লেখার কথা ছিল পয়লা জুলাই কিন্তু দম ফেলার ফুরসত পাইনি। সকালে আউটডোর তারপর রাতে বারো ঘন্টা ডিউটি। আমার অন্যান্য চিকিৎসক সহকর্মী বা স্বাস্থ্যকর্মীরা কেউই ওই দিন ছুটি পেয়েছিলেন বলে আমার জানা নেই। ফলে ‘চিকিৎসকরা ভালো কাজ করেছেন’ এই মর্মে স্বাস্থ্যকর্মী ছাড়া অন্যান্যদের ছুটি ঘোষণার অভাবনীয় যুক্তিটি আমার ছোট্ট মাথায় ঢোকেনি। ‘চিকিৎসক দিবস’ বলে আলাদা কোনো আয়োজনও ছিল না। পয়লা জুলাই কেটেছে অন্যান্য আর পাঁচটা দিনের মতোই। শুধু আউটডোর শেষে হাসপাতালের এক দাদা একখানা লাড্ডু খাইয়ে গেছিলেন।
মাথার ইনফেকশন নিয়ে ভর্তি হওয়া বাচ্চাটা ভেন্টিলেটরে আছে। মাথায় জল জমেছে। অপারেশন লাগবে। দুপুরের দিকে হাওয়া ভরা ব্যাগ পাম্প করতে করতে অপারেশন টেবিলের দিকে নিয়ে যাচ্ছি। কড়া ঘুমের ওষুধের প্রভাবে বাচ্চা আপাতভাবে নিস্পন্দ। অপারেশনের ঘরে যাওয়ার রাস্তায় খানিকটা অংশ ওয়ার্ডের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। ওয়ার্ডে ভর্তি একটা আট-ন’বছরের বাচ্চা গভীর মনোযোগের সাথে নিস্পন্দ বাচ্চাটাকে নিয়ে যাওয়া দেখছিল। মা’কে নিষ্পাপ ভাবে জিজ্ঞেস করে বসলো, “মা, বাচ্চাটা কি মরে গেছে?” এসব কথা অভিজ্ঞ বুকেও ছ্যাঁৎ করে এসে লাগে। বাচ্চাটার সাথে সাথে বাবা মাও যাচ্ছিলেন। কথাটা শুনেই বাচ্চার বাবা বললেন, “আমার শরীরটা কেমন করছে”। তারপর দেওয়াল ধরে বসে পড়লেন। একদিকে মরণাপন্ন বাচ্চা, তার ওপরে বাচ্চার বাবার এই অবস্থা। সব মিলিয়ে তখন আমরা নাজেহাল। ওদিকে নিষ্পাপ প্রশ্ন করে বসা বাচ্চাটার পিঠে ঘা কতক বসিয়ে দিয়েছেন তার মা। অবশ্য তারপরে আর বিপত্তি কিছু হয়নি। বাচ্চা নির্বিঘ্নে ওটিতে ঢুকেছে। অপারেশনও হয়েছে সফলভাবে। পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হওয়ার পর ভাবতে বসলাম, বাচ্চাটা কি সত্যিই কিছু ভুল বলেছে? যার নড়াচড়া নেই, মুখে নল ঢুকিয়ে পাম্প করছেন অন্য কেউ; তাকে দেখে একটা আট বছরের বাচ্চার মৃত বলে ভেবে ফেলা কি খুব অস্বাভাবিক? ও নয় বাচ্চা। কিছু বোঝে না। ভেন্টিলেটরে থাকা রোগী নিয়ে এরকম অসংখ্য ভুল ধারণা এবং অগণিত কুৎসা কি সাধারণ মানুষের মুখ থেকে বারবার উঠে আসেনি? ভেন্টিলেটরে যে আসলে মৃত রোগীকে জীবিত বলে দেখানোর চেষ্টা করা হয় এবং এটা যে আসলে ‘টাকা খেঁচার কল’ এসব কথা কি বহুশ্রুত নয়? বগলের তলায় ইঞ্জেকশন দিয়ে ডাক্তাররা রোগীকে ভেন্টিলেটরে রেখে পরিবারকে সর্বস্বান্ত করে; বারবার বলা হয়নি এই কথাগুলো? ভেন্টিলেটর যে মৃতপ্রায় মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার অত্যাধুনিক আবিষ্কার সেটা করোনাকালের আগে প্রায় অজানাই ছিল। যখন হাসপাতালের বেডের জন্য হাপিত্যেশ, অক্সিজেনের জন্য হাহাকার… তখন কুৎসা ছড়ানো মানুষদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি বলাই বাহুল্য। করোনাকাল আমাদের নতুন করে অনেককিছু ভাবতে শিখিয়েছে। নতুন করে বুঝতে শিখিয়েছে- জনস্বাস্থ্যের উন্নতি না করে ঝাঁ-চকচকে কর্পোরেট হাসপাতাল বানিয়ে জনগণের স্বাস্থ্যের সামগ্রিক দৈন্যদশা দূর করা যায় না। কথায় কথায় চিকিৎসকদের অসুর সাজানোর যে চিরন্তন প্রয়াস; সেখান থেকেও খানিক আশার আলো দেখা যাচ্ছে কি? কে জানে। শুধু মাঝখান থেকে আট বছরের ছেলেটা পিটুনি খেয়ে গেল। কেন মার খেলো সেটা হয়তো সে এখনো বোঝেনি।
অপারেশনের পর বাচ্চাটা এখন আগের থেকে অনেক ভালো আছে। খুব সম্ভবত আজ-কালের মধ্যে ভেন্টিলেটর থেকে খুলে দেওয়া যাবে। নল দিয়ে খাওয়া শুরু হয়েছে। আরো দুটো বাচ্চা আইসিইউ থেকে বেরিয়ে জেনারেল ওয়ার্ডে গেল।
কত বাচ্চা প্রতিদিন সুস্থ হয়ে যায়। গুনে রাখা হয় না। তবু তাদের সবাইকে ছাপিয়ে জেগে থাকে ওই রক্ত মাখা মুখ। ফুলে যাওয়া, জ্বরে পুড়ে যাওয়া, নীল হয়ে যাওয়া শরীরগুলো। তখন পয়লা জুলাই নাইট ডিউটিতে। রাত প্রায় আড়াইটা। হৃদপিন্ডের থলিতে পুঁজ জমে যাওয়া বাচ্চাটা হঠাৎ স্টপ! মানে হৃৎস্পন্দন নেই! প্রায় মিনিট পনেরো হার্ট পাম্প আর বেশ ক’টা ইঞ্জেকশন দেওয়ার পর শব্দটা ফিরে এলো। লাব-ডুপ। লাব-ডুপ। লাব-ডুপ। কী অসামান্য সে শব্দ! কী শান্তি তার তালে তালে! গাউনের ভেতরে ঘামে ভিজে যাচ্ছি। তবু কিছুক্ষণ, আরও আরও কিছুক্ষণ স্টেথো বসিয়ে বুকের মধ্যে গেঁথে নিচ্ছি সে অপার্থিব শব্দ। একজন চিকিৎসকের কাছে এর থেকে প্রিয় শব্দ আর কিছু হতেই পারে না। যদিও সব যুদ্ধ জেতা হয়ে ওঠে না শেষমেশ। পরের দু’দিনে বাচ্চার আরো অনেকগুলো হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। রক্ত দিতে হয়েছে বেশ ক’বার। এতগুলো ওষুধের নল পেঁচিয়ে ধরেছে ছোট্ট দশ কেজির শরীরটাকে যে সেসবের মধ্যে থেকে তাকে খুঁজে বের করা মুশকিল। শেষ রক্ষা হলো না। নাক মুখ ছাপিয়ে, গ্লাভস ভিজিয়ে, বিছানার চাদর ভিজিয়ে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে এলো। আমার হাতের তলায় সেদিন বন্ধ হয়ে যাওয়া হৃৎপিণ্ড চলতে শুরু করেছিল। আজ থেমে গেল। আমারই হাতের তলায়। অথচ, যে বাচ্চাগুলো সুস্থ হয়ে বাড়ি গেল তার থেকে এই বাচ্চার জন্য অনেক বেশি ঘাম ঝরানো ছিল।
চিকিৎসকের কোনও মন্ত্রশক্তি নেই। আছে কষ্টার্জিত নির্ভেজাল বিজ্ঞান। তাও দুইয়ে দুইয়ে চার হয় না সব সময়। একই রোগ, একই ওষুধ, একই চিকিৎসক- তবু হিসেব মেলে না সব সময়। ভুলও হয়। মানুষ বলেই। প্রতিদিন ভুল হয়, প্রতিদিন শিখি। ডাক্তার ভগবান নয়। অসুরও নয়। হিসি কিংবা হাসি, ঘুম কিংবা ঘাম; তাদেরও হয়। চিকিৎসককে নেহাত একজন রক্তমাংসের মানুষ হিসেবে ভাবতে শিখুন। নইলে ঘটা করে ‘চিকিৎসক দিবস’ পালনের কোন যৌক্তিকতা দেখি না।