মনোরোগের চিকিৎসা একটা দুই-তরফা ব্যাপার। কখন যে আমি রুগীর ক্ষতে প্রলেপ দিয়ে দিচ্ছি, কখন যে রুগী আমার কোনো পুরোনো ক্ষতে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন, এ বোঝা বড়ো মুশকিল। হ্যাঁ, সবসময়েই যে ক্ষতে প্রলেপ দেয়াই হয় তেমন নয়, অনেক ক্ষতে আঘাত-ও লাগে, আবার রুগীর থেরাপির সাথে সাথে নিজের থেরাপি-ও হয়ে যায়…! যাক গে… আজকের গল্পটা ঠিক গল্প নয়, একজন রুগীকে দেখতে গিয়েই অনেক ভাবনা মাথার ভিতর দিয়ে বয়ে গেলো, ভাবলাম লিখে ফেলি!
রুগীর বয়স মনে করুন আঠাশ, মহিলা, বিবাহের বয়স ওই ধরুন কয়েকটা মাস… দেখাতে এসেছিলেন কিছু শারীরিক সমস্যা নিয়ে, যেমন শ্বাসকষ্ট,, বুকে ব্যাথা, পেটে ব্যাথা – যেসব সমস্যার কোনো “শারীরিক” কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি, তাই সব জায়গা ঘুরে psychiatrist-এর কাছে আসা… এসব ক্ষেত্রে যেটা হয় যে মনের ভিতরের কোনো অবদমিত উদ্বেগ বিভিন্ন শারীরিক উপসর্গ হিসেবে ধরা দেয়… সেটাই হয়েছিল। কিন্তু উদ্বেগের কারণ কি? Stressor টা কি? সেটা খুঁজে বের করাই তো চিকিৎসা।
বিবাহ নিয়ে প্রশ্ন করতে হবে, কারণ জীবনে সদ্য ঘটে যাওয়া যেকোনো পরিবর্তন একটা stressor! তাই জিজ্ঞেস করলাম যে কোথায় বিয়ে, কিভাবে বিয়ে, বিয়ের পরে কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা… ইত্যাদি! মেয়েটি কিঞ্চিৎ hesitate করলো… সেটাই স্বাভাবিক… প্রেম করে করা সাধের বিয়ে, পছন্দের বর, পছন্দের ঘর, সেটাও কি মানুষের উদ্বেগের কারণ হতে পারে? হ্যাঁ, বিশ্বাস করুন হতেই পারে – এক লহমায় আপনার ঘর, বাড়ি, নাম, সাজ-পোষাক, রুটিন পাল্টে গেলে একটা “adjustment disorder ” হতেই পারে। এবার মেয়েটি একটু খুলে বললো, আসলে যেখানে এখন উনি থাকেন সেটা একটা ছোটো শহর, নতুন বউ- এর উপর পাড়া-প্রতিবেশীর পর্যন্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, সবসময়েই একটা বিশেষ ধরণের পোষাক পরে থাকা, যদিও মেয়েটি চাকুরীরতা, তারপরেও কিছুটা তো অসুবিধে হচ্ছেই, যদিও এটুকুই ওর সমস্যার কারণ বলে ওর ঠিক মনে হচ্ছে না!
এরপর যা হয়, ওষুধ দিলাম, অনেক বকবক করলাম, পরের ভিসিট-এ সে অনেক ভালো আছে… শুধু ওর বর বললো, মাঝেমাঝে হঠাৎ করে mood off হয়ে যায়, আর বলে যে ওর নাকি “identity crisis” হচ্ছে… এই ব্যাপারটা আমি ঠিক বুঝতে পারিনা!
আসলেই তো বুঝতে পারার কথাও না… বিয়ের পরে যে হঠাৎ ঝড়ের মতন পরিবর্তনগুলো হয় সেটা যুগে যুগে হয়ে আসছে, সবাই সুন্দর মানিয়ে নিচ্ছে, তার মধ্যে এই “identity crisis” টা একজন ছেলে কি করে বুঝবে যে বিয়ের পরের দিন নিজের বাড়িতে দিব্যি হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি পরে ঘুরতে পারে?! এর মানে কিন্তু এটা নয় যে ছেলেদের “adjustment ” এর সমস্যা হয় না, জীবন ছেলেদেরও পাল্টায়, হয়তো আগের মতন বন্ধুদের সাথে আড্ডাটা হয় না, দায়িত্ব বেড়ে যায়, কিন্তু আর যাই হোক “মিষ্টি লাগছে” বলে বিয়ের পরে থেকে বেশ কিছুদিন নতুন বর শুধু ধুতি আর পাঞ্জাবী পরে ঘুরবেন এটা কেউ আশা করে না, অথচ পাঞ্জাবী-তে ছেলেদের কি কিছু কম মিষ্টি লাগে বলুন??…. আর তাই ‘idenity crisis ‘ ব্যাপারটা হয়তো ছেলেদের পক্ষে বোঝা একটু মুশকিল….
কিন্তু psychiatrist বোঝেন…. দুম করে মনে পড়ে যায়, বিয়ের পরের দিনগুলো….
আসলে বোঝানো খুব মুশকিল… ভালো বর, ভালো ঘর, কিন্তু তারপরেও বৌভাতের দিন সকালে হলুদ শাড়ি, গয়না, কপালে লাল-টিপ পরা আমাকে দেখে ভাই যখন হটাৎ বলল, “একি রে দিদি, তোকে তো চেনাই যাচ্ছে না!”, আমার বাবার চোখেও সেই একই বিস্ময়, মাকে বলেছিলো,”মেয়েটা একদিনে বড়ো হয়ে গেলো!” – সেই তখন কেমন যেনো মনে হয় হারিয়ে যাচ্ছি আমি…. তারপরে যতবার, যতো মানুষ এসে বলতে লাগলো, “তোকে কিন্তু বেশ অন্যরকম লাগছে, এই সাজটায় খুব মিষ্টি লাগছে” – ততো যেনো ওই ‘identity crisis’ আমায় কাবু করে ফেলতে লাগলো…. মনে হতো, সুন্দর লাগছে বুঝি? কিন্তু এটাতো আমি নই?! তারপরে বহুদিন আয়নার দিকে তাকিয়ে থেকেছি আমি……!
যাই হোক, তো বিষয়টা হলো adjustment disorder টা হয়, অনেকসময় বেশি মাত্রায়ই হয়… আসলে যে মেয়েটা জিন্স আর t-shirt এ গোটা শহর দাপিয়ে বেড়ায়, নিজের সব কাজ নিজেই করে, দায়িত্ব নেয়, সন্ধ্যেবেলা কফি খায়, বন্ধুদের সাথে বেড়ায় – সেই মেয়েটাকে যখন হঠাৎ একটা অন্য শহরে “নতুন বউ” এর ভূমিকায় অভিনয় করতে হয়, তখন সমস্যা হতেই পারে…. আবার হয়তো নিজেকে ফিরে পেতে শুরু করলে ধীরে ধীরে সব ঠিকও হয়ে যায়… হ্যা, কেউ কেউ নিজেকে ফিরে পায়, কেউ কেউ নতুন রূপে নিজেকে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে যায়… কিন্তু সমস্যা যে হয়, সেটা বোঝা এবং বোঝানো আসলে খুব কঠিন!