মহিউদ্দিন শেখ। নামটি বেশ ভারিক্কি হলেও মহিউদ্দিনের আর কিছুই ভারিক্কি নয়। চেহারা রোগা পাতলা, ছিপছিপে। বয়স চল্লিশের কোঠায় হবে হয়তো। আসলে সে নিজেও জানে না তার বয়স কত। প্রথম দিন জিগ্গেস করলে বলেছিল, ‘আপনি লিখে দেন’ ।
বলেছিলাম, ‘বলো কত বয়স, তবে তো লিখব?’
বলেছিল, ‘সে কি আমি জানি বাবু, আপনি যা হয় লিখে দেন’।
আমি হিসেব করতে শুরু করলাম। উল্টো হিসেব, মাঝে মাঝেই আমাদের করতে হয়। বললাম, ‘তোমার বড় মেয়ের বয়স কত?’
‘কত হবে?’ বলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকেই তাকালো। বুঝলাম, তাও জানে না। এবার অন্য হিসাব করতে হবে।
বললাম, ‘স্কুলে যায়?’
‘না বাবু। সাত ক্লাসের পর ছেড়ে দিয়েছে । তার বিয়ে হয়ে ছেলে হয়ে গেছে’
:কতদিন আগে বিয়ে হয়েছে?:
‘তা বছর পাঁচেক আগে”
এবার মহিউদ্দিনের বয়সের একটি ধারণা আমার রাডারে এসে গেছে। তার মেয়ের পাঁচ বছর আগে বিয়ে হয়েছে, মানে এখন বছর কুড়ি বা বেশি হবে। তার সাথে আরও কুড়ি যোগ করলে চল্লিশের উপরে দাঁড়ায়। মহিউদ্দিনের দিকে তাকালাম। গাল ভর্তি সাদা কালো খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি নিয়ে ফোকলা দাঁতে আমার দিকে হাসি মুখে তাকিয়ে আছে। দেখে পঞ্চাশের উপরে মনে হয়। ঘচ ঘচ করে লিখে দিলাম ছেচল্লিশ।
সেই শুরু। তারপর থেকে মহিউদ্দিন আমার রেগুলার খদ্দের। গ্রাম্য হাসপালের এই সামান্য চিকিৎসাই তাদের ভরসা। আর সেখানকার নিধিরাম সর্দার আমি। তাই অনেকের সাথেই আমার চেনা-পরিচয় হয়।
এই ভাবে ক্রমে জানলাম মহিউদ্দিনের ঘরের খবর, হাঁড়ির খবর।
তার জমিজমা বিশেষ নেই। অন্যের জমিতে জনমজুর খেটে সংসার চলে। থাকার মধ্যে রাস্তার পাশে একটু জমি আর তার উপর একটা মাটির ঘর, একফালি বারান্দা আর তার মধ্যে মহিউদ্দিনের ছয় সন্তানের বাস। কি করে সবাই থাকে, সে আমার কাছে এক রহস্য, কিন্তু মহিউদ্দিনের তা নিয়ে কোন দুশ্চিন্তা আছে বলে মনে হয় না। তার ছোট কন্যার বয়স মাত্র দুই। রেগুলার ইন্টারভেলে পরিবারের সদস্য সংখ্যা বেড়েই চলেছে। তার পরিনামে মা হয়, নুন আনতে পান্তা ফুরোয় আর সংসারে অভাব লেগেই থাকে।তার বাড়ি ঠিক রাস্তার পাশেই।
তখন আমি একটি গাড়ির মালিক। আমার প্রথম কয়েক মাসের মাইনে জমিয়ে একটি এম এইট্টি কিনেছি। হোক না এম এইট্টি, দু চাকা। সেই আমার রোলস রয়েস। শুধু আমার জীবনের কেন, আমার উর্ধ্বতন চৌদ্দ পুরুষের মধ্যে আমিই প্রথম গাড়ির মালিক! অবশ্য শখে কিনিনি। সারাদিনে তিনটি বাস চলে ওই লাইনে, তাই বেশিরভাগ সময় দাঁড়িয়ে যেতে হয়। সেই দুর্ভোগ ঘোচাতে কড়কড়ে আট হাজার চারশো চল্লিশ টাকা দিয়ে গাড়ি কিনেছি। চার মাসের মাইনে জমিয়ে। প্রথম মাসে হাতে পেয়েছিলাম বাইশশো তেতাল্লিশ টাকা।
তা সেই গাড়িতে করে মগরা থেকে পনের কিলোমিটার দূরে আমার স্বাস্থ্য কেন্দ্রে বেশ আরামেই যাই। গ্রামের ঘরবাড়ি, ফাঁকা মাঠ, ধানক্ষেত দেখতে দেখতে যাই। বেশ ভালোই লাগে। কিন্তু মহিউদ্দিনের বাড়ির কাছে এসে গতি কমিয়ে দিতে হয়। সরু রাস্তা, তার দুই দিকে বাড়ি, আর রাস্তায় হাঁস মুরগির অভাব নেই। বাচ্চাকাচ্চারও অভাব নেই। তারা একবার রাস্তার এদিকে একবার ওদিকে ছুটোছুটি করে বেড়ায়। কারও লেগে গেলে রক্ষে নেই। তাই বেশ সাবধানেই চালাই। সাবধানের মার নেই।
মহিউদ্দিনকে দেখি একটা লুঙ্গি পরে খালি গায়ে কোনও না কোনও বাচ্ছা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কিংবা বাড়ির পাশের আম গাছের নিচে বাঁধা মাচায় আরও এক দুজনের সাথে বসে আছে। কোনও দিন দেখি তার বিবি বাচ্ছা কোলে করে দাঁড়িয়ে আছে। এরকম অনেকেই ওই সময় দাঁড়িয়ে দেখে নিতো আমি আসছি কি না। আমার আসার খবর তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ওই অঞ্চলে তখন আমি সবেধন নীলমনি একজনই পাশ করা ডাক্তার। আমি ঢুকলে সে খবর ছড়িয়ে যেত, রোগীদের আসা শুরু হতো।
মহিউদ্দিন যখন আসত, তখন আরও দু’তিনজনকে নিয়ে আসত। তাদের স্বাস্থের অবস্থা ভালো নয়। কোনও মতে একটি প্যান্ট পরা, উর্ধাঙ্গ প্রায় অনাবৃত। সারা গায়ে রাস্তার ধুলো মাখা। এক এক সময় রাগ হত। মনে হত খেতে দেবার মুরোদ নেই, অথচ বছরে বছরে বাচ্ছা পয়দা করে চলেছে। কোনও কোন দিন মহিউদ্দিন আসত না, আসত তার বিবি ফিরোজা। ওই একই ভাবে দু-তিনজনকে নিয়ে। এতজনের রেগুলার ওষুধ নিতে গেলে ডাক্তারকে একটু তোয়াজে রাখতে হয়। তাই তার বিবি আমাকে বাপ বাপ বলতো। মহিউদ্দিন কখনো বলত বাপ, কখনও বাবু। এই বাপ বলা ওই এলাকার একটা চল ছিল। আমার অনেক বুড়ি রোগী ছিল, তাঁরাও আমাকে বাপ বাপ বলত। তাদের কথা আর একদিন বলব। আজ মহিউদ্দিনের কথা বলতে বসেছি, তার কথাই বলি।
হঠাৎ একদিন শুনলাম, মহিউদ্দিনের বিবি অষ্টম শিশুর জন্ম দিয়েছে। হাসপাতালে আসেনি। বাড়িতেই হয়েছে। তখন এটি খুব অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। অনেক শিশুই বাড়িতে জন্মাতো।
আমার কম্পাউন্ডার বেশ করিত্কর্মা লোক ছিলেন। আমার অবর্তমানে তিনিই সর্বেসর্বা। দীর্ঘদিন ওখানে আছেন। আশেপাশের কয়েক গ্রামের আনেকের অনেক ধরণের খবর তিনি জানতেন। সময় সুযোগ মত তিনি সেই বিষয়ে আমাকে ওয়াকিবহাল করে আমাকে সতর্ক করে দিতেন। বয়স্ক মানুষ, অপরিচিত জায়গায় আমার মত নবিশের নিরাপত্তার দায়িত্ব তিনি স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। কিন্তু নিরাপত্তা মুলক খবরের ফাঁক দিয়ে অন্য সব খবরও ঢুকে যেত।
মহিউদ্দিন বা তার বিবির সাথে আরও দু তিনটে বাচ্চা দেখলে তিনি রেগেই যেতেন। একবার তো তার বিবি পাঁচ জনকে নিয়ে হাজির। কম্পাউন্ভার দেখেই গর গর শুরু করলেন। তাকে আবার পাঁচ জনের টিকিট বানিয়ে খাতায় লিখতে হবে। আর ওরাও কিছুতেই পুরানো টিকিট নিয়ে আসবে না। তারা এসে আমাকে ‘বাপ’ ‘বাপ’ বলে কাজ হাসিল করে নিত, তা তিনি জানতেন। খোলা জানালা দিয়ে রাস্তায় তাকিয়ে তাদের আসতে দেখলেই আমাকে বলতেন, ‘নিন, আপনার খদ্দের আসছে ‘।
সেবারও মহিউদ্দিনকে তার দলবল নিয়ে আসতে দেখে বললেন, ‘ওই আসছে আপনার খদ্দের। আপনার আরও এক খদ্দের বেড়েছে, জানেন?’
বললাম ‘মানে’?
মহিউদ্দিনের আর এক কন্যা হয়েছে ‘।
বললাম, ‘কৈ, হাসপাতালে তো আসেনি ‘
তিনি খুব স্বাভাবিক ভাবেই বললেন, ‘ওদের হাসপাতাল লাগে না ‘
বললাম, ‘তবে কি ধাইরাই ডেলিভারি করায়?’
কম্পাউন্ভার বললেন, ‘গ্রামে ধাই আছে। তবে মহিউদ্দিনের বিবির তাদের লাগে না। নিজেই সব করে!’
তিনি এমন ভাবে বললেন, যেন এটি একটি অত্যান্ত স্বাভাবিক ব্যপার। আমি অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘বলেন কি?’
তিনি বললেন, আপনি ওকেই জিগ্গেস করে দেখবেন।
তখন আউটডোরে ভিড় কমে গেছে। মহিউদ্দিনকে বললাম, ‘তোমার নাকি আর একটি মেয়ে হয়েছে?’
মহিউদ্দিনের ফোকলা দাঁতে এক গাল হাসি বেরিয়ে এল। সেই হাসি ঢেউ খেলে গেল তার লুঙ্গি পরা খালি গায়ের রোগা শরীরে।
দেখে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। অভাবের সংসারে খালি ঘর ভর্তি করে চলেছে। ভাবলাম আজ দুই কথা শুনিয়ে দেব। তার আগে কম্পাউন্ডারের তথ্য যাচাই করে নেওয়া দরকার। মহিউদ্দিনকে বললাম, ‘হাসপাতালে তো আসেনি। কে ডেলিভারি করালো? ধাই?’
‘না বাপ। রহিমের মা একাই সব করতে পারে। ধাই লাগে না’।
কম্পাউন্ডার পাশ থেকে বললেন, ‘দেখলেন? বলেছিলাম না? বাচ্চা হতে হতে অভ্যাস হয়ে গেছে’।
এবার মহিউদ্দিনের দিকে তাকিয়ে ঝাঁঝালো স্বরে বললাম, ‘এই যে তোমার এতগুলা বাচ্চাকাচ্চা, জমিজমাতো কিছু নেই। খাওয়াবে কি একবার ভেবেছ? এবার অপারেশন করিয়ে নাও’।
মহিউদ্দিন আমার মেজাজ দেখে আমতা আমতা করে বলল, ‘বাবু, আল্লার দান ‘ ।
‘আল্লাহ তো আর খেতে দেবে না। খেতে তো তোমাকেই দিতে হবে?’
‘আল্লাহ যখন জীবন দিয়েছেন, তিনিই খাবার ঠিক দেবেন’।
এই ধরনের কথা শুনে আরও রাগ হল। বললাম, এবার অবশ্যই অপারেশন করিয়ে নিও।
”না বাপ, সে গুনাহ করতে পারব না। পাপ হবে আল্লাহর কাছে’।
রাগ করে বললাম, ‘তবে থাকো তোমার আল্লাকে নিয়ে, আর বাচ্চাগুলো না খেয়ে অসুখে মরুক’।
মহিউদ্দিন আর কোন কথা বলল না। আমার মেজাজ দেখে চুপচাপ ওষুধ নিয়ে চলে গেল।
পরে আমার হাসপাতালের কাছের স্কুলের এক মুসলমান মাস্টার মশাইকে বলেছিলাম, ‘এই সব আপনারা বোঝাতে পারেন না? সব আল্লার নামে চলছে?
তিনি অসহায়ের মত বললেন, কি বলব ডাক্তারবাবু, আমাদের কথার চেয়ে ওদের কাছে মৌলবীর করার দাম বেশি। তারা যা বলে, তাই ওরা মেনে চলে। তবে এরা খুব ধর্মভীরু তো! তারপর একটু থেমে বললেন, দিন পাল্টাচ্ছে। অনেক শিক্ষিত মুসলমান এখন লাইগেশন করিয়ে নিচ্ছে।
মনে মনে বললাম, এইভাবে চললে অচিরেই আমরা জনসংখ্যায় চিনকে ছাড়িয়ে যাব।
*
বেশ ভালোই ছিলাম আমি চাকরির প্রথম জীবনে। সারাদিন এই সব লোকের সঙ্গে মিশে, তাদের ঘরকন্নার গল্প শুনে, সপ্তাহে দুই দিন সালালপুরের হাটে বেড়িয়ে সময় কাটছিল নিরুপদ্রবে। আর চারদিকে ছিল অঢেল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। মাস বদলের সাথে তার রুপ পাল্টায়। কখনও সারা মাঠ ভরে যায় সবুজ ধানে, কখনওবা সর্ষেফুল হলুদ গালিচা বিছিয়ে দেয় সারা মাঠ জুড়ে। আবার কখনও মেঘ ঢেকে দেয় সমস্ত আকাশ, ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে। আবার গরমের দিনে মাঠ পেরিয়ে হাওয়া এসে ধাক্কা খায় আমার ঘরের দেওয়ালে। তার সাথে ভেসে আসে মাস্টার মশাই নীলমনি বাবুর মন জুড়ানো শ্যামা সঙ্গীতের ঘেউ। চাঁদনী রাতে কোনও দিন আমি আমার ফোল্ডিং খাটিয়া বাইরে নিয়ে ফাঁকা মাঠের মধ্যে পেতে আকাশের চাঁদ দেখি। আবছা ভাবে শুনি রাস্তা দিয়ে হেটে যাওয়া বাজার থেকে বাড়ি ফিরতি গ্রামের লোকজনের কথাবার্তা। একরকম চিন্তাহীন, উদ্যেগহীন, উচ্চাকাঙ্ক্ষাহীন ভালোলাগা জীবন কাটছিল।
আর এর সাথে মিশে গিয়েছিল আমার আর এক গ্রাম্য জীবন। গ্রামের মানুষ আমাকে তাদের একজন করে নিয়েছিল। তাই প্রায়ই আমি রাত্রে চলে যেতাম পাল বাবুর তাসের আখড়ায়। পালবাবু একজন স্বাস্থ্যকর্মী ছিলেন। বিয়ে করেননি। এই গ্রামে এসে পড়েন। তাকে গ্রামের লোকজন একটি ঘর দিয়ে দেয় থাকবার জন্যে। পালবাবু নিয়ে এত কথা আছে, অন্য কোনও লেখায় তা বলব।
সেই পালবাবুর আখড়ায় সন্ধ্যা সাতটার পর রোজ তাসের আসর বসতো। ব্রিজ খেলা। আমিও মাঝে মাঝেই সন্ধ্যার পরে চলে যেতাম সেখানে। অন্ধকারে সাপের ভয় আছে, তাই আমি আমার চাইনিজ ইমারজেন্সি লাইট হাতে ঝুলিয়ে মাঠ পেরিয়ে চলে যেতাম গুটি গুটি পায়ে। ওখানে আসতো গ্রামের অনেক গন্যমান্য বয়স্ক লোকরা। সেখানে তাস খেলে রাতে ঘরে এসে খেয়েদেয়ে সেদিনের মত দিন শেষ হত।
এমন একদিন রাত আটটা নাগাদ তাস হাতে নিয়ে আমি সবে ডাক দিয়ছি – ‘টু স্পেড’। অমনি মনে হল নাকের মধ্যে সুড়সুড় করছে। যেন সর্দি বেরিয়ে আসতে চাইছে। রুমাল দিয়ে মুছে দেখি রক্ত! প্রথম বার কিছু বলিনি বা বুঝতে দিই নি। দ্বিতীয় বারেও না। তৃতীয় বার মনে হল, না -এবার বলা দরকার। তারপর সবাই দেখে এবং শুনে আমাকে বলল বিশ্রাম নিতে। পালবাবু এবং ছোটবাবু আমাকে কোয়াটার পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেলেন।
ঘরে এসে আমার দুশ্চিন্তা শুরু হল। তাইতো! নাক দিয়ে রক্ত বের হলো কেন? আমার কোন প্রেসার নেই, জ্বর নেই, সর্দি নেই – তাও কেন রক্ত বের হলো? তবে কি?? জানি প্লেটলেট কমে গেলে অকারণে নাক দিয়ে রক্ত বের হতে পারে। আর এর একটি কারণ রক্তের ক্যান্সার। তবে কি! না বাড়ি গিয়ে আগে রক্ত পরীক্ষা করতে হবে।
আসলে আমরা ডাক্তাররা, আগে সবচেয়ে খারাপ সম্ভাবনা ভেবে নিই। মেডিকেলে পড়ার সময় একবার শ্রদ্বেয় শিক্ষক শীতল ঘোষ বলেছিলেন, ‘একমাত্র প্রেগনান্সি ছাড়া প্রতিটি ডাক্তারি ছাত্রদের সব রোগই একবার করে হয়।’
বাড়িতে এসে পরীক্ষা-নিরীক্ষা, বিশ্রাম নিয়ে দিন সাতেক কেটে গেল। আমি হাসপাতাল মুখো হইনি। যথারীতি আমার অনুপস্থিতি, তার কারণ সবকিছু গ্রামে রটে গেছে। আমি যেদিন প্রথম গেলাম, সে খবরও প্রচার হতে দেরি হল না।
জয়েন করার একদিন পর আউটডোর শেষ করে আমি আর কম্পাউন্ডার ঘরে ফিরছি। দেখি মহিউদ্দিনের বিবি আর তার দুই মেয়ে এদিকেই আসছে।
কম্পাউন্ভার বললেন, ‘নেন, আপনার খদ্দের আসছে। আপনি বলে দেবেন কালকে আসতে। আমি আবার ওদের জন্যে এত তালা খুলতে পারব না।’
তবু আমি ওদের দেখে দাঁড়িয়ে গেলাম। দেখি কি বলে!
ওরা এগিয়ে এলো।
কম্পাউন্ভার বললেন, ‘আজ এত দেরি করলে কেন? হাসপাতাল বন্ধ হয়ে গেছে। কাল এসো’।
ফিরোজা বিবির হাতে একটা থলে। তিনি বললেন, ‘আমি আজ ওষুধ নিতে আসি নাই। এসেছি ডাক্তার বাবুর কাছে’।
কম্পাউন্ভার বললেন, ‘কেন?’
তিনি সে কথার গুরুত্ব না দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বাপ, তোমার নাকি শরীল খারাপ?’
‘কে বললো?’
‘না, শুনলাম তোমার নাকি নাক দিয়ে রক্ত বেরোইচে’
‘ঠিক শুনেছ’। কেউ কুশল সংবাদ নিলে তারও নিতে হয়। আমি বললাম, ‘তুমি ভালো আছ? তোমার ছোট বাচ্চা ভালো আছে?
‘হা বাপ, ওরা সব ভালো আছে এখন’
তাহলে আসার উদ্দেশ্য কি? বললাম, ‘বলো, কি দরকারে এসেছ?
তিনি কিছু না বলে তার ঝোলা থেকে বের করলেন একটা কাপড়ের পুঁটুলি। আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘বাপ, তোমার শরীর খারাপ শুনে এনেছি, এটা তুমি খাবে’।
কম্পাউন্ডার বাবু এতক্ষন উসখুস করছিলেন। এবার আর কৌতুহল দমন করতে না পেরে বললেন, ‘কী আছে এতে’
তিনি বললেন, ‘কি আর দেব বাবু, গরিব মানুষ। বাড়ির কয়েকটি মুরগির ডিম আছে’ ।
তারপর আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘এইটা তুমি খাবে বাপ। অসুস্থ মানুষ।’
আমার একটু ভালো লাগলেও মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। বললাম, ‘তোমার এক গাদা ছেলে মেয়ে – ঠিকঠাক খেতে পায় না। তাদের খাওয়াও, তাদের পুষ্টি দরকার। সব গুলোইতো রোগা। তাদের ভাল খাবার দরকার’।
তিনি বললেন, ‘ওরাতো খায়। তুমিওতো আমার ছাওয়াল। এইটা তোমাকে নিতে হবে। না নিলে আমি তোমার ঘরের সামনে রেখে যাব’।
একদমই নাছোড়বান্দা ভদ্রমহিলা।
কম্পাউন্ডার এবার আমার তালে সঙ্গত দিল। ‘তোমার অভাবের সংসার। বেচলেও দুটি পয়সা পাবে’।
আমিও সেই কথার খেই ধরে বললাম, ‘সত্যিই তো! আর যদি একান্তই আমাকে দিতে চাও, আমি পয়সা দেব। দাম দিয়ে কিনে নেব।’
ফিরোজা বিবি কাতর কন্ঠে বললেন, ‘বাপ, তোমার জন্য আনবো বলে দুই দিন জমিয়ে রেখেছি। আমার ছাওয়াল মেয়ে তো খায়। তুমি ও তো আমার ছাওয়াল। তোমাকে এটা খেতে হবে বাপ! আর ছাওয়ালকে কিছু দিলে পয়সা নেওয়া যায়! ‘
বলে কাপড়ের পোটলাটি আমার দিকে বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
না। এরপর আর কথা চলে না। এক পৌঢ়া আমার অসুস্থতার খবর পেয়ে সন্তান মনে করে তার নিজের সন্তানদের বঞ্চিত করে আমার জন্য ডিম নিয়ে এসেছেন। তাকে ফিরিয়ে দেব, অতটা শক্তি আমার নেই।
ইতস্তত করে আমি ডিমের পোটলাটি হাতে নিলাম। ফিরোজা বিবির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আসি বাপ?’
আমি বললাম ‘এরপর আর এনো না। আনলে কিন্তু পয়সা নিতে হবে ‘।
ফিরোজা বিবি তার মেয়ের হাত ধরে বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। একটু এগোলেই তাদের সাথে যোগ দিল মহিউদ্দিন।
সে এতক্ষন বিল্ডিংয়ের অন্য দিকে গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে ছিল।
কম্পাউন্ডার বলল, ‘চলুন, আপনার দুদিনের বাজার হয়ে গেল ‘
মনে মনে বললাম, শুধু বাজার নয়, আরও অনেক কিছুই এই পোঁটলার মধ্যে আছে।
–০–