লক-ডাউনের জন্য বহুদিন শালবনী যেতে পারিনি। বাড়ির কাছের চেম্বারে নিয়মিত রোগী দেখলেও দূরের চেম্বারগুলোয় যাওয়া সম্ভব ছিল না। অনেক বাচ্চার ভ্যাক্সিন বাকি ছিল। তাছাড়া আরও হাজারো হ্যানা-ত্যানা-এটা-সেটা.. যেমন হয়। এর মধ্যে অনেক বাবা-মা বাচ্চাকে দেখাতে চেয়ে মেসেজ করেছেন কিন্তু হাত-পা বাঁধা। যোগাযোগের সুবিধে একেবারেই ছিল না। অবশ্য, এখনও খুব সহজলভ্য নয়। মহামারীর সত্যিকারের ভয়াবহতাকে ছাপিয়ে গিয়েছে অদ্ভুত মানসিক ভীতি। মাঝে মাঝে সাধারণের মনোভাব দেখলে মনে হয়, দেশে বুঝি আর কোনও রোগ নেই! করোনার চেয়েও আরও বহুগুণ ভয়ানক সব রোগ এমনিতেই চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। মিডিয়ার প্রতি মুহূর্তে আপডেটের কল্যাণে সবাই সেসব ভুলে শুধু এবং শুধুমাত্র করোনা নিয়ে পড়েছেন। সেখান থেকেই থালা-বাটি বাজানোর পরবর্তী মুহূর্তেই স্বাস্থ্যকর্মীদের অচ্ছুৎ হয়ে যাওয়া..
যাক গে সেসব কথা.. সক্কাল সক্কাল বেরিয়ে পড়া গেল। কংসাবতী পেরিয়ে আবার সেই শালের জঙ্গল.. কতদিন বাদে!! কালো কুচকুচে রাস্তার দু’দিকে মনকেমনের সযত্ন আয়োজন। এই শালের দেশের কাছে আমি চিরঋণী। এখানে আসার আগে শুধু ‘রোগ’ চিনতে-দেখতে জানতাম.. মানে, আমার সামান্য যেটুকু সামর্থ্য। এই বনের দেশ আমাকে ‘রোগী’ চিনতে-দেখতে শিখিয়েছে। বুঝতে শিখিয়েছে, ‘চিকিৎসক’ হয়ে ওঠা আসলে রোগ সারিয়ে দেওয়ার প্রফেশনালের বাইরে আরও অনেক, অনেক কিছু। যার সবকিছু পাখিপড়া করে শেখানোও অসম্ভব। শিকনি ঝরা-পাঁজরা বেরোনো শিশুর চোখে কিংবা দামী গাড়ির স্টিয়ারিং ধরা হাতের পাঁচ আঙুলে সাতটি আংটিতে সেসব পাঠ লেখা থাকে। শুধু পড়ে নিতে জানতে হয়। আমার কাছে এই বনের দেশ সেই বিদ্যালয়। তাই বারবার ফিরতে চাই। নিজের প্রথম স্কুল কেউই ভোলে না বোধহয়..
আরও একটা ব্যাপার আমার খুব ভাল্লাগে.. এখানে অর্ধপক্ক লোকজনের সংখ্যা বেশ কম। স্ব-চিকিৎসার ঘাঁটাঘাঁটি কিংবা ইন্টারনেট-ডাক্তারের জ্ঞানগম্যি কম শুনতে হয়। ক্ষুদ্র ডাক্তারি-জীবনে কম তো দেখলাম না.. জ্বর ১০০ উঠলেই একবার করে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানো, মাথা ধরলে গ্যাসের বড়ি, বুদ্ধি বাড়াতে লিভার-টনিক.. আরও অসংখ্য হাবিজাবি যাঁরা ব্যবহার করে থাকেন তাঁরা কিন্তু এমনিতে বেশ আলোকপ্রাপ্তেরই তালিকায় পড়েন। ব্রাহ্মীশাকের সাথে ব্রাহ্মধর্মের সম্পর্ক অথবা বিদ্যাসাগরের সাথে বিশ্বব্যাঙ্কে মন্দার বিষয়ে জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য রাখেন। এখানে এখনো মানুষ ‘ডাক্তার’ নামক প্রাণীটিকে সম্মান করে। বাড়ির আলু, আদা, ডাল কাঠফাটা রোদ পেরিয়ে ডাক্তারের জন্য পৌঁছে যায়। রোগের ইতিহাস শোনা আর প্রয়োজনীয় পরীক্ষার শেষে খসখসিয়ে কিছু ওষুধ লেখার বাইরেও আরও কিছু থাকে যাকে খুব সম্ভবত ‘বিশ্বাস’ বলে। যার জোরে আপাত গম্ভীর মানুষটির স্টেথোর তলায় নিশ্চিন্তে বুক পেতে দেওয়া যায়..
কিছুদিন বাদেই হয়তো আবার কোলকাতা ফিরে যেতে হবে। যত দিন যাচ্ছে আরও বেশি বেশি করে বুঝতে পারছি, ‘পিডিয়াট্রিক্স’-এর ‘প’ টুকুও শিখিনি। খানিকটা পড়াশোনা করতে কোলকাতার একটি বড়ো সরকারি হাসপাতালে যাওয়ার কথা ভাবছি.. তবু কিছু মানুষ এই প্রায় নির্বোধ আমার ওপরেও বিশ্বাস রাখেন ভাবলে অবাক লাগে। কীই বা জানি? কতটুকুই বা পরিষেবা দিতে পারি?
পুরো রাস্তায় ‘মাস্ক’ আর ‘দূরত্ব বজায়’-এর ব্যাপারটা বেমালুম বেপাত্তা! জটলা-আড্ডা সব মিলিয়ে বেশ মাখোমাখো পরিবেশ। লক-ডাউন একদিন উঠে যেতই কিন্তু একইসাথে স্বাস্থ্য-সচেতনতাও সোজা উঠে মগডালে চড়ে বসেছে। রাস্তার পাশে বাইরে থেকে আসা শ্রমিকদের স্বাস্থ্য-পরীক্ষার লাইন। অথচ, বেপরোয়া ভিড়ের কমতি নেই কোনোখানে.. ভয় দেখিয়ে আর কবে কে সিধে হয়েছে! অবশ্য, ধর্মস্থান খুলে দেওয়ারও যখন আশু প্রয়োজন হয়ে পড়েছে সেখানে আর ঘোমটার আড়াল রেখে কাজ নেই। আশা রাখা যাক, সমস্ত ধর্মের উপাস্যরা মিলেমিশে দেশকে করোনা-টেবিলে আরও ভালো র্যাঙ্ক করার গৌরব অর্জনের সুযোগ করে দেবেন।
পেশেন্ট দেখতে দেখতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল। গাড়িতে উঠে পড়লাম। শালবনী পিছিয়ে যাচ্ছে.. মনোজিৎ-সুনীলের সাথে চকিত ভ্রমণ, মাসির দোকানে সারাদিনের খাওয়া, রেললাইনের পাশের গুমটিতে খাসির চর্বি দেওয়া ঘুগনি, সান্ধ্য-শরীরচর্চা ইত্যাদি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারগুলোই এখন কেমন নস্টালজিক লাগছে।
আবার ফিরে আসা যাবে কিনা জানিনা। আবার পাহাড়-জঙ্গলের বুকে কান পেতে ধুকপুক শোনার সুযোগ হবে কিনা জানিনা। তবু ইচ্ছে রইলো ষোলআনা..
(বি.দ্র.- মনোজিৎ আর সুনীল চেম্বারের শেষে ছবি তোলার সময় কয়েক সেকেন্ডের জন্য মাস্ক খুলেছে। এইটুকুর জন্য বকবেন না নিশ্চয়ই.. ? তার সাথে আলু-আদা-ডাল আমার জন্য উপহার)