সেদিন চেম্বারের বাইরে তুমুল চিৎকার… একটি মেয়েকে প্রায় বেঁধে আনতে হয়েছে… চার/পাঁচজন মিলে প্রায় ধরে রাখা যায় না… মারছে, অনর্গল বকছে, চিৎকার করছে – সাধারণ ভাষায় “পাগলামি” বলতে যা বোঝায় তার সবটাই সে করছে… বাকি সব রুগী ছেড়ে সবাই তাকে নিয়েই পড়েছে! মেয়েটির বয়স উনিশ, মেয়েটির নাম ধরা যাক পপি! (নাম পরিবর্তিত )
আগে ভিতরে প্রবেশ করলেন মেয়ের বাবা, তাঁর বক্তব্য, “ম্যাডাম এই মেয়েকে কোনো হোম-এ বা কোথাও রেখে আসা যায়? আমি আর পারছি না। “
উনি আসলে চিকিৎসা করে আর পারছেন না, উনি আসলে “পাগল” মেয়েকে সামলাতে আর পারছেন না!
বললাম, “এখুনি এতো হাল ছেড়ে দেবেন? চিকিৎসার জন্য আপনি কিছুদিনের জন্য কোথাও ভর্তি করতে পারেন, সে ব্যবস্থা আছে, সরকারি -বেসরকারি… কিন্তু তাই বলে আপনি যেভাবে রেখে আসতে চাইছেন, সেটা কি ঠিক হবে? এই বয়েসের একটা মেয়েকে আপনি এভাবে ভাসিয়ে দেবেন?”
এভাবে কিছুক্ষণ বোঝাতে বোঝাতে যেটুকু জানতে পারলাম মেয়েটির মা নেই, বাবা-র আরেকটা সংসার আছে, ভদ্রলোক আগের পক্ষের দুটি মেয়ে আর নতুন সংসার নিয়ে পেরে উঠছেন না… মেয়েটি ওষুধ খেতে চায় না একদমই… “আগেও এমন হয়েছে, কিন্তু ওষুধ যে ও কিছুতেই খেতে চায়না, আমি কাজে চলে যাই, পাড়ার লোক বাড়ি এসে নালিশ করছে…”
ওঁনাকেও দোষ দিই না… দোষ ঠিক কাউকেই দেওয়া যায় না…আসলে জীবনের গল্প একটু একটু করে খোলস ছাড়িয়ে শুনতে শুরু করলে, দোষ বোধহয় কাউকেই দেয়া যায় না…!
মেয়েটি এলো… কথা বললো… অনেক কথা বললো… অনর্গল কথা বললো… অসংলগ্ন কথা বললো….
মেয়ের বাবা-কে বোঝালাম, “একমাস মতন সময় দিন… একটু injection ওষুধ সব মিলিয়ে চেষ্টা করে দেখি… আপনারই তো মেয়ে! এভাবে ছেড়ে দেবেন?!”দু-সপ্তাহ পরে আসতে বলেছিলাম…!
আমাদের সবাইকেই অবাক করে দিয়ে সেদিন সবার আগে মেয়েটি এসে বসে ছিলো চেম্বারে… ওর বাবা এসেছে পরে… ওই চিৎকার, হাত-পা ছোড়াছুড়ি, মারামারি সব শান্ত… এবারও অনেক অসংলগ্ন কথা বললো, কিন্তু ওষুধ খেতে বললে বলেছে, “ওষুধ খাইছি তো, ওষুধ তো আমি খাই…”
এখন পপি নিয়মিত আসে, একাই আসে বা ছোটো বোনকে নিয়ে আসে…. এখন কিন্তু ও শান্ত হয়ে বসে, অসংলগ্ন কথা বলে না, গুছিয়েই কথা বলে… ওকে আমি ওষুধের গুরুত্ব বোঝাই… কিভাবে জীবনটা এলোমেলো হয়ে যেতে পারতো, কিভাবে জীবনটা এলোমেলো হয়ে যেতে পারে…. জীবনে manic episode ঝড়ের মতন আসে… আবার জীবন ছন্দেও ফিরতে পারে… কিন্তু আমরা মানসিক অসুখের ক্ষেত্রে বড়ো তাড়াতাড়ি হাল ছেড়ে দেই….!
সেদিন ওর বাবা ওকে পরিত্যাগ করতে চেয়েছিলেন, এখন সুস্থ হয়ে যাওয়ার পরে ওর বাবাকে আর সাথে আসতে দেখি না…. তাই জিজ্ঞেস করে উঠতে পারিনি, “এই মেয়েকেই কি আপনি পাগল বলে সেদিন পরিত্যাগ করতে চেয়েছিলেন? আজকে কি মনে হয়?” — হয়তো ভবিষৎ-এ কোনোদিন সেই সুযোগ পাবো… যদি মেয়েটা আরেকটু ভালো থাকে, যদি নিজের পায়ে দাঁড়ায়… আমার যে রুগীর যেটুকু capacity তাকে আমি সেটুকু নিয়েই নিজের পায়ে দাঁড়াতে বলি…. কেউ বাড়ির বাজারটা করলে সেটাও প্রাপ্তি, কেউ সুন্দর করে নিজের বাচ্চা-কে মানুষ করছে সেও তো সাফল্য, আবার কেউ ভালো রেজাল্ট করছে, রোজগার করছে – সেটাও খুশির খবর – সবাই চেষ্টা করছে, progress করছে…!
এই লেখাটা আসলে অন্য কোনো পপি-র বাবার জন্য…. ছেলেটা বা মেয়েটার হাত ছাড়ার আগে, আরেকবার চেষ্টা করবেন প্লিজ?