বদ্ধমূল ভ্রান্ত ধারণা বা ডিলিউশন বিষয়টি “delude” নামক ইংরেজি শব্দটি আসলে একটি লাতিন শব্দ থেকে এসেছে যার অর্থ হল “প্রতারণা”।
ডিলিউশন হল এক ধরনের মিথ্যা ধারণা যা রোগী প্রত্যয়ের সাথে আঁকড়ে ধরে রাখে। রোগীকে বার বার বোঝানো হলেও রোগী সেই ভ্রান্ত ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন না।
এই ধারণা বদ্ধমূল হলেও এর কারণ কোনো ঘটনা বা পরিস্থিতির ভুল বিশ্লেষণ। রোগীর কোনো সন্দেহ না থাকলেও, লোকে মনে করে যে সেই ধারনা ভ্রান্ত, ভিত্তিহীন বা অদ্ভুত।
পারসিকিউটারী ডিলিউশন
এই ক্ষেত্রে বদ্ধমূল ভ্রান্ত ধারণা হয় যে কেউ রোগীকে তাড়া করছে, পিছনে লেগেছে বা অন্য কোনো ভাবে ক্ষতি করবার চেষ্টা করছে। যেমন-
রোগীর মনে হতে পারে যে গভর্মেন্ট রোগীর পিছনে এজেন্সি লাগিয়েছে। রোগীর এমনও মনে হতে পারে যে তার প্রতিবেশিরা বিশেষ টেকনোলজি (যেমন- ইন্টারনেট) অথবা বিশেষ ক্ষমতার মাধ্যমে তার উপর প্রভাব ফেলছে। সিজোফ্রেনিয়া ও বাইপোলার ডিসঅর্ডারে এই জাতীয় ডিলিউশন দেখা যেতে পারে।
গ্রান্ডিওস ডিলিউশন
এই জাতীয় ডিলিউশনে আক্রান্ত ব্যক্তি নিজেকে কেউকেটা ভাবতে শুরু করেন। কেউ ভাবতে থাকেন তাঁর নিজের কিছু ঐশ্বরিক ক্ষমতা আছে। কেউ ভাবেন তিনি কোন বিশেষ বা গোপনীয় মিশনে অংশ নিয়েছেন।অনেকে আবার নিজেকে অত্যন্ত বিখ্যাত বা ধনী ব্যক্তি ভাবতে থাকেন। “বাইপোলার ডিসঅর্ডার” নামক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের “ম্যানিক” অবস্থায় থাকা কালীন এই জাতীয় ডিলিউশন দেখা যেতে পারে।
নিহিলিস্টিক ডিলিউশন
মূলত “সাইকোটিক ডিপ্রেশন” রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে এই জাতীয় ডিলিউশন দেখা যায়। এক্ষেত্রে “গ্রান্ডিওস ডিলিউশন”-এর উল্টো ঘটনা ঘটতে থাকে। রোগী অনেক সময় ভাবেন যে তিনি আর বেঁচে নেই বা তাঁর শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলিতে পচন ধরে সেগুলি নষ্ট হয়ে গেছে। এই ঘটনাকে “কোটার্ড সিনড্রোম” বলা হয়।
মর্বিড জেলাসী (ডিলিউশন অফ ইনফেডিলিটি)
এক্ষেত্রে রোগীর হঠাৎ মনে হতে পারে যে তাঁর স্বামী অথবা স্ত্রী অন্যের প্রতি অনুরক্ত। যদিও আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবেরা নিশ্চিত যে এমন ভাবনার কোনো কারণই নেই। সাধারণ ভাবে মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। অনেক সময় পুরুষত্বহীন বা যৌন সঙ্গমে অক্ষম ব্যক্তিদের মধ্যে এই জাতীয় সমস্যা বেশি দেখা যায়। আবার অনেক সময় জীবনসঙ্গী বা সঙ্গিনী রূপে বা গুণে অতিরিক্ত সুন্দর বা সুন্দরী হলে অপরজনের মনে হীনমন্যতার সৃষ্টি হয়, যা এই প্রবণতাকে আরো বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে অনেক সময় রোগী অতিরিক্ত হিংস্র হয়ে ওঠেন এবং গার্হস্থ্য হিংসার নানান ঘটনা ঘটে।
ডিলিউশন অফ লাভ (ইরোটো ম্যানিয়া)
মহিলাদের মধ্যে এই রোগের প্রবণতা বেশী। এই জাতীয় ডিলিউশনে আক্রান্ত মহিলা কোন কারণ ছাড়াই ভেবে নেন কোন এক বিখ্যাত মানুষ তাঁকে ভালোবাসেন| সেই বিখ্যাত মানুষটিকে তিনি চিঠি লিখতে থাকেন, উপহার পাঠাতে থাকেন। বাস্তবে যদিও সেই মানুষটি এ বিষয়ে বিন্দু-বিসর্গ জানেন না।
হাইপোকন্ড্রিয়াকাল ডিলিউশন
এই জাতীয় রোগে আক্রান্ত রোগী অনেক সময় ভাবেন যে তাঁর শরীর থেকে কোন খারাপ গন্ধ বেরোচ্ছে যা অন্য মানুষদের বিরক্তির কারণ হতে পারে।যদিও আশেপাশের মানুষজন তা অনুভব করেন না। অনেকে আবার মনে করেন যে তাঁর শরীরের কোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের গঠন খারাপ। সেই অঙ্গের গঠন ঠিক করার জন্য তিনি বহু চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে থাকেন এবং অনেক সময় প্লাস্টিক সার্জারীর জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকেন। আবার এই জাতীয় একরকমের ডিলিউশন হল “ডিলিউশানাল প্যারাসাইটোসিস”।
ডিলিউশসনাল প্যারাসাইটোসিস
“ডিলিউশনাল প্যারাসাইটোসিস” বা “একবোম সিনড্রোম” হল একধরনের মানসিক রোগ যেখানে রোগী মনে করেন তাঁর শরীরের চামড়ায় বা অন্য কোন স্থানে পোকা বা ওই জাতীয় কোন প্রাণী বাস করছে। অন্য কেউ ওই জাতীয় পোকা দেখতে না পেলেও এই রোগীরা পোকা বা ওই জাতীয় কিছু দেখতে পান এবং চামড়া থেকে ওই পোকাগুলিকে বের করার নানান পন্থা অবলম্বন করেন। যদিও তাতে সমস্যা কমে না।
পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের মধ্যে এই রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেশি। সাধারণ ভাবে ৫৫ থেকে ৭০ বছর বয়স্কদের মধ্যে এই রোগ দেখা যায়। কোকেন বা ওই জাতীয় কিছু মাদক দ্রব্য ব্যবহার করলে এই রোগ অল্পবয়স্কদের মধ্যেও দেখা যেতে পারে।
ডিলিউশনাল মিস আইডেন্টিফিকেশন
এক্ষেত্রে মূলত দুটি রোগের কথা বলা হয়। “ক্যাপগ্রাস সিনড্রোম” ও “ফ্রেগলি সিনড্রোম”। “ক্যাপগ্রাস সিনড্রোম”-এর ক্ষেত্রে রোগীর মনে হয় তাঁর পরিচিত কোন ব্যক্তি আসলে সেই ব্যক্তি নয়। অন্য একটি মানুষ সেই পরিচিত ব্যক্তিটির রূপ ধরে আছে।
ফ্রেগলি একজন বিখ্যাত নাট্য অভিনেতা ছিলেন যিনি বিভিন্ন ছদ্মবেশ ধারায় পারদর্শী ছিলেন। “ফ্রেগলি সিনড্রোম”এর ক্ষেত্রে রোগীর মনে হয় কোন একটি মানুষ বিভিন্ন রূপ নিয়ে তাঁর সামনে আসছে। অর্থাৎ রোগী মনে করতে পারেন যে একটাই লোক কখনো সবজি বিক্রেতা হয়ে, কখনো গাড়ির ড্রাইভার হয়ে, কখনো বা চিকিৎসক হয়ে তাঁর সামনে আসছে।
তাহলে প্রশ্ন আসবে ডিলিউশন কেন হয়?
এ বিষয়ে বিভিন্ন মতামত আছে। “সাইকো অনালিটিক্যাল” থিওরী অনুযায়ী আমাদের মনের ইড, ইগো ও সুপার ইগোর ভারসাম্য রক্ষার ব্যর্থতা থেকে এই জাতীয় সমস্যা তৈরি হতে পারে। হীনমন্যতা, উদ্বিগ্নতা, যৌনতাসংক্রান্ত সমস্যা থেকে নানান ধরণের ডিলিউশন সৃষ্টি হতে পারে।
অনেকের মতে মস্তিষ্কের ত্রুটিপূর্ণ যৌক্তিক বিশ্লেষণ থেকেই ডিলিউশন তৈরি হয়।
নিউরো বায়োলজিক্যাল থিওরী অনুযায়ী মস্তিষ্কে ডোপামিনের আধিক্য ডিলিউশন জাতীয় লক্ষণ সৃষ্টি করে। মস্তিষ্কের প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স, এন্টারিওর সিঙ্গুলেট কার্টেক্স এবং লিম্বিক লোব ঠিক মত কাজ না করলেও এই জাতীয় সমস্যা তৈরি হতে পারে।
এবার আসি চিকিৎসা প্রসঙ্গে। সমস্ত ধরনের মানসিক রোগেরই কার্যকরী চিকিৎসা সম্ভব। এই জাতীয় রোগের চিকিৎসায় মূলত “এন্টি -সাইকোটিক” গোত্রের ওষুধ ব্যবহৃত হয়। মনে রাখতে হবে মানসিক রোগের ওষুধ মানেই ঘুমের ওষুধ -এই ধারণা ভুল। এমন অনেক ওষুধ আছে যেগুলি খেলে ঘুমের সমস্যা হয় না এবং রোগীর দৈনন্দিন কাজকর্ম ব্যহত হয় না। যত তাড়াতাড়ি রোগীকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে আনা হবে, রোগীর ঠিক হবার সম্ভাবনা ততটাই বাড়বে।