বাসী খাবার খাওয়া স্বাস্থ্যকর নয়। তেমন বাসী ভ্রমণকাহিনী লেখাও স্বাস্থ্যকর নয়। সেটা ভ্রমণকাহিনীর বদলে গালগপ্প হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
তবে ডাক্তাররা কবেই বা স্বাস্থ্যকর কাজ করেছে। ভোর পাঁচটায় ব্রেকফাস্ট করে। বিকাল চারটেয় লাঞ্চ করে। আর রাত সাড়ে বারোটায় স্নান করে। সেই তুলনায় বেড়ানোর সাতদিনের মধ্যে লেখা ভ্রমণ কাহিনীকে তো রীতিমতো টাটকাই বলা চলে।
এবারে আঠারো জন মিলে গেছিলাম ইছামতির ধারে টাকিতে। খুপরিতে যারা সারাদিন কাটাই তারা পরিবার সমেত গেছিলাম একটা মাইক্রোবাসে চেপে। বাসওয়ালা সাড়ে ছটায় হাজির। কিন্তু যারা যাবে তাদের কোনো পাত্তা নেই। ফোন করলাম গৌরকে। বলল, ‘এই তো ডাক্তারবাবু, শেষ পেশেন্টের ব্লাড টানছি। বউ বাচ্চা রেডি হয়ে আছে। বাড়ি গিয়েই ওদের নিয়ে বেরচ্ছি।’
ফোন করলাম ছোটোকাকুকে। বলল, ‘যাতবারই বাড়ি থেকে বার হচ্ছি, নিম্নচাপ আসছে। আর বাড়ি ফিরে যাচ্ছি।’
আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে অবাক হলাম। দু’চারটুকরো মেঘ দেখা যাচ্ছে বটে, কিন্তু নিম্নচাপের কোনো লক্ষণ নেই। জিজ্ঞাস করলাম, ‘তুমি কি ছানি কাটার পরের কালো চশমা পরে বেরিয়েছ? ওটা প্লিজ খুলে রাখ। না হলে সারাদিনই আকাশ কালো কালো দেখবে।’
ছোটোকাকু বলল, ‘না তো, আমি খালি চোখেই আছি। আর এটা আকাশের নিম্নচাপ নয়, পেটের নিম্নচাপ। আমার বারবার পায়খানা পাচ্ছে।’
সঞ্জীবদা একমাত্র রেডি হয়ে বেরিয়েছে। উল্টোদিকের পাড়ায় গাড়ি আটকে কালীপুজোর চাঁদা তুলছে, গভীর মনোযোগে তাই দেখছে। সুমিতদাকে ফোনে পাচ্ছি না। প্রদীপ্তদা, সঞ্চিতাদি বলল তারা বাদু রোডে দাঁড়াবে। সকলের খবরাখবর নিয়ে বাড়ি ঢুকে দেখি দুই মেয়ে তৈরি। রূপালী বলল, ‘ওষুধ নিয়েছ?’
‘হ্যাঁ নিয়েছি। প্যারাসিটামল, অন্ডেম আর গ্যাসের ট্যাবলেট।’
রূপালী বলল, ‘ওসব ট্যাবলেট ফ্যাবলেটে আমার কিছু হয়না বুঝলে। ইংজেকশন নাও। ভভেরান, অন্ডেম, র্যানটাক আর স্টেমেটিল ইঞ্জেকশন। আজ শিওর বমি করবই। এখনই শরীরটা খারাপ লাগছে।’
রূপালীর যে জিনিসগুলো আমার বেশ ভালো লাগে তার মধ্যে অন্যতম একটা হলো, বেড়াতে গেলেই মাথা টাথা ঘুরে, বমি টমি করে একেবারে হসপিটালাইজড হওয়ার মতো অবস্থা হবে, কিন্তু তাতে ওর বেড়ানোর উৎসাহ কমে না। কোথাও গেলেই ইংজেকশান দিয়ে ওকে চাঙ্গা করতে হয়। ও সেটা ভালভাবেই জানে। তাই হয়তো ডাক্তার ছেলে বেছে বিয়ে করেছে।
সাতটা নাগাদ সবাই বাসে উঠে গেলাম। কিন্তু গৌরদের পাত্তা নেই। ফোন করলেও ধরছে না। সাড়ে সাতটার সময়ে ব্রিজের উপর গৌরের বাইক দেখা গেল। বাসে উঠতেই সবাই গালাগালি শুরু করলো, ‘বছরে একটা দিন বেড়াতে যাবে। সেই দিনও ব্লাড টানা বাদ দিতে পারলে না?’
গৌর বলল, ‘আমি ঠিক সময়েই চলে আসতাম। সব ডাক্তারবাবুর দোষ। এক বুড়ির রক্ত টানছিলাম, বুড়ি মশারির ভেতর, শুধু হাতটা বের করে দিয়েছে। সবে ফুটিয়েছি, অমনি ডাক্তারবাবুর ফোন। ব্যাস ডিপি হয়ে গেল। বুড়িও খেঁকুড়ে, আর টানতেই দিতে চায়না। পনেরো মিনিট ধরে বুঝিয়ে, প্রায় হাতে পায়ে ধরে তারপর টানলাম।’
ছোটোকাকু বলল, ‘বুঝলি আমার একটু একটু পাচ্ছে। তবে দুটো ভিটাজাইম ক্যাপ্সুল মেরে দিয়েছি। আর হবে বলে মনে হচ্ছে না। একটাই সমস্যা ভিটাজাইম খেলে হেব্বি খিদে পায়।’
ন’জেঠু উত্তেজিত হয়ে গেলে ইংরাজি বলে, ‘ইমিডিয়েটলি স্টার্ট দ্য বাস। উই আর নট গোয়িং টু ডেজার্ট। খিদে পেলে দেখা যাবে।’
পার্থরা আর সোমনাথ কাকু অনিবার্য কারণ বশত আজ যেতে পারছে না। তাদের জন্য কিছুক্ষণ নীরাবতা পালন করে গাড়ি ছাড়া হলো।
এক ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম বেড়াচাঁপা। সেখানে চন্দ্রকেতুগড়ে প্রথম স্টপেজ। এখানে সম্ভবত পাল আমলের একটা বৌদ্ধস্তুপ আছে। আজ থেকে এক হাজার বছর আগের বাংলার গৌরবের নিদর্শন। আমি ইতিহাসে পাতিহাঁস। নয়পাল, বিগ্রহপালের নাম শুনলে “তুমি সন্ধ্যার মেঘ” উপন্যাসের কথা মনে পড়ে। তাই আমার কাছ থেকে এসব ঐতিহাসিক জায়গা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চেয়ে লজ্জা দেবেন না।
এই জায়গাটিকে আবার স্থানীয় লোকেরা খনা- মিহিরের ঢিপি বলে। তাদের বক্তব্য এটা খনার বাসস্থান ছিল। খনা ছিল বিক্রমাদিত্যের একজন সভাসদ মিহিরের পত্নী। তবে এই বিক্রমাদিত্য নিশ্চিত ভাবে ইতিহাস বিখ্যাত বিক্রমাদিত্য নয়। কারণ বিখ্যাত বিক্রমাদিত্য খ্রীষ্ট জন্মের আগে রাজত্ব করে গেছে। খনা কিছুতেই অতো আগের মানুষ হতে পারে না। খনার শ্বশুরের নাম বরাহ, স্বামীর নাম মিহির। দুজনেই অত্যন্ত বিদ্বান ছিল। কিন্তু খনা জ্ঞান চর্চায় তাদের দুজনকেই ছাড়িয়ে গেছিল। অংক, জ্যোতিষ, আবহাওয়া, কৃষি সব বিষয়েই ছিল তার অপরিসীম জ্ঞান। দুই বিদ্বান ব্যক্তির যে মেয়েটিকে আগলে রাখার কথা ছিল, জ্ঞান চর্চায় যাকে আরও উৎসাহ দেওয়ার কথা ছিল, সেই দুজন ব্যক্তি ঠিক তার উল্টো কাজটাই করলো। বরাহ- মিহির দুজনে মিলে নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি হারানোর ভয়ে খনার জিভ কেটে ফেললো। জিভ কাটার পর খনা আর বাঁচে নি। অপরিসীম কষ্ট পেয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে খনা মারা যায়। কিন্তু যার কন্ঠ থামিয়ে দেওয়ার জন্য জিভ কেটে ফেলা হলো আজও সে বেঁচে আছে বাংলার মানুষের মধ্যে। খনার আসল নাম ছিল লিলাবতী। আজও নাকি জ্যোৎস্না রাতে লীলাবতীকে দেখা যায় সেই ভগ্নস্তুপে পদচারণা করতে। আমি একজন অল্পবুদ্ধির খুপরিজীবি চিকিৎসক, লীলাবতী নামের মেধাবী মেয়েটির নখকণার যোগ্য নই। তবু কিশোরবেলা থেকে এক অদ্ভুত আকর্ষণ এই লীলাবতীর প্রতি। আমি শিওর জ্যোৎস্না রাতে এই গড়ে এলে লীলাবতীকে দেখতে পাবই।
ধান্যকুড়িয়া দিয়ে যাওয়ার সময় রাস্তার পাশের ঝোপ জঙ্গলে ভর্তি রাজবাড়ি দেখলাম। এখানে আরও তিনটি জমিদার বাড়ি আছে। যেগুলোতে অনুমতি নিয়ে ঢোকা যায়। কিন্তু আজ সময় নেই।
খোলাপোতায় আমরা থামলাম পেটাই পরোটা আর কাঁচাগোল্লা খাওয়ার জন্য। যে ছোটোকাকু নিম্নচাপের প্রভাবে বাড়ি থেকে বেরোতে পারছিল না, সে তিন প্লেট পেটাই পরোটা খেয়ে নিল। চতুর্থ প্লেটও অর্ডার করছিল- কিন্তু ন’জেঠু ধমক দিল, ‘এনাফ ইজ এনাফ…। আদেখলের মতো করিস না।’
ছোটোকাকু কাঁচুমাচু মুখ করে বলল, ‘আসলে আমার দোষ না, ভিটাজাইমের দোষ। শুধু খিদে পাচ্ছে।’
টাকি পৌঁছলাম এগারোটার সময়ে। সবে বাসের বাইরে পা রেখেছি, হঠাৎ ঘাড়ের উপর ঝুঁকে কেউ বেমাক্কা “জয় মা কালী” বলে পিলে কাপানো চিৎকার করে উঠল। চমকে গিয়ে প্রায় উলটে পড়ছিলাম। সামলে নিয়ে তাকিয়ে দেখি জটাজুটো ধারী রক্তবসন পরা এক সাধুবাবা। আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।
আমি রেগেমেগে বললাম, ‘এটা কী হলো বাবা?’
‘তোকে সকাল সকাল মায়ের নাম শোনালাম। সব দুর্যোগ কেটে যাবে।’
‘মায়ের নাম তো একটু মধুর করেও শোনানো যায়।’
সাধুবাবা বলল, ‘একটু না চমকালে লোকে ভিক্ষা দেয় না।’
‘তা বলে এভাবে চমকাবে। আমি তো আরেকটু হলে হার্টফেল করতুম।’
‘মায়ের নাম শুনে মরলে তোর স্বর্গবাস হতো রে পাগল। দে দে… দশ টাকা দে। ভাত খাই।’
রেগে মেগে বললাম, ‘এক টাকাও দেব না। উফ… এখনও আমার বুক ধড়ফড় করছে। তাছাড়া বেলা এগারোটার সময় কেউ ভাত খায় নাকি?’
‘তাহলে পাঁচ টাকা দে, চা খাই।’
রূপালী বলল, ‘তুমি কী গো? একজন সাধুবাবা দশ টাকা চেয়েছেন তাও দিতে পারছ না।’
বললাম, ‘চাওয়ার একটা পদ্ধতি আছে তো। দিতে হলে তুমি দাও।’
রূপালী বলল, ‘এই নিন বাবা, আপনি ওর উপর রাগ করবেন না।’
সাধু বাবা বলল, ‘নারে মা, তুই না দিলেও আমি রাগ করতাম না। আমি রাগ করার কে?’ তারপর আমার দিকে একটা বিড়ি এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এই নে, বাবার প্রসাদ খা।’
রূপালী রোষাকষায়িত কটাক্ষপাত করে ইছামতি নদীর দিকে হাঁটা দিল। নদীর ধারে দাঁড়িয়ে এপারের লোক বাংলাদেশের লোকদের দেখছে। ওপাশে বাংলাদেশের লোকেরাও অবাক হয়ে আমাদের দেখছে।
খানিকক্ষণ পরে তিনটি টোটোয় আমরা দর্শনীয় স্থান দেখতে বেরিয়ে পড়লাম। নদীর ধার দিয়ে টুকটুক করে যাচ্ছি। অনেক কিছু দেখলাম। প্রকান্ড প্রকান্ড জমিদার বাড়ি, তিনশো চারশো বছরের পুরোনো অনেক মন্দির। সেসবের ছবি দিচ্ছি। বিস্তারিত লেখা মুশকিল।
সবার ভালো লাগলো গোল পাতার জঙ্গল বা মিনি সুন্দরবনে এসে। ঢোকার সময় একটু গণ্ডগোল হলো। বিএস এফের ক্যাম্পে যে কোনো একটা আই কার্ড দেখাতে হয়। বার বার বলে দেওয়া সত্ত্বেও দুচারজন বাদে কেউই আই কার্ড আনে নি। বি এস এফের জওয়ানরা কিছুক্ষণ তাদের আটকে রেখে একটু হাসি মস্করা করে ছেড়ে দিল। হিন্দীতে বলল, ‘ছাড়লাম, কিন্তু সাঁতরে বাংলাদেশ চলে যাবেন না।’
সঞ্জীবদা বলল, ‘নেহি নেহি, হামলোগ পুকুরমে সাঁতার কাটতে হ্যায়, নদীমে নেহি কাটতে হ্যায়।’
‘
দুধারে ঘন জঙ্গল, মাঝখানে কংক্রিটের ব্রিজ। ছোটদের সামলানো মুশকিল। রানী জিজ্ঞাস করল, ‘বাবা, জঙ্গলে বাঘ নেই তো?’
‘না না, এটা মিনি সুন্দরবন। আসল সুন্দরবন না।’
‘চিতাবাঘ নেই তো?’
‘না, নেই…’
‘ডাইনোসর নেই তো?’
বোঝো ব্যাপার। ইমিডিয়েট টিভিতে আজগুবি সিনেমা দেখা বন্ধ করা দরকার। বললাম, ‘ওসব কিচ্ছু নেই। শুধু কিছু পাখি টাখি আছে। চারপেয়ে কোনো জন্তু নেই।’
তারপর থেকে রানীর আর পাত্তা পেলাম না। দৌড়ে দৌড়ে কোথায় চলে গেল। আমি বিভোর হয়ে জঙ্গলে পাখির ডাক শুনছিলাম, হঠাত পাশ থেকে একজন বলল, ‘ডাক্তারবাবু, কাল সকালে বসবেন তো? আমি তাহলে দেখাতে যাব। নামটা যদি লিখে রাখেন।’
তাকিয়ে দেখি আমারই বয়সী একজন দাঁত বের করে হাসছে। বলল, ‘ভালোই হলো দেখা হয়ে গেল। আমার সাজিরহাটে বাড়ি। কাল যাচ্ছি কিন্তু।’
ভদ্রলোক এতো স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছে যে মনে হচ্ছে আমার সাথে দেখা করার জন্যই এখানে এসেছে। এরই মধ্যে এক বয়স্ক সুন্দরীদের দল ‘আমরা সবাই রাজা’ গাইতে গাইতে আমাদের পাশে এসে দাড়াল। গান হঠাৎ থেমে গেল। একজন বয়স্ক মহিলা বলল, ‘একি ডাক্তারবাবু আপনি। আমরা আপনার উল্টোদিকের পাড়া রবীন্দ্রপল্লী থেকে এসেছি। ওরে ডাক্তারবাবুকে পেয়েছি, একসাথে ছবি তোল।’
হই হই করে জনা বিশেক বয়স্ক মহিলা আমাকে ঘিরে ধরল। অনেকেই সেলফি তুলছে। আমি ক্যাবলা ক্যাবলা মুখে পোজ দিচ্ছি। পেছনে রূপালী আসছিল। সে বেচারা হাঁ হয়ে গেছে। পরে বলল, ‘টাকিতে কী শুধু মধ্যমগ্রামের লোকেরাই ঘুরতে আসে?’
আমরা ওয়াচ টাওয়ারে উঠলাম। সুড়সুড়ি আইসক্রিম খেলাম। দূরবীন দিয়ে ইছামতীর ওপারে বাংলাদেশের লোকজন, বাড়ি ঘরদোর দেখলাম। তারপর টাকি গেস্ট হাউজে খেতে গেলাম। টোটো চালক দাদাদের কথামতো সকালেই খাবারের অর্ডার দিয়ে টাকা পয়সা মিটিয়ে এসেছিলাম। বেশ সুন্দর রান্না। খিদেও পেয়েছিল খুব। ছোটোকাকুর খাওয়া দেখে বুঝলাম ভিটাজাইম বেশ ভালোই কাজ করছে।
এরপর ভটভটি নৌকা করে মোহনা দেখতে চললাম। ইছামতিতে দুই বাংলা মিলে মিশে একাকার। ভারত আর বাংলাদেশের পতাকা লাগানো নৌকা পাশাপাশি চলছে। বাংলাদেশের জেলেরা ছোটো নৌকায় মাছ ধরছে। পাশের একটা নৌকার লোককে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কি কর্তা, মাছ পেলে?’
হেসে লোকটি কী উত্তর দিল, বুঝতে পারলাম না। বাংলাদেশের মানুষ যখন বাংলাতেই বলেছে। সমস্যা হলো আমার ভাষাজ্ঞান অত্যন্ত সীমিত। হিন্দী, ইংরাজি এসব অনেক বড়ো ব্যাপার, কলকাতার থেকে একটু দূরে গেলে বাংলাটাই ভালো করে বুঝতে পারি না। গত রাতেই পুরুলিয়ার এক আদিবাসী মহিলা দেখাতে এসেছেন- তিনিও আমার কথা বুঝতে পারছেন না, আমিও তার কথা বুঝতে পারছি না। অথচ দুজনেই বাংলায় কথা বলছি। কি বিচ্ছিরি কাণ্ড।
নৌকা থেকে নেমে কিভাবে বিএসএফ এবং বিডিআর- এর চোখ এড়িয়ে বাংলাদেশে চলে যাওয়া যায় এই নিয়ে আমাদের মধ্যে কিছুক্ষণ আলোচনা হলো। তারপর আবার টোটো করে ঘোরা শুরু। খান পাঁচেক মন্দির দেখলাম। খান ছয়েক জমিদার বাড়ি। মোহনায় পাখির ওড়া উড়ি দেখতে দেখতে সন্ধ্যে নেমে এলো। ভারতের দিকে বিদ্যাধরী, বাংলাদেশের দিকে কালিন্দী আর দুই দেশের মধ্যে ইছামতি তিনটে নদীর জল একসাথে সোনালী- লাল থেকে আস্তে আস্তে কালো হয়ে গেল। পুবের রাজবাড়িতে যখন ঢুকছি বেশ অন্ধকার। অবশেষে সব ঘোরা শেষ করে রাজবাড়ি ঘাটে যখন পৌছালাম- সাড়ে ছটা বাজে। রাজবাড়ির সামনেই দারুণ মালাই চা পাওয়া যায়। চায়ে চুমুক দিচ্ছি আবার “জয় মা কালী” চিৎকার। এবার অবশ্য অতোটা আচমকা ও মর্মভেদী নয়।
সাধুবাবা বলল, ‘তুই কি ডাক্তার?’
আমি বললাম, ‘কী করে জানলে?’
‘মায়ের কৃপায় সব খবর পেয়ে যাই। ছোটো জায়গা। আমার একটা সমস্যা আছে। সুগার ধরেছে। হাসপাতালে দেখিয়েছি। কিছুতেই কমছে না। একটু নদীর ধারে ঐ বেঞ্চিতে চল না। আলো আছে।’
রূপালীকে বললাম, ‘সাধুবাবাকে একটু দেখে দিয়ে আসছি।’
রূপালী বলল, ‘যাচ্ছ যাও, কিন্তু বাবার প্রসাদ খেয়োনা।’
ভারতের দিকে নদীর ধার বরাবর নানা রঙের আলো- আলোর খেলা। বাংলাদেশের দিকে অন্ধকার। একটা শুধু সাদা আলো টিমটিম করে জ্বলছে। বেশ ঠাণ্ডা ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে। এই হাওয়াকেই মনে হয় “পরাণ জুড়িয়ে দেওয়া হাওয়া” বলে।
সাড়ে সাতটায় টাকি থেকে বাসে উঠে ঠিক সাড়ে নটায় মধ্যমগ্রামে বাড়িতে ঢুকে গেলাম। বাস থেকে নেমে ন’জেঠু রানীকে জিজ্ঞেস করলো, ‘আজ এতো ঘুরলি। কেমন লাগলো?’
রানী বলল, ‘এ-কেলাস।’
‘এর মধ্যে কোনটা তোর সবচেয়ে ভালো লাগলো?’
রানী গম্ভীর মুখ করে বলল, ‘মায়ের একবারও বমি না করাটা।’