কোথাও বেড়াতে এসে থিতু হয়ে বসতে বসতেই কি ফেরার সময় হয়ে যায় ? মাঝখানের সময়টা হু হু করে কখন কিভাবে কেটে যায় ।
এই তো সেদিন আমরা ডাক্তারি পাশ করলাম। আমাদের বন্ধু পার্থ দত্ত প্রায় সবার আগে ইন্টার্ণশিপে বিয়ে করল। আমরা ব্যাচমেটরা তখনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাইনি, সবাই এককাট্টা। দলবেঁধে গেলাম পার্থর বিয়ের রিসেপশনে। সে আবার গ্র্যান্ড হোটেলের বল রুমে। 85-86 সালে আমাদের অনেকেরই প্রথম অত বড় হোটেলে ঢোকা। বন্ধু বৎসল পার্থ, শিশুর মতো সবসময় হি হি করে হাসা পার্থ, কেউ রাগালে প্রায় নিজের জামা কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেলা পার্থ– সে যে অমন অভিজাত পুত্র পাঁচ বছর একসঙ্গে পড়েও আমরা সবাই জানতে পারিনি কখনো– এমন সাদামাটা যাপন ছিল আমাদের বন্ধুর– এই আজ সকালে চলে যাবার আগে পর্যন্ত।
এই তো জানুয়ারী মাসের ন’তারিখ– আমাদের গেট টুগেদার হল। সেদিনও একসঙ্গে খেতে বসে কত আড্ডা। বন্ধু শর্মিষ্ঠা সিনহা আজ বলল–পার্থই নাকি আকুলি বিকুলি করছিল ব্যাচের একটা গেট টুগেদারের জন্য। ও কি বুঝেছিল –খাতা জমা দেবার ওয়ার্নিং বেল বেজে গেছে।
ডাঃ পার্থ দত্ত ছিল কলকাতায় নামী সাইকিয়াট্রিস্ট। ভালোবেসে পেছনে লাগলে কিছু মনে করবে না, এমন বন্ধু আমাদের একটাই ছিল। একবার চির ফিচেল সুতনু পার্থ ঢুকতেই বলল–এই পার্থ আসছে, সবার বর্ম টর্ম পরা আছে তো? শিশু স্বভাবের পার্থ প্রথমে রেগে আগুন, তারপরই সুতনুর গলা জড়িয়ে বলল–রাতে কিন্তু তোর বর্ধমান ফেরা হবে না, আমার বাড়িতে থাকবি। মনে হয়–এই তো সেদিন আমাদের ব্যাচের জীবন শুরু হল।
অসম্ভব সিরিয়াস পড়াশোনা করত সাবজেক্টের বাইরে। আর ভীষণ জীবনানন্দ প্রেমী। ব্যস্ত ডাক্তারির পাশাপাশি– কলকাতায় লেকের পাশে জীবনানন্দ দাশের একমাত্র মূর্তিটি নিয়ে ওর কত যে ভাবনাচিন্তা। প্রিয় কবির জন্মদিন ও মৃত্যুদিন –কেউ ভোলে না কেউ ভোলে। আমাদের বন্ধু প্রতিদিন পড়ত জীবনানন্দের কবিতা, প্রতিবছর দুদিন সেখানে যেত ফুল মালা নিয়ে। কখনো অন্য বন্ধুদেরও ডেকে নিয়ে গেছে। আর কেউ এভাবে যায়নি, কেউ যায় না ওই পার্কে কবির কাছে তাঁকে মনে রেখে। ফলকে কিছু ভুল ছিল, মাথায় ছাউনি ছিল না– পার্থ কলকাতা কর্পোরেশনে ঘুরে অনুমতি আদায় করে নতুন ফলক বসায়, ছাউনি করে দেয়।
আমার মোবাইলে এখনো টাটকা পার্থর শেষ মেসেজ –সতেরোই ফেব্রুয়ারি, জীবনানন্দ দাশের জন্মদিনে এবার অসুস্থ থাকায় নিজে যেতে পারেনি, ছেলেকে পাঠিয়েছে আর কবির একটা কবিতা।
আমাদের বন্ধু ধ্রুব ও নিতাই অক্লান্ত ভাবে পাশে থেকেছে শেষ দু’মাস। শেষ পথে রওনা করিয়ে দিয়ে, আজ ওদের কাজের অনাকাঙ্ক্ষিত ছুটি।
কি বলি রে পার্থ, তোর স্ত্রী কন্যা পুত্র শোক সামলে উঠুক–
তোর প্রিয় কবির কথা —
“তখন আমরা অই নক্ষত্রের দিকে চাই–মনে হয় সব অস্পষ্টতা
ধীরে ধীরে ঝরিতেছে–যেই রূপ কোনদিন দেখি নাই পৃথিবীর পথে
যেই শান্তি মৃত জননীর মত চেয়ে থাকে –কয় নাকো কথা
যেই শান্তি বার বার নষ্ট হয় আমাদের এই সত্য রক্তের জগতে,
আজ যাহা ক্লান্ত ক্ষীণ আজ যাহা নগ্ন চূর্ণ–অন্ধ মৃত হিম,
একদিন নক্ষত্রের দেশে তারা হয়ে রবে গোলাপের মতন রক্তিম”