মন নিয়ে কথকতা
(লেখাটি মাসখানেক আগের, একটি ঘটনাক্রমের প্রেক্ষিতে যেতে হয়েছিল একটি স্কুলে, এক বিজ্ঞান সচেতনতা শিবিরে। বলা যেতে পারে, কিছুটা ভূতের ওঝা হয়ে ভূত তাড়াতে! সেই প্রসঙ্গে লেখা, সেই সময়কার, তবে বিষয়টা সবসময়ের। পড়ুন, মনে ধরলে পড়ান!!)
সিনেমায় যদিও অন্য রকম, কিন্তু আসলে ভূতের কোনো “ভবিষ্যত” নেই। চরিত্রও নেই, আকারও নেই, অস্তিত্ব শুধু মানুষের মনে, আমাদের কল্পনায়।
“ধান ভানতে শিবের গীত” শুরু করতে চাইছি আসলে একদল সদ্য “ভূতাক্রান্ত” ছাত্রীদের ভূত ছাড়ানোর জন্য। শোনা যাচ্ছে এদের ভূত ঝাড়তে বিভিন্ন ওঝাদের দল যথেষ্ট সক্রিয়, কিন্তু লাভের লাভ কিছু হচ্ছে না। “মনের ভূত” -কে তাড়ানো তো চাট্টিখানি কথা নয়।
এইবারে দেখা যাক, জলপাইগুড়ির একটি স্কুলে (বিবেকানন্দ হাইস্কুল, কোনপাকরি) হঠাৎ করে উদয় হয়ে ভূতগুলো করছেটা কি? এরা সব ছাত্রীদের অনেকের ঘাড়ে চেপে তাদের দিয়ে অদ্ভুত অদ্ভুত কাজ করাচ্ছে (ছাত্রদের কাউকে ধরেছে বলে এখনো খবর নেই)। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের আঁচড়ে বা গলা টিপে ধরেছে বলেও শোনা গেছে। একজন ছাত্রীর বয়ানে জানা যাচ্ছে যে, এই সময় তাদের কাজকর্মের, আচার-আচরণের নিয়ন্ত্রণ তারা নিজেরা করতে পারছে না।
এটাই আসলে “মূল বিষয়”। একজন মানুষ তার “শরীর” আর “মন” মিলিয়েই সম্পূর্ণ মানুষ। এরমধ্যে শরীরের অস্তিত্ব তার আকার, বিস্তার নিয়ে একেবারে ত্রিমাত্রিক। শরীরের কাজকর্ম নিয়ন্ত্রিত হয় কিছুটা স্বয়ংক্রিয় ভাবে, আবার কিছুটা তার মনের ইচ্ছায়। উদাহরণ দিয়ে বোঝালে সুবিধা হবে। যেমন, আমাদের হৃদযন্ত্র চলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে, একদম প্রায় পুরোটাই, চলতেই থাকে। আবার শ্বাসযন্ত্র চলে আধা-স্বয়ংক্রিয়ভাবে, ইচ্ছা করলে বন্ধ করা যায়, গতি বাড়ানো-কমানো যায়। কিন্তু একদম বন্ধ করে দেওয়া যায় না, বাইরের কোনো সাহায্য ছাড়া। অন্যদিকে, ধরা যেতে পারে আমাদের হাঁটাচলা, খাওয়া-দাওয়া, দৌড়ানো, বা আঁচড়ানো, এইসব নানাকিছু মানুষের ইচ্ছের অধীন। “ইচ্ছা” একটা মানসিক বিষয়। আমরা নানারকম বোধ যেমন, ভয়, দুঃখ, আনন্দ, হিংসা, রাগ ইত্যাদি ইত্যাদির প্রভাবে যেসব ব্যবহার করে থাকি, সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করে মন, তারও আবার মূল শারীরবৃত্তিয় নিয়ন্ত্রণ থাকে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশে।
আলোচনাটা একটু জটিল হচ্ছে, তবু “ভূতে পাওয়ার” সমস্যাটা বুঝতে এই শরীর ও মনের যৌথ আচরণ, যা নির্দিষ্ট শারীরবিজ্ঞানের নিয়ম মেনে চলে, সেটা একটু বোঝার দরকার আছে। শরীর আর মন পরস্পর সংশ্লিষ্টভাবে ভাবে কাজ করে বলে, সাধারণ সামাজিক কাঠামোর বোধগম্য ব্যবহার আমরা করে থাকি। কিন্তু কোনো আকস্মিক অভিঘাতে, কল্পনা বা বিশ্বাস নির্ভর মন, শারীরিক ব্যবহারে এমন অদ্ভুত কিছু করতে থাকে যা সাধারণভাবে বোধগম্য হয়না। এই ভাবেই আসে “ডিসোসিয়েটিভ স্টেট” যেখানে দেহ – মনের সংশ্লিষ্ট (এসোসিয়েটেড) প্রকাশভঙ্গি যায় পাল্টে। ডিসোসিয়েটিভ অবস্থার প্রকাশভঙ্গি কখনো পাল্টে হয় “পসেশন স্টেট”, গোদা বাংলায় “ভর ওঠা”, যা আমাদের সামাজিক জীবনে একধরনের প্রচলিত বিষয়। এখানে ভূত নয়, শরীরে এসে যুক্ত হয় “ভগবান”। সেই সূত্রে মানুষটি কল্পনায় নিজেকে ভগবানই ভাবতে থাকে, সেইমত ব্যবহার করে। এই আচরণ গুলি কিন্তু মানুষটির “ইচ্ছাকৃত” আচরণ নয়। শোনা যায়, এই বিদ্যালয়েরই এক ছাত্রীর কিছুদিন আগে এই ধরনের “ভর” উঠেছিল। প্রাথমিকভাবে পুজো ইত্যাদি হলেও মনোচিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, চিকিৎসায় সুস্থ ছিল, কিন্তু অনিয়মিত চিকিৎসার কারণে আবারো বুঝি কিছু সমস্যায়।
এইখানে প্রয়োজন “ডিসোসিয়েটিভ ডিসঅর্ডার” বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিবরণ যাতে বলা হয়েছে,
এই অবস্থায় সম্পূর্ণ বা অংশত লোপ পেতে পারে,
১) অতীতের স্মৃতির সঙ্গে বর্তমান সময়ের সমন্বয়।
২) নিজস্ব ব্যাক্তিত্বের ধারণা।
৩) তাৎক্ষণিক অনুভূতি।
৪) দেহের বিভিন্ন অংশের নড়াচড়ার উপর নিয়ন্ত্রণ।
এই সচেতন ও নির্দিষ্ট ধরনের নিয়ন্ত্রণ কতটা লোপ পাবে, কত সময় ধরে লোপ পাবে তার মধ্যে বৈচিত্র ও ভিন্নতা থাকে। এমনকী এটা নির্ধারণ করাও সময়ে একটু মুস্কিল হয় যে কতটা ইচ্ছার অধীনে আচরণ হচ্ছে, আর কতটা তার বাইরে। এই ধরনের আচরণকে আগে “হিস্টিরিয়া” বলা হলেও এখন সেটা আর ব্যবহার হয়না, বিজ্ঞানসম্মত ভাবে। তবে “চালু কথা” হিসেবে ব্যবহার হয়।
সাধারণভাবে এই ধরনের আচরনগত সমস্যার ক্ষেত্রে বড় মানসিক (বা শারীরিক বা সামাজিক) আঘাতের, যা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে, সমাধান করা যাচ্ছে না, তার একটা যোগসূত্র থাকে। সম্পর্কের টানাপোড়েনও থাকতে পারে। কোনোভাবে আঘাত বা চাপকে মোকাবিলা করবার অক্ষমতা থেকে সমস্যার সূত্রপাত হওয়ার সম্ভাবনা সাধারণত প্রবল হয়।
এই স্কুলের ক্ষেত্রে দেওয়ালে একটি “হাতের ছাপ” দেখে অনেকে ভয় পেয়েছিল বলে শোনা যাচ্ছে, আর সেটাকেই কল্পনার আলোতে অনেক কিছু ভেবে নিয়ে মানসিক চাপ আরো বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল বলে ধারনা করা হচ্ছে। এটা একটা সম্ভাব্যতা। (যদিও “অশরীরী”দের শরীর থাকেনা, হাতের ছাপ কিভাবে আসবে, সেটা কেউ একটু ভেবে দেখলো না!!)
এখানে সমস্যাটির বিশেষত্ব হচ্ছে এর “গণ” চরিত্র। উপরের যে আলোচনা সেটা মূলত: কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তির আচরণের সমস্যা। কিন্তু, অনেকের মধ্যে একই ধরনের আচরণ সংক্রামিত হতে পারে, এমন ঘটনা গোটা পৃথিবীতে বহু নথিভুক্ত আছে। এই “গণ” চরিত্র শুধু আচরনগত সমস্যা নয়, আপাতভাবে শারীরিক সমস্যার ক্ষেত্রেও দেখা গেছে। জাপানের একটি স্কুলে হঠাৎ করে প্রায় ৪০০ এর বেশী ছাত্রছাত্রী বমি ও পেটে ব্যাথার সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। পরে নানারকম পরীক্ষায় তাদের এই সমস্যার শারীরিক ভিত্তি সেরকম কিছু খুঁজে পাওয়া যায়নি। একইরকম আরো অনেক জায়গায় হয়েছে, বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই স্কুল বা কলেজের ছাত্রছাত্রীদের যারা একধরনের পাঠক্রম, নিয়মাবলীর মধ্যে দিয়ে চলে তাদের মধ্যে এরকম আচরনগত সংক্রমণ হয়ে থাকে।
এবারে শেষ করা যাক, বিজ্ঞানের কথায়। আসলে ভূত বা ভগবান, যাই হোক না কেন, তার অস্তিত্বে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস, তার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া, সবটাই লুকিয়ে আছে মস্তিষ্কের কার্যপ্রণালীর মধ্যে। আমাদের যত আবেগ, আচরণ কিম্বা বিশ্বাসের সাথে প্রকৃতির মেলবন্ধনে যেসব ভাল লাগা, মন্দ লাগা, সবকিছুর চাবিকাঠি এখানেই। এর বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন স্নায়ু রাসায়নিকের চলাচল, আদানপ্রদানের সূত্রেই আমরা কলকল করে হাসি বা গলা ছেড়ে কেঁদে ভাসাই, রেগে উঠি, গুম হয়ে থাকি বা তেড়ে মারতে যাই। স্বাভাবিক আচরণ যেমন এখানকার নির্দেশে হয়, অস্বাভাবিক আচরণও তাই। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে সেইসব আদানপ্রদান কিছু বেনিয়মের পথে চলে, যেরকম সাধারণভাবে হওয়ার কথা তারচাইতে কিছু ব্যাকাত্যাড়া ভাবে লক্ষ্যবস্তুর সঙ্গে যুক্ত হয় (রিসেপটর বাইন্ডিং)। এইসমস্ত ভাবসাব যে আমরা সবটাই এখনই নির্দিষ্ট করে চিহ্নিত করতে পেরেছি, এমন নয়। তবে জোরদার গবেষণায় আমাদের চেতনার স্তর উন্মোচনের বিষয়ে অনেকটা কাজ হয়েছে, আর বিভিন্ন ধরনের আচরনগত সমস্যার ক্ষেত্রে বিভিন্ন নির্দিষ্ট ব্যবস্থাবিধি তৈরী করা আছে, সেই অনুযায়ী চিকিৎসা হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উন্নতি হয়।
এই হলো গিয়ে ভূতের রহস্য। ভূত আছে চিন্তায়, মনে। বেশী জাপটে ধরলে ওঝা নয়, চিকিৎসা করানো উচিৎ মনের রোগের, বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে। ফলের সম্ভাবনা বেশী।
(এরমধ্যে আর ভূতের উপদ্রব হয়েছে বলে শোনা যায়নি। বিজ্ঞানের বক্কাবাজিতে ভূত বাহাদুর কিঞ্চিৎ গা ঢাকা দিয়েছেন!!!☺️)
১০ই নভেম্বর ২০১৮ ফেসবুকে প্রকাশিত।