোগ পাচ্ছে। তাদের অনেকেই মোবাইলে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। অনেকেই ঘাড়ের ব্যথা, মাথা ব্যথা, চোখের সমস্যায় ভুগছে।
নিম্নবিত্ত পরিবারের ছাত্র-ছাত্রীরা ক্রমশ অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে। তারা যেটুকু শিখেছিল, সেটুকুও ভুলে যাচ্ছে।
তবে তার মধ্যেও দু-একটি অদ্ভুত ব্যাপার ঘটছে। এক পরিচিত স্কুল শিক্ষক রাতে ফোন করলেন, ‘ডাক্তারবাবু, আপনি করোনা পরীক্ষা করতে দিয়েছিলেন। এ যাত্রা বেঁচে গেলাম।’
আমি বললাম, ‘নেগেটিভ এসেছে? এখনই আনন্দ করবেন না। র্যাপিড টেস্টে অনেকেরই নেগেটিভ আসছে। আর টি পি সি আর-এর রিপোর্ট আগে আসুক।’
‘না না ডাক্তারবাবু, আমার র্যাপিড টেস্টেই পজিটিভ এসেছে।’
অবাক হয়ে বললাম, ‘তাহলে বেঁচে গেলেন বলছেন কেন?’
‘ডাক্তারবাবু, ভোটের ডিউটিতে আর যেতে হবে না। করোনার থেকে ভোটের ডিউটিতে লাইফ রিস্ক অনেক বেশি।’