মহামারী বিষয়ে লোকজন এখনও ডিনায়াল পর্যায়ে রয়েছে। করোনা যে নিজের হতে পারে মেনে নিতে পারছে না।
এক ভদ্রলোক চেম্বারে ঢুকে গুছিয়ে বসলেন, ‘ডাক্তারবাবু, একদম প্রথম থেকে বললে আপনার বুঝতে সুবিধা হবে।’
আমার সুবিধার জন্য ওনার চিন্তা দেখে আহ্লাদিত হলাম না। বাইরে ইতিমধ্যেই রোগীরা অপেক্ষা করতে করতে অধৈর্য্য হয়ে গেছে। বললাম, ‘একটু ছোটো করে বলুন।’
‘হ্যাঁ, যা বলছিলাম- একদম ছোটো থেকেই আমার ঠাণ্ডার ধাত। দেড় বছর বয়েসে নিউমোনিয়া হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল। সেই থেকে আমার ইমিউনিটি কমে যায়। প্রতি বছর অন্তত দু-তিনবার সর্দি জ্বর হতো…’
ভদ্রলোকের কথা শুনতে শুনতে ‘এম ডি’ পরীক্ষার সময়ে রোগের ইতিহাস নেওয়ার কথা মনে পড়ছিল। মুশকিল হলো তখন লং কেস পিছু ১ ঘন্টা সময় পেতাম। সকালে কী খান, দিনে কতবার পায়খানা যান, সেখানে গিয়ে কোন গান করেন- সব শুনতাম।
যত বয়স বাড়ছে, যত করোনা বাড়ছে, ধৈর্য্যও কমছে। এনাকে শিগগিরী শৈশব স্মৃতি থেকে বার না করলে যেসব রোগীরা এতক্ষণ পেটে ব্যথা, জ্বর, কোমরে ব্যথা ইত্যাদি নিয়ে অপেক্ষা করছেন, তাঁরা হট্টগোল শুরু করবেন।
অতএব ‘এম ডি’র যাবতীয় শিক্ষা শিকেয় তুলে রোগীকে সরাসরি লিডিং কোশ্চেন করলাম, ‘ছোটো বেলার কথা বাদ দিন। এখন দেখাতে এসেছেন কেন বলুন? জ্বর?’
ভদ্রলোক এতো সহজে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নন। বললেন, ‘একটু না বললে আপনি ঠিকঠাক কেসটা বুঝতে পারবেন না।’
ভগবানকে ধন্যবাদ দিলাম- ভাগ্যিস সব রোগী এনার মতো নন। ভদ্রলোক বলে চলেছেন, ‘ছোটো বেলার ঠাণ্ডার ধাতটা প্রায় কমে গেছিল বুঝলেন। কিন্তু বাইশ বছর বয়সে কলেজের বন্ধুদের সাথে একবার দার্জিলিং গিয়েই সর্বনাশ হল। এতো ঠাণ্ডা আর এতো ঘন কুয়াশা…!! তিনদিন ছিলাম, কিন্তু একবারের জন্যও কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পাইনি।’
‘দার্জিলিঙে অমন মাঝে সাজেই হয়। কিন্তু সে গল্প আমাকে শোনাচ্ছেন কেন? আপনার সমস্যাটা বলুন।’
‘সমস্যাটা তো এর পরেই শুরু হলো। দার্জিলিং গিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পেলাম না, কিন্তু আমার ঠাণ্ডার ধাতটা আবার ফিরে এল।’
বললাম, ‘সেই ঠাণ্ডার ধাত সারানোর জন্য নিশ্চয়ই আমার কাছে এদ্দিন বাদে আসেন নি? আজ এসেছেন কেন?’
‘না না, ও ঠাণ্ডার ধাত কমবে না। আগে অনেক ডাক্তার দেখাতাম। কিন্তু ডা. শীতল ঘোষ মুখের উপরই বলে দিলেন এটা কমবে একমাত্র আমার মরার পর। তাই আর ওই নিয়ে ভাবিনে।’
ক্রমশ মাথাটা গরম হচ্ছে। সাত সকাল থেকে একটানা রোগী দেখছি। এখন দুপুর দুটো। বকতে বকতে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। রেগেমেগে বললাম, ‘আপনার কবে থেকে জ্বর পরিষ্কার করে বলুন।’
‘আসলে এসি তে থাকার অভ্যাস নেই তো, শালাকে নিয়ে এপোলোতে গেছিলাম ডাক্তার দেখাতে। ওখানে প্রায় চার ঘণ্টা এসির কনকনে ঠাণ্ডায় ছিলাম। শালার আবার পেটের প্রবলেম। কিছু খেলেই বাথরুমে দৌড়ায়। ওখানকার ডাক্তার বললেন এটাও নাকি সারেনা। এই রোগের নাম ইরিটেবল বাওয়েল সিন্ড্রোম। কোলোনোস্কোপি করতে দিলেন। চিন্তা করুন নিজেই বলছেন রোগ সারবে না, আবার সেই রোগের জন্য ওমন মারাত্মক একটা টেস্ট করতে বলছেন।’
এ কথা শোনার পর মাথা ঠাণ্ডা রাখা মুশকিল। গলা বেশ চড়িয়ে বললাম, ‘আপনি হয় আপনার সমস্যা সরাসরি বলুন অথবা বিদায় হোন। একটিও অপ্রয়োজনীয় কথা বললে আমি আর ভদ্র ব্যবহার করতে পারবো না।’
গলার আওয়াজটা বেশ জোরেই হয়েছিল। সঞ্জয়দা দরজা ঠেলে একবার উঁকি মারল। ভদ্রলোক বললেন তাঁর চারদিন ধরে জ্বর, কাশি এবং বুকে ব্যথা৷ বাড়িতে তাঁর স্ত্রীরও আজ থেকে জ্বর আসছে।
বুকে ভালোই সাঁই সাঁই শব্দ হচ্ছে। ওষুধ পত্র লিখে বললাম, কাল গ্রামীণ হাসপাতালে গিয়ে করোনা পরীক্ষা করতে।
ভদ্রলোক মিন মিন করে বলার চেষ্টা করলেন, ‘আসলে এসি’তে থাকার অভ্যাস নেই তো, মনে হচ্ছে ওখান থেকেই…’
তবে শুধু উনি নন, অধিকাংশ মানুষই মহামারীকে অস্বীকার করতে চাইছে। সবাই এমন ভাবে মাস্ক ছাড়াই ঘোরাঘুরি করছে, যেন আদৌ কোনো মহামারীর অস্তিত্ব নেই।
নেতা নেত্রী, যাদের উপর দেশ চালানোর ভার তাঁরা ক্ষমতা ধরে রাখার লড়াইয়ে ব্যস্ত। তাঁদের কাছে মহামারীর আপাতত কোনো অস্তিত্ব নেই। মহামারী আবার ফিরবে ২মে- এর পর। তখন চটজলদি সমাধান হিসেবে হয়তো লকডাউনের কথা ভাবা হবে।
মহামারীতে মানুষের মৃত্যু নিয়ে আপাতত কারো কোনো আগ্রহ নেই। মানুষের যাবতীয় উৎসাহ রাজনৈতিক সংঘর্ষে মৃত ব্যক্তিদের নিয়ে। কারণ হতভাগ্য মানুষগুলির লাশের এই ভোটের বাজারে ভালো দাম আছে।