(একটি জ্ঞানবাচক কথকতা,বলা ভালো হাতুড়েমূলক বিত্তান্ত)
তপ্পনবাবু মাতাল হলেও ডাক্তারি ওনাকে ছাড়ে না। এবং উনি একজন পরীক্ষিত সার্টিফাইড মাতাল। সদাই মাতাল।মানদাসুন্দরীর চুল্লুর ঠেক ওনার অবসরজীবন যাপনের অংশ। ঐ ভয়াবহ ঝাঁঝালো পানীয়ের জোরেই এই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ জীবনতরী বেয়ে চলেছেন।
এটা গরীব, ছোটোলোকের আড্ডা। আমাদের মাতাল ডাক্তারও আহামরি ভদ্রলোক বা বড়োলোক কোনোটাই নন, তাই এদের সঙ্গে ডুবি’ অমৃতপাথারে থাকেন।
এরা ছোটোলোক বলে’ অচেতনও নয়। আজ বিরোধীদলীয় বাংলা বন্ধ। অতি বৃদ্ধ খগেনবাবু মানদাকে জিজ্ঞেস করলেন “ও মানদা, আইz তো বাহাংলা বন্ধ, তুই আইz দোকান খুলছস ক্যান?”
গঙ্গা যমুনা সিনেমার অরুণা ইরানির মতো চটকদার হাসি হেসে মানদা বললো “তখন তো ওদের ক্ষ্যামতা ছিলো, তাই ওরাই ছিলো নাগর, ওদের কথা না মানলে দোকান তো দোকান হাড্ডি গুড্ডি ভেঙে দিতো। ওভাবে শলীল পাওয়া যায়, মন কি পাওয়া যায়? তাই এখন ওদের ট্যাকা নেই….কতাও কেউ মানে না”
পৃথুলা শরীরে চর্বির ঢেউ তুলে যেতে যেতে মানদা ওর পুরোনো ডায়ালগটা বলে’ যায় “কতো নাগর এলো গ্যালো-সবাই আমার মাল খেয়ে বড়ো হলো …..”
ইতিমধ্যে মানদাসুন্দরীর বিশেষ পানীয়ের গুণে কিনা জানা নেই, মলিনবাবুর তোবড়ানো গাল বেয়ে হুশহুশ করে জল পড়তে লাগলো। সেই দেখে ওনার ক্ষুদ্র দেড়েল সন্তান চোখ খুঁটে খুঁটে জল বা’র করে’ফেললো।
নবনীভূষণ বললেন “আ মোলো যা, এদুটো কাঁদে ক্যানে?”
আড়নয়নে জলে বাবার চোখ বন্ধ দেখে, ক্ষুদ্র সন্তান টুক্করে’ বাবার সামনে রাখা সফেন গেলাস সাবড়ে দিলো। তারপরই তার উঠলো মরণান্তিক চারটি হেঁচকি। সেই হিদ হিদ হিদিক্কারে লৌহমানুষী মানদার হাত কেঁপে বোতল উপচে’ পানীয় পড়ে গেলো।
নেশাতুর প্রোফেসর বললেন “এরা কান্দে কেনে? মানদাসুন্দরী তোমার আঁচলপ্রান্ত দিয়ে বাপ ব্যাটার চোখ মুচে দাও গো।”
মানদা ঠোঁট মুচড়ে’,কোমরে একটা লচকা মেরে চলে’ গেল “মরণ”।
মলিনবাবু মলিন জামার মলিন হাতায় নিজের চোখ মুছে’ (ছেলের চোখের পরোয়া না করে) বললেন “তপ্পনবাবু, ছেলের বুকে বড়ো ব্যাতা”।
তপ্পন তখন আধো জাগরিত নেশার ঘোরে, চক্ষু উৎপাটন করে’ দেকলেন -একটা মলিনবাবু, একটা দেড়েল ছোক্রা আর একটা ঘোমটাবতী যৌবনবতী নারী।
ফেনিল সুরার তরঙ্গ পার থেকে, সেই দেড়েলের কতা ভেসে এলো “কাকাবাবু, বুকে বড়ো ব্যতা হয়, সে কতো না ডাক্তার, কতো না কবরেজ, কতো না পরীক্কে, নিরীক্কে….(হাউ হাউ হাউ)
“সিকি হে কতো দিন ধরে ব্যতা?”
“তা মাস দুয়েক হলো….যকন তকন….”
“কতোক্ষণ থাকে? মানে ব্যতাটা কতোক্ষণ থাকে?”
ঘোমটাবতী উত্তর দ্যায় “অনেক ক্ষণ গো কাকাবাবু….একদিন দুদিন… তাপ্পর বুক দুটো টিপে ধরলি তবে ব্যতা কমে…”
তপ্পন মহাবিষ্মিত হয়ে শুধায় “কার বুক দুটো?”
ঘোমটাবতী ঘোমটা আরেকটু টেনে লজ্জাবতী মুচকি হাসে। ভাইপো চটপট বলে “এজ্ঞে আমার, ওর নয়” তারপর যোগ করে, “যখন হতি থাকে, ত্যাখন হতিই থাকে”
তপ্পন কিয়ৎক্ষণ টাক চুলকে ভাবেন “হতে পারে ফুসফুসে ক্যান্সার, টিবি, ইউরিক অ্যাসিড, সার্ভিক্যাল স্পন্ডাইলোসি’ বা পাঁজরা ভাঙা, কিন্তু হার্টের ব্যথা নয়”
ঘোমটাবতী সচকিত “উই মাগো, বলো কি!”
দেড়েল ছোকরা অজ্ঞান হওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে’ বলে “আমারে কি এখুন এ্যাতো সব পরীক্ষে করতে হবে নাকি?”
ঘোমটাবতী আবার বলে “উই মা”
মাতাল দু আঙুলে টুসকি দিয়ে সিগারেটের স্টাম্পটা রাস্তায় ফেলে’ দ্যায় (অস্বাস্থ্যকর)। একটা ছোট্ট বিলাইছানা দৌড়ে সেটাকে শুঁকে আঁৎকে উঠে রোগা মা’টার পেটে মুখ গোঁজে, গোঁপের ফাঁকে একটু হাসে “বুকের ছবি হয়েছে তো?”
ঘোমটাবতী হেঁতিবাচক ঘাড় দোলায়।
“তাইলে ওসব কিছুই হয় নি। হার্টের ব্যথা হলে এরকমটা হয় না।”
মলিনবাবু আবার মলিন হাস্য করেন “কিরকমটা হয়?”
তপ্পন নেতিবাচক ঘাড় নাড়েন “বলবো না” (অপর্ণা সেনের মতো বেশ সুর খেলিয়ে’ খেলিয়ে’)।
প্রোফেসরসাব পকেট থেকে একটা নেভি কাট এগিয়ে ধরেন “এবার বলবে তো?”
মাতাল বুড়ো নিজের শিখাহীন নীল লাইটার দিয়ে সিগারেট ধরান।
“হার্টের ব্যথা, সাধারণতঃ হাঁটা চলা করলে, সিঁড়ি বেয়ে উঠলে বা ভারি জিনিস তুললে, তখন হয়। হার্ট অ্যাটাক না হ’লে কয়েক মিনিটের জন্য থাকে, ঘন্টার পর ঘন্টা নয়।আর সবচে’ বড়ো কথা, বুকেই হবে এ্যামন কথা নেই। চোয়ালে, হাতে বা পিঠেও হতে পারে। তবে হার্ট অ্যাটাক হলে ব্যথা সেরকম না হলেও না হতে পারে, কিন্তু ভয়ানক ঘাম হবে আর বমি হতে পারে। প্রেসারও কমে যেতে পারে। ফুসসসসসসসস (এটা নেভি কাটে ধোঁয়া ছাড়ার শব্দ)।
একটা মেয়ে হাঁটু ভাঁজ করে’ করে’ কষ্ট করে’ এঁকেবেঁকে হাঁটছিলো। সে দাঁড়িয়ে একটা ঝুটা সোনার ঝুমকো দুল বার করে’ দেখতে থাকে। হাতুড়েও নির্নিমেষ আজন্ম অক্ষম মেয়েটার উজ্জ্বল মুখটা দেখতে থাকেন।