বনগাঁ লোকালে ফিজিক্যাল ডিস্ট্যান্সিং
খুপরিতে বসে বসে দিনগত পাপক্ষয় করছিলাম। সকলেই জ্বরের রোগী। সংখ্যাগুরুর চাপে অন্যসব রোগীরা নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে।
বাইরে মাঝেমাঝেই ঝগড়া বাঁধছে। সকলেরই দাবি তার অবস্থা সবচেয়ে সিরিয়াস। কেউ বলছে সে সকালে অজ্ঞান হয়ে গেছিল। সময়মতো মুখে জলের ঝাপটা না দেওয়া হলে খবর ছিল।
কারো আবার দাবি কাল থেকে আটবার পায়খানা হয়েছে। তাকে দাঁড় করিয়ে রাখলে বিচ্ছিরি কাণ্ড ঘটে যেতে পারে।
সঞ্জয়দার গলার আওয়াজ পেলাম, ‘একদম চিৎকার চেঁচামেচি করবেন না। বেশি কথা বলবেন না। এতো কথা বললে ভাইরাস বাতাসে আরও ছড়িয়ে পরবে।’
কেউ তা নিয়ে চিন্তিত বলে মনে হচ্ছে না। অনেকেই মাস্ক পরে আসছে না। কিছু বললেই খ্যাঁক করে উঠছে, ‘এমনিতেই করোনা হলে স্যাচুরেশন কমে যাচ্ছে। হাসপাতালে অক্সিজেনের ঘাটতি। বাতাসের অক্সিজেন টেনে কোনো রকমে স্যাচুরেশন মেনটেন করছি…’
আপাতত আমাদের এখানে প্রশাসন ভোট ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। সেটা ত্যাঁদড় লোকজন ভালোমতোই বুঝেছে। তাই কোভিড রিপোর্ট পজিটিভ হওয়ার পরও নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, বাজার করছে, দক্ষিণেশ্বরে পুজো দিয়ে আসছে।
আমি হাল ছেড়ে দিয়ে রোগী দেখছি। রোগী সামনের চেয়ারে বসার আগেই বলছি, ‘কি… জ্বর তো? কদ্দিন ধরে? কাশি আছে? গলা ব্যথা?’
এটা সময় বাঁচানোর নিজস্ব টেকনিক। রোগীরা অনেকেই বলতে শুরু করলে আর থামতে চায় না। তাছাড়া কার কোল্ড ড্রিংকস খেয়ে ঠাণ্ডা লেগেছে, কার এসিতে থেকে জ্বর এসেছে, কার রৌদ্রে সাইকেল চালিয়ে এসে সাথে সাথেই ঠাণ্ডা জলে স্নান করে জ্বর এসেছে- এসব জেনে করবটা কী? বিশেষত যখন জানি পরীক্ষা করলে সকলেরই কোভিড বেরোবে।
বাড়ির দীর্ঘ চেম্বার শেষ করে মনোরমার চেম্বারে যাওয়ার মধ্যে ঘণ্টাখানেকের একটা বিরতি পাই। সেটুকুতেও শান্তি নেই। ওই সময়টাতে ইদানীং করোনা রোগীদের সাথে কথা বলি। যাদের করোনা ধরা পরে এবং চেম্বারের সময় ফোন করে- সঞ্জয়দা সেই নম্বরগুলো লিখে রাখে।
চা- মুড়ি খেতে খেতে দুই চেম্বারের মাঝের সময়ে সঞ্জয়দার মোবাইল থেকে কল ব্যাক করা হয়।
আজও তাই করছিলাম। একজন জানালেন বাংলা নববর্ষের আগের দিন তিনি গ্রামীণ হাসপাতালে কোভিড পরীক্ষা করেছিলেন। র্যাপিড টেস্টের রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছিলো। তারপর তিনি প্রিসাইডিং অফিসার হিসেবে ভোটের ডিউটি করতে গেছিলেন। আজ সকালে বাড়ি ফিরে মোবাইলের ম্যাসেজ চেক করার সময় দেখেন তাঁর আর টি পি সি আর রিপোর্ট এসেছে এবং সেটা পজিটিভ।
তিনি বললেন, ‘এবার কী হবে?’
বললাম, ‘আপনার শরীর কেমন আছে?’
‘ভালো, তেমন সমস্যা নেই। সামান্য কাশি আছে।’
‘তাহলে আপনি এতো ঘাবড়ে যাচ্ছেন কেন?’
‘ঘাবড়াবো না? আমি করোনা নিয়ে এতো লোকের সাথে মেলামেশা করলাম, কয়েকশো মানুষ আমার সংস্পর্শে এলো…’
সর্বনাশ করেছে। ইনি দেখছি বিবেকের তাড়নায় ভুগছেন। করোনার চাইতেও অনেক জটিল অসুখ।
বললাম, ‘দেখুন, সম্ভবত ভোটের কোনো কাজ করলে করোনা ছড়ায় না। স্কুলে গেলে ছড়াতে পারে, পরীক্ষা থেকে ছড়াতে পারে। তাই সরকার সব স্কুল বন্ধ করে রেখেছে, পরীক্ষা বাতিল করেছে। কিন্তু ভোট তো বাতিল করেনি।’
ভদ্রলোক তবু্ও মানতে চাইছেন না। আমার সময় কম। একজনের পিছনে পরে থাকলে চলবে না।
পরপর বেশ কয়েকজনকে ফোন করলাম। তারা বাড়িতে কেমন ভাবে থাকবেন, কিভাবে অন্যদের সাথে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখবেন সেসব নিয়ে বললাম।
এটাই আপাতত শেষ ফোন। প্রায় ছটা বাজে। মনোরমায় পৌঁছাতে দেরি হয়ে যাবে।
ওপাশের ভদ্রলোক ফোন ধরলেন, ‘হ্যাঁ, হ্যালো… আমি বনগাঁ লোকালে ফিরছি। বেজায় ভিড়। একটু বাদে ফোন করুন।’
বনগাঁ লোকাল! আমি চমকিত হলাম। বললাম, ‘আমি ডাক্তারবাবু বলছি। আপনার না করোনা ধরা পড়েছে, আপনি বনগাঁ লোকালে উঠেছেন কেন?’
ভদ্রলোক বললেন, ‘তা কী করবো? অফিস থেকে হেঁটে হেঁটে ফিরব? অফিস করার সময় মেসেজ পেলাম রিপোর্ট পজিটিভ।’
আমি ভ্যাবাচাকা খেয়ে বললাম, ‘আহা, হেঁটে ফিরবেন কেন? ওর পরেই তো বারাসাত লোকাল ছিল।’
বেশি কিছু বলতে পারলাম না। কারণ অফিস ফেরত বনগাঁ লোকালে ফিজিক্যাল ডিস্ট্যান্সিং-এর নিয়ম কানুন আমার জানা নেই।