মেডিকেল কাউন্সিল ভোটে বিবিধ দুর্নীতি অনাচার জালিয়াতি ইত্যাদি নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখে এসেছি। যাঁরা আমার দেওয়ালের দিকে লক্ষ্য রাখেন, তাঁরা সেসবের অন্তত কিছু কিছু পড়েছেন।
মাঝে ডক্টর্স ডায়ালগ-এর ফেসবুক পেজে সে নিয়ে আলোচনাও করেছি। যাঁরা আলোচনাটি শোনেননি, চাইলে সে আলোচনার ইউটিউব ভিডিও দেখে নিতে পারেন। আমার টাইমলাইনেই আছে।
মিডিয়ার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই, কেন না চিকিৎসকদের কাউন্সিলের একটা ভোট নিয়ে তাঁরা নিয়মিত খবর করে গিয়েছেন।
কিন্তু আজকের প্রাপ্তি সত্যিই অপ্রত্যাশিত। আনন্দবাজারের মতো প্রভাবশালী সংবাদপত্র কাউন্সিল ভোটের অনাচার নিয়ে সম্পাদকীয় লিখলেন!!
এ তো শুধুই মেডিকেল কাউন্সিলের ভোট নয়, বৃহত্তর প্রেক্ষিতে এই নির্বাচন ঘিরে ঘটিত জালিয়াতির তাৎপর্য অপরিসীম। মাননীয় সম্পাদক (কথাটা লিঙ্গ-নিরপেক্ষ অর্থে ব্যবহার করছি) সেই গুরুত্বের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, যথোচিত ভাবেই।
সমাজের উঁচুতলায় বসে আমরা যারা বিশ্বাস করি, গ্রামের ‘অশিক্ষিত’ ‘গরীবগুর্বোরা’ লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের পাঁচশ পেয়ে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে ভোট দিয়ে থাকেন – এই নির্বাচনের জালিয়াতি তাঁদের পক্ষে আই-ওপেনার। কেন না এই নির্বাচনে প্রার্থীরা সকলেই চিকিৎসক – অর্ধেক প্রার্থী চিকিৎসক-অধ্যাপক – ভোটাররাও তা-ই – অর্থাৎ কেউই ‘অশিক্ষিত গরীবগুর্বো’ নন।
খুব যথার্থভাবেই সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে – “জনমত গঠনের দ্বারা, সমর্থন আদায়ের মাধ্যমে ন্যায্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা এখন অতীত।”
এই কথাটা প্রচারপর্বে বারবার বলেছি। শাসকপক্ষ ভোট চাইছিলেন না, চাইছিলেন ফাঁকা ব্যালট। বিপরীতে বারবার একটাই কথা বলে এসেছি, ভোট যাকে খুশি দিন, কিন্তু নিজের হাতে ভোটটা দিন।
নিজের দেড় মিনিটের প্রচার ভিডিওতেও বলেছি – কাউকে ফাঁকা ব্যালট দেবেন না। যাকে খুশি ভোট দিন – আমাকে/আমাদের দিলে নিঃসন্দেহে খুশি হবো – কিন্তু নিজের ভোট নিজেই দিন। স্বচ্ছ দুর্নীতিমুক্ত মেডিকেল কাউন্সিল গড়ার পথে প্রাথমিক ধাপ ওটাই। প্রত্যেকে যেন নিজের হাতে নিজের ভোটটা দিতে পারেন, এবং দেন।
তাহলে শাসকপক্ষ ভোট না চেয়ে ব্যালট চাইলেন কেন? ভোট চাওয়ার পক্ষে তাঁদের কোনও যুক্তি ছিল না, বিপক্ষের প্রার্থী হয়ে এমনটা বলতেই পারি – কিন্তু সেটা বড্ডো বায়াসড মতামত হয়ে যাবে। আসলে তাঁরা একশ শতাংশ নিশ্চিত হতে চেয়েছিলেন। গণতন্ত্রে এই হানড্রেড পার্সেন্ট নিশ্চিত হতে চাওয়াটাই বিপজ্জনক। বিপজ্জনক আমজনতার পক্ষে তো অবশ্যই, শাসকের পক্ষেও বটে। কেননা, সমর্থনের মাটি কখন যে ভেতরে ভেতরে আলগা হয়ে গিয়েছে, তার তিলমাত্র আন্দাজ মেলে না। তবুও…
“প্রতারণা, গা-জোয়ারি, প্রকাশ্যে আইনের প্রতি তাচ্ছিল্য, নির্বাচন আধিকারিকদের দলদাসে পরিণত করা, বিরোধীর প্রতি অপরিমিত হিংসা এবং সত্যের শবদেহের উপর দাঁড়িয়ে নির্লজ্জ মিথ্যাভাষণ, এই হল আজ সর্বস্তরে ‘ভোট করানোর’ রীতি।’
ভাবতে একটু লজ্জাই করে, যে, বড় সংবাদপত্র-গোষ্ঠীর সম্পাদকীয়তে যে প্রসঙ্গে এমন মন্তব্য লেখা হলো, সে নির্বাচনটি আমাদেরই। চিকিৎসক হিসেবে গর্বিত এবং লজ্জিত হওয়ার সুযোগ – মানে, দুধরনেরই ঘটনা – আজকাল প্রায়শই ঘটে। এটি লজ্জিত হওয়ার মতো ঘটনার লিস্টে উপরের দিকেই থাকবে।
কিন্তু, এই অনাচারের মূল চক্রীরা লজ্জা পাবেন তো?
(আচ্ছা, নির্মলবাবু তো এই ভোটে সরাসরি ভাবে যুক্ত ছিলেন না। তিনি কি এই সম্পাদকীয় পড়ে ভাবছেন – দেখেছ তো, সব পাখিই মাছ খায়, শুধু নাম হয় মাছরাঙার!!)
সম্পাদকীয়র শেষ প্রশ্নটি অব্যর্থ।
“গণতন্ত্রের এই গলিত, স্থবির রূপ নিয়ে বাঁচাই কি বাঙালির নিয়তি?”
উত্তরটা শাসক বা প্রশাসন নয়, আমজনতাকেই খুঁজতে হবে।
খুঁজতে হবে আপামর বঙ্গবাসীর অংশ হিসেবে চিকিৎসকদেরও।
(আনন্দবাজার পত্রিকা-র উপরোক্ত সম্পাদকীয় দেওয়া রইল নিচে।)