আমি আপাদমস্তক সুবিধাবাদী আস্তিক। সবকিছু ঠিক ঠাক চললে, তখন ভগবানকে কেয়ারও করি না। আর বিপদে পড়লে ঠাকুর দেবতাকে ঘন ঘন স্মরণ করি।
ফাইনাল এমবিবিএস পরীক্ষার আগে যখন মেডিসিন, সার্জারি, গাইনির মহাসমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছি, তখন দিনে তিনবার করে ফিরিঙ্গী কালীবাড়িতে গিয়ে হত্যে দিতাম। ‘মা, মা’ করে মা কালীর কান ঝালাপালা করে দিতাম। ওখানকার পুরোহিত মশাই আমাকে রীতিমতো স্নেহ করতে শুরু করেছিলেন। বলতেন, ‘বাবা, আমি অনেক ভক্ত দেখেছি, তোর মতো পাগল ভক্ত আর দেখিনি। মাকে না দেখে এক বেলাও থাকতে পারিস নে।’
সম্ভবত আমার অতি ভক্তির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই মা কালী সে যাত্রায় উপর মহলে অনেক বলে কয়ে আমাকে পাশ করিয়ে দিয়েছিলেন। না হলে, সার্জারি পরীক্ষায় প্র্যাক্টিকালের দিন যা ছড়িয়েছিলাম, তাতে কোনোভাবেই আমার পাশ করা উচিৎ নয়।
যাইহোক, রেজাল্ট বেরনোর পর রাতারাতি আমি নাস্তিক হয়ে গেলাম। রোজ বিকালে বৌবাজারে চা খেতে গেলেও কালীবাড়ির ধারেকাছে ঘেঁষিনা। ইনটার্নশিপে প্রায় চার হাজার টাকা মাইনে পেতাম। প্রতি শুক্রবার গ্লোব সিনামাহলের মাচায় উঠে ইংরেজি সিনেমা দেখতাম। তখন আর ঠাকুর দেবতার কথা মনেও পড়ত না।
ভক্তি আবার ফিরে এল খড়গ্রামে চাকরির শেষ দিকে। স্ত্রী, নবজাতক কন্যা আড়াইশো কিলোমিটার দূরের বাড়িতে। যে করেই হোক বাড়ির কাছাকাছি ফিরতে হবে। পোষ্ট গ্রাজুয়েশানে চান্স পাওয়া ছাড়া বাড়িতে ফেরার উপায় নেই। আমি আবার মা কালীর ফটো জোগাড় করে ‘মা মা’ শুরু করলাম।
আমার মতো সুবিধাবাদী সন্তানও মার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হোল না। মেডিকেল কলেজে ফিরে এলাম। ফিরিঙ্গী কালীবাড়িতে আবার যাওয়া শুরু করলাম। তবে কলকাতায় ফিরে সাথে সাথে নয়। আবার বছর তিনেক পরে। এমডি ফাইনাল পরীক্ষার আগে আগে।
আমার অন্যতম অ্যাসিস্টেন্ট গৌড় রায়চৌধুরি কিন্তু আমার মতো সুবিধেবাদী আস্তিক নয়। ওর দিনের অনেকটা সময়ই ঈশ্বর বন্দনায় কাটে। ইসিজি করা ওর সেকেন্ডারি পেশা। ওর মূল পেশা পুজো আচ্চা করা।
গৌড় সপ্তাহের অধিকাংশ দিনই নিরামিষ খায়। সপ্তাহের বিশেষ কয়েকটি দিনে বাইরে কিছুই খায়না। এমনকি চা পর্যন্ত না। একাদশীতে দুচার টুকরো ফল খেয়ে দিব্যি সারাদিন কাটিয়ে দেয়।
পূজারী বামুন বললে আমাদের চোখে যে মানুষের চিত্র ভাসে গৌড় মোটেও সে রকম নয়। পুজো করাটা ওর কাছে প্রায় প্যাশন। আদ্যোপান্ত সৎ বামুন। দক্ষিণা নিয়ে কারো সাথে ঝামেলা করে না। বলে ডাক্তারবাবু, ‘যার যেরকম সামর্থ্য তাই তো দেবে। তা বলে তাঁর বাড়িতে কি ঈশ্বরের পুজো হবে না?’
করোনার সময়ে বেচারা পরে গেছে মুশকিলে। সব পুজোই বন্ধ। পয়লা বৈশাখ, অক্ষয় তৃতীয়া এক এক করে পার হয়ে যাচ্ছে, গৌড়ের ভুরু কুঁচকে উঠছে। যে কয়েকটা বাড়িতে নিয়মিত যজমানি করত সেগুলোও বন্ধ।
ও এখন প্রায় সব সময়ই আমার সাথে সাথে থাকছে। যদি দুএকটা ইসিজি বেশি পাওয়া যায়। মাঝে মাঝে মুখ ফসকে বলে ফেলছে, ডাক্তারবাবু, বড্ড বিপদে পড়ে গেলুম। বাচ্চাটা একেবারে ছোটো। বাবা, মায়েরও অনেক বয়স হয়েছে।’ কিন্তু তার ঈশ্বরে ভক্তি কমার কোনও লক্ষ্মণ দেখতে পাচ্ছি না।
সেই গৌড় কালকে চেম্বার শেষের পর বলে ফেলল, ‘ডাক্তারবাবু, চারিদিকের ঘটনা দেখতে দেখতে কদিন ধরে ভগবানের উপর আমার ভরসা হচ্ছে না। বাচ্চা কোলে নিয়ে শ্রমিকেরা রৌদ্রের মধ্যে হাঁটছে, সেটাকি ভগবানের চোখে পড়েনা? ভগবান থাকলে এতগুলো গরীব মানুষের ঘর আম্ফানে ভেঙে যায়? অথচ দেখেন, যে নেতাগুলো এই অকালেও গরীবের পেটের লাথি মারছে তাদের কিছুই হয় না। দিব্যি আছে।’
তারপর বলল, ‘আমার এই বিপদের সময়ে ভগবান মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। ডাক্তাররা আছেন বলে তাও কটা ইসিজি করে পরিবারের সকলের পেট ভরতে পারছি। ইদানীং আমার ভগবানের চেয়ে ডাক্তারের উপর ভরসা বেশি হচ্ছে।’
বললাম, ‘তা ডাক্তারদের উপর এতই ভরসা যখন আজ যাওয়ার সময় একটু চা, মিষ্টি খেয়ে যাও।’
গৌড় কিছুতেই খেল না। জানি ও মুখে যাই বলুক, ভগবানের উপর বিশ্বাস ওর এতটুকুও কমেনি।
ভালো লাগলো।