৩০ বছর আগেকার গল্প, আমি তখন ছত্রিশগড়ের শহীদ হাসপাতালে কাজ করি।
২২শে জুন, ১৯৯২—সুরেখা মারা গেল। মারা গেল সেই রোগে, যা হলে কেউ বাঁচে না। জলাতঙ্ক।
ওর বাবা ছিলেন ঠিকাদারি ট্রাক ড্রাইভার, ছত্তিশগড় মাইন্স শ্রমিক সংঘের সদস্য, মারা গেছেন ক’বছর আগে। সুরেখার মা ভগবন্তীন বাঈ রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করেন। মিষ্টি মেয়েটা, কতই বা বয়স হবে—৮ বা ৯। ছোট বোনটাকে নিয়ে হাসপাতালে দেখাতে আসতো মাঝে মাঝে মায়ের সঙ্গে। শৈবালদা সুরেখাকে ছোট বেলা থেকে দেখছে, তখন থেকে যখন শহীদ হাসপাতাল হয়নি, ইউনিয়নের গ্যারেজে যখন শহীদ ডিস্পেন্সারি চলত। সুরেখা নামটাও শৈবালদারই দেওয়া।
এপ্রিলের প্রথম দিকে সুরেখা পাগলা কুকুরের কামড় খেয়ে শহীদ হাসপাতালে এল। আমাদের জলাতঙ্কের টীকা থাকে না। ফার্স্ট এড দিয়ে আমরা পাঠালাম দুর্গ জেলা হাসপাতালে। দল্লী-রাজহরার বিএসপি হাসপাতালে অবশ্য এ টীকা পাওয়া যেত, কিন্তু ১৪টা ইঞ্জেকশন লাগানোর খরচ প্রায় সাতশ টাকা। ভগবন্তীন বাঈ-এর যা রোজগার তাতে সাতশ টাকা জোগাড় করতে প্রায় তিন মাস লাগবে।
দুর্গ জেলা হাসপাতালের সুরেখাকে পরীক্ষা করে টিকিটে লিখলেন ১৪টা এন্টি-রেবিস ভ্যাকসিন লাগাতে। ঘোড়ার রক্ত-রস থেকে তৈরী সে টীকা এখন আর চলে না। ডাক্তারবাবু তো লিখলেন, কিন্তু হাসপাতালের কম্পাউন্ডার সে টিকিটে লিখলেন স্টক নেই। দেড় মাস ধরে বারবার দুর্গ হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে টীকা পাওয়া যায় না। শহীদ হাসপাতালের স্বাস্থ্য-কর্মীরাও মাঝে-মাঝে দুর্গ হাসপাতালে টীকার খোঁজ করতে গেছেন। এর মধ্যে একবার রায়পুরে ডি কে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেও ঘোরা হয়ে গেছে। শেষে টীকা পাওয়া গেল মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে।
এই যে ঘটনার কথা বলছি তা ঘটার সময় ১৯৯২। ঠিক একবছর আগে অর্থনীতির উদারীকরণ হয়েছে, দেশের সরকার বিশ্ব ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভান্ডার থেকে বড় মাপের ঋণ নেওয়া শুরু করেছে আর ঋণের শর্ত মেনে সরে আসছে স্বাস্থ্য-শিক্ষার মতো পরিষেবা ক্ষেত্রগুলো থেকে। তারই ফল সুরেখার জলাতঙ্কের টীকা পেতে বিলম্ব, টীকাকরণ কর্মসূচীর টীকাগুলোর সরকারী হাসপাতালে অনিয়মিত সরবরাহ, সরকারী হাসপাতালে যক্ষ্মা-কুষ্ঠের ওষুধ অমিল হওয়া…।
যাই হোক, টীকা পাওয়ার পর সুরেখা সন্ধ্যাবেলা আসত টীকা লাগাতে। এসে চুপ করে আউটডোরের সামনের বেঞ্চটায় বসে থাকত। আউটডোর শেষ করার পর আমরা টীকা লাগাতাম। ঘোড়ার রক্ত-রস থেকে তৈরী টীকা একবারে পেটে ৫ মিলিলিটার করে লাগাতে হয়, পর পর ১৪ দিন। ইঞ্জেকশন লাগানোর সময় সুরেখাকে মুখটা একটুকুও বিকৃত করতে দেখিনি কখনও।
জুনের প্রথমে ১৪টা ইঞ্জেকশন লাগানো শেষ হল। আর ২০শে জুন সুরেখা হাসপাতালে ভর্তি হল পেটের যন্ত্রণা ও ১০২-১০৩ ডিগ্রী জ্বর নিয়ে। পরের দিন থেকে জল খেতে পারে না, খিঁচুনি। ২২ তারিখ জলাতঙ্কে মারা গেল ও, টীকা শুরু করার আগেই জলাতঙ্কের ভাইরাস স্নায়ু বেয়ে ওর মস্তিষ্কে পৌঁছে গিয়েছিল। না জলাতঙ্ক নয়, আসলে অর্থনীতির উদারীকরণের বলি হল ও।
জলাতঙ্কে এখন আর ঘোড়ার রক্ত-রস থেকে তৈরী টীকা লাগানো হয় না। কেন না এতে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বেশী, এনকেফালাইটিস হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এখন লাগানো হয় মানুষের ডিপ্লয়েড কোষে তৈরী টীকা অথবা জীবজন্তুর (হাঁস বা মুরগীর) কোষে তৈরী টীকা। মোট ৬টা ডোজ—কামড়ের দিন, ৩য় দিন, ৭ম দিন, ১৪শ দিন, ২৮ বা ৩০ নং দিন, এবং ৯০ দিনে একটা বুস্টার ডোজ।
সরকারী স্বাস্থ্য-পরিষেবার প্রাথমিক স্তর থেকেই বিনামূল্যে জলাতঙ্কের টীকা পাওয়া যাওয়ার কথা। কিন্তু মেলে না প্রায়ই। আমাদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আমরা তাই জলাতঙ্কের টীকা রাখি—সরকারী টীকা-প্রস্তুতকারী কোম্পানী ইন্ডিয়ান ইমিউনোলজিক্যাল লিমিটেড-এর Abhayrab। বাজারে এ টীকার একটা মাত্রার দাম ৩৪০ টাকা, আমরা কিনি ২০৬.১৮ টাকায়। যাঁরা সরকারী হাসপাতালে টীকা পেলেন না, আমাদের কাছে এলে আমরা দিই ২১০টাকায়। ৬টা মাত্রার মোট দাম পড়ে ২০৪০টাকার জায়গায় ১২৬০টাকা। কিন্তু ক’জন গরীব রোগী কিনতে পারেন এ’ দাম দিয়ে?!
এখনও সুরেখার মতো উদারীকরণের বলি হয়ে চলেন অনেক গরীব জলাতঙ্ক রোগী।
(এই লেখা ২০১৫-এর। এখন পশ্চিমবঙ্গের প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলিতে জলাতঙ্কের টীকা পাওয়া যাওয়ার কথা। আমাদের স্বাস্থ্য কেন্দ্রে এখন আর জলাতঙ্কের টিকা রাখা হয় না।)
প্রতি মূহূর্তে আপনার থেকে আরও অসংখ্য লেখা আশা করি। দীর্ঘ লড়াই জীবনের অনেক অভিজ্ঞতা, মূল্যবান দলিল হয়ে থাকা দরকার।