ওয়ার্ডে থইথই করছে করোনা। সন্দেহজনক রোগীরা তো বটেই, অদ্ভুতভাবে এমন সব বাচ্চাদের পজিটিভ আসছে যাদের সেরকম বলার মতো উপসর্গ নেই। সে তালিকায় সাধারণ ভাইরাল হেপাটাইটিস, নেফ্রোটিক সিনড্রোম, অল্পস্বল্প পেট-খারাপ, একবার জ্বর তড়কার পর সারা ওয়ার্ডে ছুটে বেড়ানো বাচ্চা ইত্যাদি কী নেই? কত বাচ্চা সুস্থ হয়ে বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে হঠাৎ রিপোর্ট দেখা গেল পজিটিভ। পজিটিভদের কেউ হোম-আইসোলেশনে যাবে। বাড়াবাড়ি অসুস্থরা করোনা-ওয়ার্ডে ভর্তি থাকবে। হাজারো কাউন্সেলিং, বাড়ির লোকের উদ্বিগ্ন চাউনি, কান্নাকাটি, হোম-আইসোলেশনের নিয়ম বোঝানো ইত্যাদি মিলিয়ে পুরো গলদঘর্ম অবস্থা। মোটামুটি দুপুর সাড়ে-বারোটা বাজলেই রোজ ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে এই এক ছবি! এখন হঠাৎ করে শুরু হওয়া কোনও অসুস্থতা মানেই সবার আগে কোভিডের কথাই ভাবতে হচ্ছে। সে জ্বর থাক বা না থাক। আজ আমাদের ইউনিটের পজিটিভ রোগীদের মধ্যে দু’জনের অবস্থা অত্যন্ত সংকটজনক। এরকম চললে ক’দিন বাদেই করোনা ওয়ার্ডেও তিল ধারণের জায়গা থাকবে না। কী জানি, সামনের দিনগুলো কতটা ভয়ংকর হ’তে যাচ্ছে!
– কী করে হ’ল ডাক্তারবাবু? আমরা তো সবসময় মাস্ক পরে ছিলাম…
– আর পাশের বেডে? ওই মা যে বারবার মাস্ক খুলে ফেলছিল সেটা দেখেও কিছু বলেন নি কেন? আমরা তো আর ২৪ ঘন্টা চোখে চোখে রাখতে পারি না…
– বললে আবার কী ভাববে, সেই ভেবে…
– নিজের আর বাচ্চার ভালোর জন্য প্রয়োজন হ’লে গালাগাল দেবেন। এতবার বলার পরেও যারা নিয়ম মানে না তাদেরকে ভালোমানুষি দেখিয়ে কাজ নেই।
– যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন কী করবো ডাক্তারবাবু?
– যেমন বলে দিয়েছি বাড়িতে সেগুলো মেনে চলবেন। মনে করে মাস্ক পরবেন। সবাই মাস্ক পরে থাকলে রোগ সংক্রমণ অনেকটাই ঠেকানো যায়।
– আচ্ছা স্যার।
– আর ওই যেমনটা বললাম, রাস্তায়-বাজারে-গাড়িঘোড়ায় আপনার পাশে কেউ মাস্ক না পরলে সোজাসুজি বলুন। সবাই মিলে সতর্ক না হ’লে আপনার নিজের সচেতনতার বেশিরভাগটাই জলে যাবে।
ততক্ষণে গ্রাউন্ড ফ্লোরে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হয়েছে। ভ্যাক্সিনের জন্য লম্বা লাইন। আগে ভ্যাক্সিন নেওয়ার জন্য কামড়াকামড়ি চলছে। সিকিউরিটি দাদা-দিদিরা সামনের গেট বন্ধ করে এক একজন করে ঢোকানোর বন্দোবস্ত করছেন। চিকিৎসকদের তরফে দ্বিতীয় ঢেউয়ের ব্যাপারে অনেকদিন আগে থেকেই সতর্কবার্তা দেওয়া শুরু হয়েছিল। কেউ শোনে নি, কথা রাখে নি কেউ। রোদ উপেক্ষা করে ভ্যাক্সিনের জন্য এই উদগ্রীব চাউনির কণামাত্র আগে থেকে হ’লে আমরা অনেক ভালো জায়গায় থাকতে পারতাম। শুধুমাত্র নিজেদের দোষে একটা প্রায় জিতে যাওয়া ম্যাচ হারতে বসেছি!
এর মধ্যেই অনেকে জানতে চাইছেন, ইমিউনিটি বাড়ানোর জন্য হরলিক্স, কমপ্লান, বোনভিটা খাওয়ানো যাবে কিনা। সবাইকে বলছি,
হরলিক্স নয়, ইমিউনিটির জন্য বরং আপনার বাচ্চাকে মরশুমি ফলে lick করান।
কমপ্লান না করে বেশি প্লান করুন। বাচ্চাকে একটা গোটা ডিম দিন। অনেক বেশি উপকার হবে। দামেও কম হবে।
বোনভিটা কেন দেবেন? বোন কিংবা ভাই, ভিটামিনের অভাব মেটাতে শাকসব্জী দেওয়া চাই।
বছরখানেকের ধুন্ধুমার নাটক পেরিয়ে এখন আর কেউ করোনা ঠেকাতে আয়ুর্বেদিক ক্কাথ কিংবা আর্সেনিকাম অ্যালবাম খাওয়া যাবে কিনা জানতে চাইছেন না, এটুকুই বাঁচোয়া। করোনারোধক তাবিজ-কবচওলাদেরও আর দেখা নেই। মারীর দেশের দ্বিতীয় ঢেউয়ের দিনে শুধু আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসাই ভরসা। যদিও ঢেউয়ের গতি দ্রুত না কমানো গেলে সে দেওয়ালও ভেঙে পড়া সময়ের অপেক্ষা।