একজন আশি বছর বয়সের বৃদ্ধার চোখ দেখেছিলাম; রাত প্রায় নটায় বাড়ী ফিরবেন কি করে, জানতে চাওয়ায় বলেছিলেন, ছেলে নাতি সবই আছে, কেউ সঙ্গে আসে না। এই বৃদ্ধার দুরবস্থার কথা “বৃদ্ধাশ্রম” নিবন্ধটিতে লিখেছিলাম। বিষয় বিষের এ জ্বালার কথা, পেশাদারি নির্লিপ্ততা দিয়ে সহজেই এড়িয়ে যেতে পারতাম। পারিনি।
সপ্তাহে একদিন জেনারেল ইমার্জেন্সির চেয়ারে বসে অন্তত গোটা দশেক থ্যালাসেমিয়া বাচ্চার ভর্তির টিকিটে সই করতে হয়। বাচ্চাদের সাথে, নাম কি? বা
স্কুলে যাচ্ছিস? কোন ক্লাশে পড়ছিস? এরকম দু একটা কথা বললেও ; ওদের মায়েদের মুখের দিকে তাকাতে পারি না। কী ভয়ানক মানসিক সংগ্রাম এ সামান্যা নারীর ভেতর চলছে! ভাবতে গেলে পেশাদারি দক্ষতা ব্যাহত হয়।
অনেক মাতাল, নেশাখোরই তো চিকিৎসার জন্য আসে। সত্যি বলতে কি, এই প্রৌঢ় বয়সে আর ওদের নিয়ে ভাবার মত কোন উৎসাহই নেই। কিন্তু আজ যখন বোরখার ঢাকনা খোলা বছর পঁচিশ বয়সের বৌটি মরিয়া হয়ে সাহায্য করতে বলল, তখন নিজের ক্ষুদ্র ক্ষমতার জন্য গর্বিত না হয়ে অসহায় বোধ করছিলাম।
সরু গলির ভেতর চশমার দোকানে এসে সকলে নাম লিখিয়ে অপেক্ষা করে। কুড়ি পঁচিশ ফুট ভেতরে অন্য একটা ঘরে বসে চোখ দেখি। চেম্বারের ভেতর রুগীর বসার গোল স্টিলের টুল ছাড়া গোটা দুই সাধারন চেয়ার আছে। দরজা দিয়ে রুগী ঢুকলেই গোল টুলটা দেখিয়ে বসতে বলি। আর সাথের বাড়ির লোককে দরজার পাশের চেয়ার দেখিয়ে বসতে ইঙ্গিত করি। এক, দুজন বাড়ির লোক আসে সাধারণত। স্লাইডিং দরজাটা বন্ধ না করলে চোখের দৃষ্টি পরীক্ষার চার্টটি দেখা যায়না। তাই প্রতিবারই উঠে দরজাটা টেনে বন্ধ করতে হয়। অনেক সময় দুজন রুগী বা বেশী বাড়ির লোক থাকলে বাইরে দাঁড়াতে বলতে হয়। মাঝে মাঝেই দোকানে বসার জায়গা না পেলে পরের রুগী আর বাড়ির লোকজন এসে দরজার বাইরে ভিড় জমায়।
আজ সন্ধ্যায় দোকানে বসার মত জায়গা পাওয়া যাবে না, এমন ভিড় ছিল না। তবুও এই বৌটি মরিয়া হয়েই অন্য এক মহিলার সাথে এসে চেম্বারে ঢুকেছিল। সামনের মহিলাকে গোল টুলে বসতে বলে, একে চেয়ারে বসার জন্য দেখালেও, বসতে চাইল না। কেমন যেন অস্থির ভাবে একবার দরজার বাইরে উঁকি দিয়েই, আমাকে হিন্দী বা উর্দূতে যা বলল, তার অর্থ দাঁড়ায়, ওর স্বামী এরপর
চোখ দেখাতে ঢুকবে। লোকটি মদ খায়। আমি যেন মদ খেতে বারন করে দিই। মনে ভাবলাম, হায়রে দুরাশা; একটা চোখের ডাক্তার একবার বললেই যদি কেউ মদের নেশা ছেড়ে দিত, তাহলে তো দেশে একটাও মাতাল থাকত না! আমার বাংলা টানের হিন্দীতে ওকে কথাটা বললামও। তবুও ও মরিয়া হয়ে আর একবার অনুরোধ করল। টুলে বসা মহিলাও বলল, ” ডাক্তার বললে শুনবে”। বৌটির বেশি সময় চেম্বারে দাঁড়িয়ে থাকার সাহস ছিল না। সমস্ত বক্তব্য কুড়ি পঁচিশ সেকেণ্ডে শেষ করেই দরজার বাইরে দাঁড়াল। এর মধ্যেই বুঝেছিলাম, টুলে বসা মহিলা একাই এসেছেন, বৌটি এর বাড়ীর লোক নয়।
কিন্তু এই মহিলাও যে বললেন,” ডাক্তার বললে শুনবে”! এই চরম সামাজিক অবক্ষয়ের দিনেও, যতো ব্যাতিক্রমীই হোক, কেউ কেউ যে আমার পেশার উপর এতোটা ভরসা রাখছে; এটা ভাবলে তো আত্মশ্লাঘাই বেড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু নিজের সীমাবদ্ধতা আমার থেকে ভালো তো আর কেউ জানে না।
সামগ্রিক অবক্ষয়ের যুগে দাঁড়িয়ে থেকেও আজও প্রতি মুহূর্তে অসহায় মুখে লেগে থাকা বিশ্বাসের চাহনি নিজের চেয়ারের মূল্য বাড়িয়ে দেয়। শিক্ষিত- অশিক্ষিত, ধনী- খেটে খাওয়া গরীব,,, সবার চোখের অসহায়তার মধ্যে ভরসার লেশটুকুই আমাদের পারিশ্রমিক। জানি, অবিশ্বাস আজ অবিশ্বাস্যভাবে আমাদের সবাইকে গ্রাস করেছে। কিন্তু তাও ভরসার ভাসা ভাসা রেশটুকু নিয়েই বাঁচতে ভালোবাসি।
সত্যি কি অসহায় এরা