ষোলই আগস্ট এলেই আমার এক বন্ধুর কথা মনে পড়ে। বয়সে আমার থেকে বড় ছিলেন; আমিও বরাবর দাদা বলে এসেছি। তবুও আমার বন্ধুই ছিলেন। এমন করে শুধুই আমার ভালো চেয়ে গেলেন আমৃত্যু; এমন বন্ধু আর পাইনি।
কোন কথা দিয়ে শুরু করি ? আমি মেদিনীপুরে ডাক্তারী শুরু করতে চেয়ে প্রথম যেদিন মেদিনীপুরে শহরে আসি সেদিন ওনার সাথে প্রথম আলাপ হয়। সেই উনিশশ সাতাশি সালের শেষ দিনটার কথা সারা জীবন মনে থাকবে। তার চার বছর আগে ডাক্তারী পাশ করলেও নিজে একটা চেম্বার শুরু করার জন্য একটা চেয়ার আর একটা টেবিল কেনার সামর্থ্য আমার ছিল না। কলেজের এক দাদার একটা ঘর ভাড়া নেওয়া ছিল ডাক্তার পাড়ায়। সেই ঘরের অর্ধেকটা আমার জন্য ছেড়ে দিলেন। কিন্তু ঐ যে বললাম, চেয়ার টেবিল কেনার পয়সা আমার ছিল না। পরোপকারী এই দাদা বন্ধুই সেসব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। কিন্তু শুধু আমার উপকার করে ছিলেন বলেই আমার বন্ধু হয়ে গেলেন, ব্যাপারটা সে রকম নয়। পরে বহু বছর ধরে ওনার সাথে যে আমার একটা সুন্দর সম্পর্ক থেকে গেল সেটা ওনার ঐ পরোপকারী মনটার জন্যই।
এই পরোপকারের একটা ঘটনাই ঘটে দু হাজার নয় সালের ষোলই আগস্ট। আমাদের মেদিনীপুরের গ্রামে যেতে হলে বোম্বে রোড থেকে একটা সরু রাস্তা ধরে লোয়াদা বলে একটা গঞ্জ হয়ে যেতে হয়। লোয়াদায় কংসাবতী নদী পার হয়ে মাইল পাঁচেক দূরে আমার গ্রাম। মাঝে গোলগ্রাম নামের একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম আছে। এই গোলগ্রামের বিমল মন্ডলবাবু আমার দাদার বন্ধু। এই বিমলবাবুই আমার সাপের কামড় নিয়ে কাজ শুরু করার মূল কারিগর। সে এক লম্বা ইতিহাস। বিমলবাবুর খুব ইচ্ছা, ওনাদের গোলগ্রামে গিয়ে আমি একবার সাপের কামড় নিয়ে বলে আসি। এমনিতেই এই কাজে ওনাকে আমার গুরু বলে মানি। তার উপর নিজের জায়গায় বলবার ইচ্ছাটা ছিলই। কিন্তু প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায় ঐ প্রত্যন্ত গ্রামে প্রজেক্টর পাই কোথায়।
আমার হঠাৎ করেই খেয়াল হল, মেদিনীপুর শহরে ভোলাদার সাথে যোগাযোগ করা যেতে পারে। মেদিনীপুর শহর থেকে গোলগ্রাম পঞ্চাশ মাইল মত দূর। তার থেকেও বড় সমস্যা হল, লোয়াদার ঐ নদী। বছরে দশ মাস শুকনো থাকলেও বর্ষার সময় নদীতে জল থাকে। নৌকা বা বাঁশের সাঁকো পার হয়ে যেতে হয়।
বন্ধু ভোলাদাকে ফোন করে জানলাম, ওনাদের সংস্থার প্রোজেক্টর আছে, দিতেও রাজি। কিন্তু ঐ রকম একটা দুর্গম এলাকায় কে নিয়ে যায়? কিন্তু ওটা না হলে তো আমি গিয়েও কোন লাভ নেই। সবদিক বিবেচনা করে ভোলাদা বললেন, আমি নিয়ে যাব। ওরকম ঝামেলা করে পঞ্চাশ মাইল দূরে যাতায়াতের ঝক্কি একমাত্র উনিই সামলাতে পারতেন।
প্রোজেক্টরে দেখাতে হলে, দিনের বেলা দেখানো সম্ভব নয়, সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান করতে হবে। জানালাম বিমল বাবুকে। ওনাদের ঐ ষোলই আগস্ট প্রতি বছরই মেডিক্যাল ক্যাম্প হয়। সেটা দিনের বেলা। আমার জন্যই সন্ধ্যায় একটি সাপের কামড় নিয়ে আলোচনার ব্যবস্থা করা হল।
আমার বাড়ী গোলগ্রাম থেকে মাইল তিনেক ভেতরে। সকালে বেরিয়ে দুপুরে বাড়ী চলে গেলাম। বিকেলে এলাম অনুষ্ঠান করতে। আমার একটা ভয় ছিল, বাঁশের সাঁকো দিয়ে ভোলাদার গাড়ী নাও পেরোতে পারে। সে ক্ষেত্রে বিমলবাবুর ছেলেরা মোটর সাইকেলে গিয়ে ওনাদের নিয়ে আসবে। দেখি ভোলাদা গাড়ী নিয়ে হাজির। উনি যে এত হাঙ্গামা করে আমাদের গ্রামের দিকে এসেছেন তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করায় জানালেন, সাপের কামড় নিয়ে আমি কি করছি সেটা জানার আগ্রহ নিয়েই উনি ঐ হাঙ্গামাটা মেনে নিয়েছেন।
আমার সাথে এই “জন সেবা”-র বাতিকে জড়িয়েছিলেন আরও ষোল আঠার বছর আগে। তখন আমি মেদিনীপুরে ডাক্তারী করি। আমরা দুজনেই লায়ন্স ক্লাবের সদস্য হয়েছি। লায়ন্স ক্লাবের অনেক দিনের প্রকল্প ছিল, চোখের অপারেশন শিবির করা। স্বাভাবিক ভাবেই চোখের ডাক্তার হওয়ার সুবাদে, যে কয়েক বছর আমি মেদিনীপুরে ছিলাম, ঐ সব শিবিরের দায়িত্ব দেয়া হয় আমাকে। সেই সময়ই দেখি ভোলাদার অমানুষিক পরিশ্রম করার ক্ষমতা।
নিজের পেশার বাইরেও একজন মানুষ মাসে উনত্রিশ দিন ঘন্টা দশেক করে কাজ করে যাচ্ছেন, এমন আর দেখিনি। ওনার উৎসাহেই আমরা মেদিনীপুরে দু বার শুধু কুষ্ঠ রোগীদের জন্য চোখ অপারেশনের শিবির করি। একবার তো মহামান্য রাজ্যপাল , রঘুনাথ রেড্ডি মহাশয় আমাদের শিবির উদ্বোধন করেন।
ঐ সময় থেকেই আমরা দুজনে মেদিনীপুরের কুষ্ঠ আশ্রমের সাথেও যুক্ত হয়ে যাই। আমি তারপর খুব বেশীদিন মেদিনীপুরে থাকিনি। কিন্তু কুষ্ঠ আশ্রমের প্রাণপুরুষ প্রণম্য অরুণ বাবুর সান্নিধ্যে আসার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। এমন একজন মহান মানুষের পায়ের ধুলো নিতে পেরেছি, সেটাই আমাকে ধন্য করেছে।
ভোলাদা মেদিনীপুরেই ছিলেন, তাই অরুণ বাবুর শেষ দিন পর্যন্ত তাঁর সাথে থাকার বিরল সৌভাগ্য ওনার হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ভোলাদা মেদিনীপুরের ঐ কুষ্ঠ আশ্রমের সাথেও যুক্ত ছিলেন।
আমরা চোখের অপারেশন শিবির করার সময় থেকেই লক্ষ্য করেছি, মেদিনীপুরের তথাকথিত ভদ্রলোকেরা ঐ দিকটা এড়িয়ে চলেন। এমনকি মহামান্য রাজ্যপাল মহোদয়ের সাথেও দু’একজনের বেশী সাংবাদিক শিবির দেখতে যান নি। আমি মেদিনীপুর ছেড়ে আসার পর দু’একবার শ্রদ্ধেয় অরুণ বাবুর বাড়ীতে গেলেও কুষ্ঠ আশ্রমের দিকে যাওয়ার সময় হয়নি। ভোলাদা কিন্তু ওনার জনসেবার কাজ আরও বেশি করে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কুষ্ঠ আশ্রমের কাজ, লায়ন্স ক্লাবের কাজ ছাড়াও থ্যালাসেমিয়া সোসাইটি নিয়েও মেতে ছিলেন। আমার সাপের অনুষ্ঠানের জন্য উনি যে প্রোজেক্টর নিয়ে গোলগ্রাম গেছিলেন, সেটাও ঐ থ্যালাসেমিয়া সোসাইটির।
মাঝে একবার মেদিনীপুরে রাত্রে থাকতে হয়েছিল। হাওড়া থেকে ট্রেন ফেল করে শেষ ট্রেনে যাচ্ছি জানালাম ওনাকে। বললেন, “আমি ঝাড়গ্রামে এসেছি সোসাইটির কাজে, ফিরতে রাত হবে, আপনি আমার বাড়িতে চলে যান, আমি আপনার বৌদিকে বলে রাখছি।“ দাদার মত বৌদিও আমাকে স্নেহ করেন। প্রায় মাঝ রাতে ওনাদের বাড়ি পৌঁছে বৌদিকে কতোটা বিরক্ত করেছিলাম, পরে ভেবে লজ্জা পেয়েছি। আমার খুব সকালে বেরিয়ে যাওয়ার ছিল। যখন বেরলাম, ভোলাদা তখনও ঘুমাচ্ছেন। কতো রাত্রে ফিরেছেন জানি না, তাই আর ওঠালাম না। এরকম নিজের পেশার বাইরের কাজকে বলতেন, “পঞ্চায়েতি করা”। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই পঞ্চায়ে্তি করে গেছেন।
চলে যাওয়ার কয়েকমাস আগে একবার কলকাতায় এসে আমাকে একটা জায়গায় ধরে নিয়ে গেলেন। লায়ন্স ক্লাবের প্রতিনিধি হয়ে একটা গুরু গম্ভীর মিটিংএ এসেছেন। ওখানে একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী থাকবেন, ওনারা জানতেন। আমার সাথে আলাপ করিয়ে দিলেন, বেশ কসরত করেই। পরে বুঝেছি, আমি যে রকম গেঁয়ো সমস্যা নিয়ে কাজ করি, মন্ত্রীসান্ত্রীদের ওসব ছোটখাট ব্যাপার নিয়ে ভাবার সময় নেই। আমার সহকর্মী- বন্ধুদেরই একযুগের বেশী ধরে বুঝিয়ে পারছি না, মন্ত্রীকে এক মিনিটে কি করে বোঝানো যাবে!
সেই শেষ দেখা। লায়ন্স ক্লাবের একটা কাজে আমার সামান্য সাহায্য চেয়েছিলেন। আমার সাহায্য কোন কাজে লাগাতে পেরেছিলেন কিনা আর জানা হয়নি। কয়েক মাস পর মেদিনীপুরের এক বন্ধু ফোন করে জানালেন যে , ভোলাদা গাড়ী দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। ওনার প্রিয় সেই পঞ্চায়েতি কাজ করতেই যাচ্ছিলেন দীঘার দিকে। পিছন থেকে একটা লরি ওনাদের গাড়িকে ধাক্কা মারে। আমার সবথেকে উপকারী বন্ধুকে অকালে হারালাম। এই একজন মানুষের কাছে ঋণী থেকে গেলাম। খুব প্রচার বিমুখ ছিলেন। ডা ভোলানাথ রায় মেদিনীপুরের জন্য যা করে গেছেন, মেদিনীপুরবাসি বহু বছর কৃতজ্ঞচিত্তে তা মনে রাখবে আশা করি।