পিজি হাসপাতালে হাউজস্টাফ তখন। ভর্তি থাকা এক রোগীর বাড়ির লোক এলেন কথা বলতে। সমস্যা হল, তিনি এক বর্ণ বাংলা বোঝেন না। আমার সহকর্মী কো-হাউজস্টাফ চট করে তাঁকে আমার দিকে এগিয়ে দিল – বলল, আপ উনসে পুছিয়ে। একটু অবাকই হলাম। কেননা, সেই সহকর্মীর জন্ম ও লেখাপড়া কলকাতায় হলেও, আদতে তার বাড়ি পাটনায় – কয়েক পুরুষের প্রবাসী বাঙালি – বাংলার মতো হিন্দিতে সমান স্বচ্ছন্দ। এদিকে আমার হিন্দিটা নিয়ে বিশেষ কথা না বাড়ানোই ভালো – ইদানিং ভাষাটার ব্যাপারে আগের চাইতে একটু বেশী আত্মবিশ্বাস অর্জন করলেও দক্ষতার ব্যাপারে বিশেষ এগোতে পারিনি – আর যে সময়ের কথা বলছি, সে সময়ে তো বলা-ই বাহুল্য।
কিন্তু, যা-ই হোক, কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে ল্যাজ গুটিয়ে পিছিয়ে আসা আমার ধাতে নেই। অতএব, যথাসাধ্য হাত-পা নেড়ে – হ্যাঁ, ভাষার দুর্বলতা অতিক্রম করার ক্ষেত্রে এটা খুবই কার্যকরী স্ট্র্যাটেজি – বডি-ল্যাঙ্গুয়েজের অপটিমাম সহযোগিতায় নিজস্ব ঘরাণার হিন্দিতে সেই পরিজনকে রোগী বিষয়ে নিজের বক্তব্য বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলাম। এবং, আমার বিশ্বাস, আমি যা বলতে চেয়েছিলাম, বা বোঝাতে চেয়েছিলাম, তিনি সেটুকু বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন ও নিজের প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গিয়েছিলেন।
আদতে, কথ্য ভাষা ব্যাপারটা তো ভাব বিনিময়ের মাধ্যম – সে ভাষায় দক্ষতার অল্পস্বল্প খামতি অতিক্রম করা তেমন দুরূহ নয়, অন্তত সামনাসামনি কথোপকথনের ক্ষেত্রে। আপনি যখন কমিউনিকেট করছেন, সেই মুহূর্তে আপনার চোখের ভাষা ও শারীরিক অভিব্যক্তি এ কাজে আপনার সহায়ক – অনেকসময়ই, আপনার সচেতন প্রয়াস ছাড়াও, অবচেতনেই, সে সহায়তা আসতে থাকে। আবার ধরুন, সাহেবি কেতায় ইংরেজি না বলতে পেরে আমরা যতো হীনমন্যতায়ই ভুগি না কেন, নড়বড়ে ইংরেজি দিয়ে দিব্যি কথা বুঝিয়ে ফেলা যায় – আর বক্তব্যে মালমশলা কিছু থাকলে লোকে সেটাই শুনতে বসেন – আপনার ইংরেজি বলার অ্যাক্সেন্ট বা দক্ষতার অভাব নিয়ে সাহেবসুবোরাও খুব একটা ভাবিত হন না। হিন্দির ক্ষেত্রেও নিয়ম একই। আপনি যদি সৎভাবে চেষ্টাটুকু করেন, তাহলে উল্টোদিকের মানুষটার বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না – অন্তত, যেটুকু অসুবিধে থাকে, সেই ঘাটতি আপনার তরফে সৎ প্রয়াস দেখে আপনার বিপরীতের মানুষটি পূরণ করে নেন। ডিসক্লেইমার দেওয়া থাকুক, এই কথা আলোচ্য ভাষায় একটা সাধারণ দক্ষতা থাকার পরে প্রযোজ্য – রোগীর অবস্থা বিষয়ে আমাকে তামিল বা মালয়ালি ভাষায় কমিউনিকেট করতে হলে হাত-পা নেড়ে খুব বেশী বুঝিয়ে ওঠা সম্ভব হত না।
সে যা-ই হোক, মিনিট পনেরোর সে ঐকান্তিক প্রয়াসের শেষে আপাতদৃষ্টিতে সন্তুষ্ট পরিজন বিদায় নিলে দেখি, সেই কো-হাউজস্টাফ ততক্ষণে সিস্টার-দিদি এবং জনাতিনেক সিনিয়র ডাক্তার-দাদাকে (স্যারেরা সেই মুহূর্তে ছিলেন না, ভাগ্যিশ) ডেকে এনেছে – এবং সবাই মিলে জমিয়ে আমার সেই অনির্বচনীয় সংলাপপ্রয়াস চাক্ষুষ উপভোগ করছিলেন। প্রবল বিরক্তির উত্তরে সহকর্মী এক গাল হেসে উত্তর দিল, তোর হিন্দিটা এত ইন্টারেস্টিং, ভাবলাম বাকিরা কেন মিস করবে!!!!
ঘটনাচক্রে, বর্তমানে তিনি আমার সহধর্মিণী।
কিন্তু, ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ আপাতত থাক। আগের বার বলছিলাম, ভাষা দৈনন্দিন যাপন ও সংস্কৃতির সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত – এবং চিকিৎসক নিজের বেড়ে ওঠার সংস্কৃতির সাথে মানানসই ভাষার বাইরের শব্দগুলোর ক্ষেত্রে সবসময় স্বচ্ছন্দ হন না – তাঁকে অভ্যস্ত হতে হয় নতুন করে – এই অভ্যস্ত হতে পারার শিক্ষা তাঁর নিজের দায়িত্ব ও অবশ্যপালনীয় দায়। তবু, কথাটা ছিল বাংলাভাষা নিয়েই। শহুরে বাংলার সাথে আমাদের ওঠাবসা – অঞ্চলভেদে ও আর্থসামাজিক অবস্থানের সাথে সাথে ভাষা বদলে যাওয়ার পরে অপরিচিত ঠেকলেও, ভাষাটি বাংলা-ই থাকে – সচেতন প্রয়াস ও অভ্যাস জারি থাকলে, একই ভাষার প্রকারভেদের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার কাজটি জলের মতো সহজ না হলেও, খুব জটিলও নয়।
আগের লেখার প্রেক্ষিতে এক অগ্রজ বলছিলেন ইংল্যান্ডে নিজের অভিজ্ঞতার কথা। এদেশ থেকে গিয়ে সেদেশে চিকিৎসা করতে চাইলে ডাক্তারিবিদ্যার জ্ঞানের সাথে সাথে দেখে নেওয়া হয়, সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক সেদেশের মানুষের সাথে তাঁদের ভাষায় কমিউনিকেট করতে পারছেন কিনা – এবং সেই পরীক্ষা নেন অচিকিৎসক কোনো ব্যক্তি। পশ্চিমবঙ্গে চিকিৎসা করার আগে চলিত বাংলাভাষায় কথোপকথনের দক্ষতা যাচাই করে দেখার কোনো ব্যবস্থা নেই (অন্য রাজ্যেও অনুরূপ ভাষাগত দক্ষতার পরীক্ষা আছে কিনা, জানা নেই)।
পুনরুক্তিজনিত বিরক্তি উৎপাদনের ঝুঁকি নিয়েই আবারও বলি, বাংলাভাষা জানা থাকলেও অঞ্চলভেদে তার বিচিত্র ব্যবহারের সাথে মানিয়ে নেওয়ার কাজটি সহজ নয় – কিন্তু, তারও আগে মনে রাখা যাক, স্থানীয়ভাষায় কথোপকথনের দক্ষতা ছাড়া রোগী-চিকিৎসক সংলাপটিই অসম্ভব। স্থানীয় ভাষায় প্রাথমিক দক্ষতাটুকু থাকলে অঞ্চলভেদে ভাষার ভেদের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব ব্যক্তিচিকিৎসকের। এই কাজে, বা এই কাজের উপযুক্ত মানসিক গঠন তৈরীর প্রক্রিয়ায় তাঁর সহায়ক হতে পারে মেডিকেল কারিকুলাম – এই ধরনের বিষয়ে তাঁকে বিশেষভাবে সচেতন করে তোলার জন্যে সংগঠিত প্রয়াস ও স্ট্রাকচার্ড ট্রেনিং (শুনলে খুশী হবেন, যে, সেসব নিয়ে আজকাল বিশেষজ্ঞরাও ভাবতে শুরু করেছেন) – এবং সমাজের বিভিন্ন ধরনের মানুষের সাথে মেলামেশার অভ্যেস (প্রচলিত অর্থে মেলামেশার কথা বলছি – হাসপাতালে মেলামেশা শব্দটি যে অর্থে ব্যবহৃত হয়, সে কথা নয়) – আর, সেই অভ্যেস গড়ে তুলতে বিশেষভাবে সাহায্য করতে পারে হোস্টেলজীবনে রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা ও বিভিন্ন আর্থসামাজিক শ্রেণী থেকে আসা সহপাঠীদের সাহচর্য – যে বিন্যাসটি এই নতুন কোচিং-নির্ভর এন্ট্রান্স পরীক্ষার চোটে বিগড়ে যেতে বসেছে। এই সব কথা-ই অল্পবিস্তর বলেছি আগের পর্বে।
কিন্তু, সমস্যার আরেকটা দিক আজ দেখতে চাইব। রোগীর ভাষাটিই যদি চিকিৎসকের জানা না থাকে? তাহলে??
উত্তরভারতের একটি বিশেষ অঞ্চলের উচ্চবর্ণের সংস্কৃতিকেই জাতীয় সংস্কৃতি বলে আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়ার ঠেলায় অল্পবিস্তর হিন্দি জ্ঞান আমাদের সকলেরই রয়েছে – হ্যাঁ, ইদানিং ইশকুলে হিন্দিকে অবশ্যপাঠ্য করার অনেক আগে থেকেই রয়েছে। উল্টোদিকের মানুষটি হিন্দিতে কথা বললে বুঝতে অসুবিধে কারোরই হয় না। কিন্তু, বলতে অসুবিধে অনেকেরই হয় – হাত-পা নেড়ে বোঝানো অনেকক্ষেত্রে সম্ভব হলেও, সবসময় সম্ভবপর হয় না – সরকারি হাসপাতালের ভিড়ে ঠাসা আউটডোরে তো নয়ই। আবার, হিন্দিভাষী মানুষজনের একটা বড় অংশ ঠিক বলিউডি ফিল্মের হিন্দিতে কথা বলেন না – বলেন দেহাতি টানে আধা-ভোজপুরি হিন্দিতে – অনেকসময় উর্দুমিশ্রিত হিন্দিতেও – হাজার হাত-পা নাড়ার শেষেও আপন বার্তাটি তাঁদের কাছে পৌঁছে দেওয়া কঠিন – তারও আগে, তাঁদের সমস্যাটিই বুঝে ওঠা কঠিন, এবং ভুল বোঝার সম্ভাবনাও কম কিছু নয়। সেক্ষেত্রে ভাষার দুস্তর ব্যবধানের দুই পাড়ে দাঁড়িয়ে কমিউনিকেশন কতদূর সম্ভব? কার্যকরী কমিউনিকেশন ছাড়া চিকিৎসা-ই বা কেমন করে সম্ভব?
বাঁকুড়া মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীজীবনে – ও পরবর্তীতে কর্মজীবনেও – দেখেছি, আগত রোগীদের একটা বড় অংশ ঝাড়খণ্ড বা তৎসংলগ্ন পশ্চিমবঙ্গ থেকে এলেও বাংলাতে কথা বলতে পারতেন। হয়ত, তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা নয় – তবুও, ভাববিনিময়ে বড় কিছু সমস্যা অন্তত আমার হয়নি। না, তাঁদের বাংলাভাষা ঠিক আমার-আপনার কথা বলার বাংলা নয় – আঞ্চলিক শব্দ অজস্র – অনেকক্ষেত্রে উপজাতির ভাষায় ব্যবহৃত শব্দও জুড়ে থাকে – তবু, কমিউনিকেশন সহজই ছিল।
কলকাতার সরকারি হাসপাতালে এসে দেখলাম, একটা বড় অংশের মানুষ বাংলাভাষায় কথা বলতেই পারেন না – বলা তো দূরে থাক, বললে বুঝতেও পারেন না। এমনিতে হিন্দিভাষীদের ক্ষেত্রে আমার স্ট্র্যাটেজি, তিনি চাইলে নিজের স্বাচ্ছন্দ্যের ভাষায় নিজের সমস্যার কথা বলুন – আমি আমার সুবিধেমত ভাষায় আমার বক্তব্য জানাব। মানছি, এক্ষেত্রে রোগী-চিকিৎসক কমিউনিকেশনের মাঝে একটা পাঁচিল দাঁড়িয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা – তবু, আমার নড়বড়ে হিন্দি নিয়ে সে পাঁচিল অতিক্রম করা কঠিন, অন্তত সরকারি হাসপাতালের ভিড়ভাট্টায় রোগীর সাথে কথা বলার পিছনে যতটুকু সময় দেওয়া যায়, সে সময়ের মধ্যে কাজটা রীতিমতো দুঃসাধ্য – বিশেষত, যদি রোগী-পরিজন বাংলা বুঝতে পারেন, তাহলে তো আমার তরফে হিন্দির অপপ্রয়াস অর্থহীন।
কিন্তু, অন্তত আমার অভিজ্ঞতা, যেমনটি একটু আগেই বললাম, একটা বড় অংশের রোগী-পরিজন বাংলায় কথা বলতে পারা তো দূর, শুনলে বুঝতেও পারেন না। অথচ, এঁদের অধিকাংশই বেশ কয়েক পুরুষ ধরেই কলকাতায় বাস করেন – যেটুকু লেখাপড়া করেছেন, বা যা কাজকর্ম করেন, সবই কলকাতাতেই।
এক্ষেত্রে চিকিৎসকের দায় বা দায়িত্ব ঠিক কী, সে নিয়ে আমি রীতিমতো কনফিউজড। তবে কি পশ্চিমবঙ্গের সরকারি হাসপাতালে কাজ করার জন্যেও হিন্দিতে কথোপকথন দক্ষতা জরুরী? কাজ-চালানো হিন্দি জানলেও অল্পসময়ের মধ্যেকার চটজলদি কমিউনিকেশন ঠিক হবেই, সে নিশ্চয়তা কোথায়? আর কথার ভুল ইন্টারপ্রেটেনশন হলে? আমি যদি রোগীর সমস্যাটি ধরতে ভুল করি বা রোগী যদি আমার পরামর্শটি ভুল বোঝেন? দায় কার??
আমরা তো দেখেছি, মাতৃভাষায় কথা বলার মুহূর্তেও আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থানের ছায়া ঠিক কেমন করে ভাষার উপর পড়ে, এবং কেমন করে দূরত্বের সৃষ্টি হয়। বইয়ে পড়া শিক্ষার হিন্দিটুকু জানা যদি বাধ্যতামূলকও হয়, সে বিদ্যে দিয়ে কমিউনিকেশন ঠিকঠাক হতে পারবে তো?
না, আমি হিন্দি-আগ্রাসনের বিরোধিতা বা বাংলায়-থাকলে-বাংলায়-কথা-বলুন এমন দৃষ্টিকোণ থেকে কথাগুলো বলছি না (যদিও, দুটি বিষয়েই ব্যক্তিমানুষ হিসেবে আমার সমর্থন আছে) – কিন্তু, রোগী-চিকিৎসক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভাষার এই অন্তরায়, অন্তত এই ক্ষেত্রে, কীভাবে দূর করা সম্ভব, ভেবে পাইনি।
আবার বাংলাভাষার ক্ষেত্রেও যেমন, হিন্দির ক্ষেত্রেও অঞ্চলভেদে ভাষার বদল প্রচুর। আমার এক বন্ধু অল ইন্ডিয়া এন্ট্রান্স দিয়ে হরিয়ানার এক মেডিকেল কলেজে গাইনোকোলজির স্নাতকোত্তর পাঠ নিতে যায়। হিন্দি সিনেমার একনিষ্ঠ দর্শক হিসেবে বেশ খানিকটা হিন্দি জানতও সে। প্রথমদিকেই, আউটডোরে এক রোগিনীর কাছে সমস্যার কথা জানতে চাইলে তিনি জানান – ছাদ গির গ্যয়া। বন্ধুটি ছাদ পড়ে যাওয়ার আক্ষরিক অর্থ ধরে নিয়ে তাড়াতাড়ি তাঁকে ইমার্জেন্সিতে পাঠান বড়সড় কিছু চোট লেগেছে কিনা সেটা বুঝতে। খানিক বাদে সিনিয়র দাদার ঠাট্টামিশ্রিত গালিগালাজে বন্ধুটি জানতে পারে – এক্ষেত্রে ছাদ পড়ে যাওয়ার অর্থ ইউটেরাইন প্রোল্যাপ্স – অর্থাৎ যোনিদ্বার দিয়ে জরায়ুর বাইরে বেরিয়ে আসা।
আগে থেকেই হিন্দির সাথে কিছুটা পরিচিতি থাকার সুবাদে বন্ধুটি খুব দ্রুতই পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেন। কিন্তু, তিনি যদি অন্ধ্রপ্রদেশ বা তামিলনাড়ুর হাসপাতালে পড়াশোনা করতে যেতেন, কাজটা ততোখানি সহজ হত কি? এমনিতে মেডিকেল কলেজগুলিতে কিছুটা কসমোপলিটান টাইপের ব্যাপার থাকে – অল ইন্ডিয়া এন্ট্রান্সের সুবাদে এমবিবিএস পর্যায় থেকেই ভিনরাজ্যের ছাত্রছাত্রীদের আনাগোনা থাকে – একজনের ভাষার ঘাটতি বাকি সকলের সহযোগিতায় কিছুটা হলেও পুষিয়ে দেওয়া যায় সেখানে। কিন্তু, ধরুন, জেলা হাসপাতালে?
কথাটা একারণেই তোলা, ইদানিং অল ইন্ডিয়া এন্ট্রান্স দিয়ে আমাদের রাজ্যের জেলা হাসপাতালেও বেশ কিছু ভিনরাজ্যের ছাত্রছাত্রী ডাক্তারির স্নাতকোত্তর ডিগ্রি ডিএনবি করতে আসছেন। এরকমই একজনের উদাহরণ দিই। তিনি গাইনোকোলজিতে স্নাতকোত্তর পাঠ নিচ্ছেন আমাদের রাজ্যেরই এক জেলা হাসপাতালে। মাতৃভাষা তামিল। দ্বিতীয় বর্ষের শেষের দিকে তিনি আমাদের হাসপাতালে এসেছিলেন মাসখানেকের ট্রেনিং নিতে – মহিলাদের যেসব ক্যানসার হয়, তার চিকিৎসার ব্যাপারটি বুঝতে – বড় করে বলতে হলে, গাইনোকোলজিকাল অঙ্কোলজির রোটেশন।
চমৎকার ঝলমলে মেয়েটি। হাসিখুশি। পড়াশোনায় তুখোড়। কাজেকম্মেও দক্ষ। কিন্তু, বাংলায় কথা অল্পবিস্তর বুঝতে পারলেও, বাংলা প্রায় বলতেই পারেন না। খুব বেশী শেখার তাগিদও নেই – কেননা, তিন বছর পঠনকালের দুটি বছর অতিক্রান্ত – আর একটি বছর, ব্যাস – পাস করেই তিনি নিজের রাজ্যে ফিরে যাবেন – সেখানে তাঁর বাংলাভাষায় কথোপকথনের দক্ষতা, একমাত্র দক্ষিণের হাসপাতালে বাঙালি রোগীর ভিড়কে খুশী করা বাদ দিলে, সেভাবে কাজে লাগবে না। তাঁকে দোষ দিইনা, কেননা, অনুরূপ পরিস্থিতিতে আমাকে ফেললে বছরদুয়েকের মধ্যে কার্যকরী কথোপকথনের মতো তামিল আমি কোনোভাবেই শিখে উঠতে পারতাম না (তাছাড়া, স্বল্প ভাষাজ্ঞান নিয়ে রোগীর সমস্যার অনুধাবন ও চিকিৎসা-সংক্রান্ত সিদ্ধান্তে গ্রহণ বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াতে পারে)। তাহলে, প্রত্যন্ত গ্রামীণ এলাকার মহিলাদের সাথে ঠিক কেমন কথোপকথন তিনি করে চলেছেন?
ডাক্তারিতে সংলাপের গুরুত্ব নিয়ে তো নতুন করে বেশী কিছু বলার নেই। সেটার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করার জন্যে সামান্য কাণ্ডজ্ঞানই যথেষ্ট।
ইদানিং, বাজারমুখী চিকিৎসার মধ্যেও চিকিৎসক যাতে “মানবিক” হন – অনুভব করুন বা না করুন, আন্তরিকতার সুবাসটুকু যাতে তিনি হাবেভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারেন, সেজন্যে কর্তৃপক্ষ ভারী বিচলিত হয়ে পড়েছেন। মেডিকেল শিক্ষাক্রমে কমিউনিকেশন স্কিল ডেভেলপ করার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। খুবই মহৎ কাজ, নিঃসন্দেহে।
মুশকিল এই, আমাদের বিশেষজ্ঞরা পশ্চিমা মডেলের থেকে আলাদা কিছু ভাবতে পারেন না।
পশ্চিমের দেশগুলিতে দেশের প্রায় সবাই একই ভাষায় কথা বলেন – সেক্ষেত্রে ভাষাগত ব্যবধান বলতে একই ভাষার অঞ্চলভেদে ব্যবধান। রোগী-চিকিৎসক কমিউনিকেশন আরো উন্নত ও মানবিক করার জন্যে (অন্তত, রোগীপক্ষকে আন্তরিকতার অনুভূতিটুকু বোঝানোর জন্যে) সেখানে কমিউনিকেশন স্কিল ট্রেনিং, হয়ত, জরুরী। চিকিৎসকের মানবিক বোধ ও সংলাপ-দক্ষতা কীভাবে আরো শানিত করা যায়, বাড়তি নজর, সম্ভবত, প্রয়োজন।
কিন্তু, নানা ভাষার এই বৈচিত্র্যময় দেশে চিকিৎসা শিক্ষার জন্যে ভারতব্যাপী একটিই প্রবেশিকা পরীক্ষা রাখলে – প্রবেশের ক্ষেত্রে ডোমিসাইল নীতি তুলে দিলে, অর্থাৎ চিকিৎসা-শিক্ষার ক্ষেত্রে সে রাজ্যের অধিবাসীরা যে অগ্রাধিকার পাবেন, সেই ব্যবস্থা তুলে দিলে – চিকিৎসককে স্থানীয় ভাষায় অন্তত কাজচালানো কথোপকথনে সক্ষম হতেই হবে, এ নিয়ম না থাকলে – কমিউনিকেশন স্কিলের উন্নতির কথা সিলেবাস আর কারিকুলামে গুঁজে দিলে আদৌ কোনো লাভ হবে কি?? আগে তো ভাষাটুকু জানা – তার পরে সেই ভাষায় কথা বলার দক্ষতাকে উন্নত করে তোলা – কথা বলার চাইতে শোনার অভ্যেস করা – কথার মধ্যে যথাসাধ্য আন্তরিকতার আভাস এনে রোগীর পাশে থাকা। প্রথম ধাপটি ছেড়ে দিয়ে বাকি ধাপগুলো দাঁড়ায় কি?? বাড়ির একতলা খাড়া করার আগেই দোতলা বা তিনতলার অন্দরসজ্জার পরিকল্পনার অর্থ কী?
অবশ্য, আরেকটু গভীরে গিয়ে দেখলে, এমন পরিকল্পনায় লাভ নিশ্চয়ই কিছু আছে। অর্থের ভাষা – টাকাপয়সার কথ্য বয়ান – সর্বজনীন। উচ্চবিত্তের চিকিৎসার প্রয়োজনে সংলাপের ভাষাও তা-ই। বিশ্বাস না হলে যাচাই করে দেখতে পারেন – কলকাতা-মুম্বাই-ব্যাঙ্গালোর-দিল্লী-পুনে – কর্পোরেট হাসপাতালের লাউঞ্জে বসলে প্রায় এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে বসার তুল্য অভিজ্ঞতা হয় – কোন শহরে আছেন, কেউ বলে না দিলে বুঝতেই পারবেন না। ভাষার ব্যবধানের প্রশ্ন এখানে অবান্তর। অন্তত পাব্লিক স্ফিয়ারে, উচ্চবিত্ত মানুষের কমিউনিকেশনের জন্যে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলার প্রয়োজন পড়ে না। কাজেই, তাঁর সাথে কমিউনিকেট করবেন যে চিকিৎসক, বা তাঁর/তাঁদের সাথে কমিউনিকেট করার জন্যে প্রস্তুত করা হচ্ছে যে চিকিৎসককে, স্থানীয় ও আঞ্চলিক ভাষা তাঁর না জানলেও চলে। উল্টে, বিত্তবানের ভাষায় দক্ষ না হয়ে আঞ্চলিক ভাষা-সংস্কৃতি নিয়ে পড়ে থাকার সম্ভাবনা ছিল যাঁদের, ক্রমশ তাঁদের অপ্রাসঙ্গিক ও মাঠের বাইরে করে ফেলার প্রকল্পটি জারি রয়েছে।
কিন্তু, যেহেতু বিত্তবানের সংখ্যা মুষ্টিমেয় এবং বাকি সকলেই তাঁদের সেবার উদ্দেশে নিবেচিত – এবং চিকিৎসকও এই হিসেবের বাইরে নন – কমিউনিকেশন স্কিলের উন্নতি ছাড়া বেচারা চিকিৎসক উচ্চবিত্ত মানুষকে খুশী করতে পারবেন কি? পারবেন কি তাঁকে স্যাটিসিফায়েড ক্লায়েন্ট হিসেবে হাসপাতাল থেকে বাড়ি পাঠাতে? না পারলে?? সে তো খুব বড় ঝুঁকি হয়ে যেতে পারে, তাই না!!
ফেলো-কড়ি-মাখো-তেল চিকিৎসা-ব্যবস্থাটি মানবিক মুখ ছাড়া তেমন জমিয়ে ব্যবসা করতে পারে না। অতএব, হোক না কৃত্রিম, তবু আন্তরিকতার পাঠ দেওয়া জরুরী – অর্থাৎ কমিউনিকেশন স্কিলের উন্নতির জন্যে ট্রেনিং। সরকার যাঁদের কথা ভাবেন, আশা করা যাক, হবু চিকিৎসকরা তাঁদের ভাষা জানেন ও বোঝেন – সে ভাষা না জানতে পারলে ডাক্তার হয়ে ওঠা বা ডাক্তার হিসেবে সফল হওয়া উত্তরোত্তর জটিল হয়ে উঠবে – ঘষামাজার দরকার বলতে ওই ভাষার মধ্যেই আরো সুন্দর করে বোঝার ও বোঝানোর দক্ষতা।
আর, যাঁদের কথা শোনার মানে হয় না – অর্থাৎ সংখ্যায় যাঁরা দেশের অধিকাংশ, কিন্তু যাঁদের হাতে দেশের সম্পদের কিছুই নেই – তাঁদের ভাষা জানা একেবারেই তেমন আবশ্যক নয় – তাঁদের ভাষা যাঁরা বুঝবেন, তেমন মানুষজনের মধ্যে থেকে চিকিৎসক গড়ে তোলা স্রেফ সময়ের অপচয় – অন্তত, সরকারি সিদ্ধান্তগুলি তেমন দিকেই এগোচ্ছে।
কোচিং সেন্টার-নির্ভর প্রবেশিকা…বাকি সব ভাষা ছেড়ে কেবলমাত্র ইংরেজি ও হিন্দিতে প্রবেশিকা পরীক্ষার ব্যবস্থা (পরে মায়াদয়া করে আরো কখানা ভাষা ঠাঁই পেয়েছে)…সারা ভারত জুড়ে একটিই প্রবেশিকা…ডোমিসাইল সুবিধা তুলে দেওয়া…চিকিৎসার ক্রমেই নৈর্ব্যক্তিক হয়ে ওঠা…মুনাফামুখী চিকিৎসাব্যবস্থাকেই শিরোধার্য বলে মেনে নেওয়া…কমিউনিকেশনের বাকি প্রাথমিক দিক অগ্রাহ্য করে একেবারে সেলস ট্রেনিং-এর মডেল অনুসরণ করে কমিউনিকেশন স্কিল বাড়ানোর ট্রেনিং…
আপাতদৃষ্টিতে খুব ছাড়া ছাড়া কয়েকটি বিষয় – সুতোটা চিনতে শিখলেই বুঝবেন, সব সেই একই সুতোয় বাঁধা।
খুবই দরকারী একটা লেখা.. যদিও, কমিউনিকেশন স্কিল শেখাবার নাম দিয়ে নব্য ফার্স্ট ইয়ারদের যা হচ্ছে/হয়েছে এই শিক্ষাবর্ষ থেকে়, সেটা নিতান্তই ঢুঢু.. অত্যন্ত প্রত্যাশিতভাবে..
অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং প্রাণবন্ত লেখা ! কিন্তু কী কঠিন ঠাট্টা ! যারা , সাধারণ , যারা জনগন ,যারা ‘পাব্লিক’ , যাদের একটি শাখার নব্য নাম – ‘পরিযায়ী’ , তাঁদের জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার এই জোড়া ফলার উপহাসটুকুই বরাদ্দ রইল
চিকিৎসা এবং শিক্ষা যে আজ আর সেবাব্রত নয়, বিস্তীর্ণ কর্ষণযোগ্য স্বর্ণখনি, সে কথা মনে না রাখলে বা মানতে না চাইলে কর্পোরেট সরকার যুগলবন্দী মহান সংবিধানও বদলে ফেলে তাদের সুমহান ও পবিত্র কর্তব্য পালনে বদ্ধপরিকর। হাতে হারিকেন বা পেন্সিল কিছুতেই কিছু হবার নয়। কি হলে হবে, সে আলোচনার ক্ষেত্র অবশ্য স্বতন্ত্র।